ওষুধ দেওয়া খুব সোজা। সমস্যাটুকু শুনে, মনের দেরাজ হাতড়ে, খসখস করে কয়েকটা ওষুধ লিখে দেওয়া সত্যিই বেশ সহজ। রোগীর পর রোগী আসে, কারো ঘুম আসে না রাতের পর রাত, কারো সারা শরীরে জ্বালাপোড়া ভাব, কারো মাথার বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা থামতেই চায় না, আর তার থেকেও বেশি সংখ্যক মানুষ নিজের সমস্যাটা নিজে বুঝে ঠিকঠাক ভাষায় ভালো করে বলেই উঠতে পারেন না।
তবু ওষুধ লেখা যায়। কয়েকটা ওষুধ লিখে দেওয়াই যায়, কিছুটা আন্দাজে, কিছুটা নলেজে, কিছুটা অভিজ্ঞতায়, কিছুটা হাতড়ে। সাইকোপ্যাথোলজির গলিঘুঁজি পেরিয়ে কাজেও লাগে সেসব ওষুধ, পরবর্তী দেখায় নতুন অভিযোগ নতুন সমস্যা শুনে ওষুধ অ্যাডজাষ্ট করা যায়। ভালোই চলে এমন করে..
সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রশ্ন ওঠে মনের ভেতর, ট্রিটমেন্ট না ম্যানেজমেন্ট? এই প্রশ্ন শুধু সাইকায়াট্রির নয়, সব ডাক্তারি বিভাগের। ট্রিটমেন্ট মূলত ওষুধ নির্ভর, আর ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি হয় সবকিছু মিলিয়ে। ওষুধ, খাবার, জল, দৈনন্দিন অ্যাক্টিভিটি লেভেল, ব্যায়াম, সুস্থ কর্মজীবন, সুস্থ পরিবার জীবন, সুস্থ সামাজিক জীবন, দৈনন্দিন কর্মসূচি, বিনোদন সবকিছু মিলিয়ে একজন রোগীর ম্যানেজমেন্ট হয়। ওষুধ দেওয়াটা যতোটা সহজ, জীবনের বাকি জায়গাগুলোতে দাঁত ফোটানো ততটাই কঠিন। প্রশ্ন ওঠে Compliance এর, অর্থাৎ রোগী প্রেসক্রিপশন কতোটা মেনে চলছেন, আর কতোটা মেনে চলছেন না?
রোগীকে আমরা বলি, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাবেন, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠবেন। দৈনন্দিন জীবনে কিছুদিন চেষ্টা করলেই বোঝা যায় কতোটা কঠিন কাজ এটা, রোজ করে যাওয়া। আমরা বলি, দিনে চারবেলা খাবেন, বেশিক্ষণ সময় দেবেন না দুটো বড়ো মিলের মাঝে। যাঁরা খেটে খান, ঘরে হাজার একটা কাজ, এবং অনেক দিনের অভ্যাস খাবারের সময়ে খাবার না খাওয়া, তাদের নতুন অভ্যাস করানো কি সহজ কথা? বলি, দিনে ৩-৩.৫ লিটার জল মেপে খেতে। রোগী ঘাড় নেড়ে বলে যান, প্রচুর জল খাই ডাক্তারবাবু। তারপরও জানি, আসলে হয় না। সবচেয়ে কঠিন ব্যায়াম করানো। ভারতীয় জনগোষ্ঠী এমনিতেই ব্যায়ামবিমুখ। যাঁরা ব্যায়াম করেন না নিয়মিত, এবং শুরু করার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন, তাঁরা জানেন। নিয়মিত শরীরচর্চার জন্য যে উদ্যোগ, উদ্যম লাগে, সেটা শুধুমাত্র আউটডোরের ধমক থেকে আসে না। আউটডোরে ধমক দেয়া খুব সহজ, জীবন পাল্টানো খুব কঠিন। রোগীকে ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার গুরুত্ব বোঝানো কঠিন, তার জন্য সময় লাগে, ধৈর্য্য লাগে, সেটুকু সময় আমাদের ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের দেয় না।ওষুধ লিখতে হবে, ভিটামিন লিখতে হবে, তার বাইরে বাকি জীবনটুকু নিয়ে বেশি ‘জ্ঞান’ দিলে রোগী আর ঘরের লোক দুইই বিরক্ত হন। (সাইকায়াট্রি বোধহয় এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম) বোঝানো যায় না, ওটাও প্রেসক্রিপশন।ওটা বোঝানো ওষুধ বোঝানোর থেকেও কঠিন।
রোগীর সমস্যা পেরিয়ে রোগীকে ছোঁয়া যায় না, তার বাড়িকে, তার পরিবারকে, তার প্রতিদিনকে ছোঁয়া যায় না। হাত বাড়াই, শূন্য হাত ফিরে আসে। মাঝে মাঝে হাতে হাত মিলে যায়। ট্রিটমেন্ট পেরিয়ে ম্যানেজমেন্ট স্তরে উঠে আসি আমরা। রোগীও বোঝেন এর গুরুত্ব। ভারী ভালো লাগে তখন। আনন্দ পাই।
হিপোক্রেটিস থেকে শুরু করে হ্যারিসন সবাই বলে গেছেন, রোগী মাত্রেই রোগলক্ষণের সমষ্টি নয়। রোগী একটা জ্বলজ্যান্ত, সম্পূর্ণ মানুষ। তাকে সেভাবেই দেখা উচিত। অর্থনীতি আজ স্বাস্থ্যকে এমন জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে, যে প্রতি পদে এই কথাটাকে অস্বীকার করতে করতে যেতে হয়, আর প্রতি পদে একটা ডাক্তারের ভেতরে ডাক্তারটা একটু একটু শুকিয়ে যেতে থাকে। তারপরেও আমরা হাত বাড়াই। আমরা চেষ্টা করি।অপেক্ষা করি একটু স্পর্শের।
তাই বলছিলাম, ওষুধ লেখা খুউউব সোজা…