এমবিবিএস কোর্সের তৃতীয় বছরে প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন নামে একটি বিষয়ের থিয়োরি বেশ ভালভাবে মুখস্থ করলেও, ব্লক, অঞ্চল, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এইসব শব্দগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত ভাসা ভাসা ধারণা নিয়েই রুরাল হেলথ সার্ভিসের আঙিনায় পা বাড়িয়েছিলাম আদ্যন্ত শহুরে আমি। উত্তরবঙ্গের কালিযাগঞ্জে।
কোনো এলাকার ইতিহাস, মাটি, জনজীবন, তার আনন্দ-বেদনা, দুর্বলতা, কোনো কিছু না জেনেই যান্ত্রিক ভাবে তার সেবা করব বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কারোর জন্যে আন্তরিক ভাবে কিছু করতে গেলে আগে তাকে জানতে হয়, সম্পৃক্ত হতে হয়, একাত্ম হতে হয়।
উত্তরবঙ্গে গিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য-পিরামিডের বুনিয়াদ, অর্থাৎ প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হচ্ছিল আমার। আমি জানলাম, একটি ব্লকের অন্তর্গত অনেকগুলি গ্রাম পঞ্চায়েত থাকে, তাদের বলে অঞ্চল। প্রতিটি পঞ্চায়েতের জনসংখ্যা নির্ধারণ করে সেই অঞ্চলের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা।
দেখলাম, প্রতি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন একজন করে মহিলা এবং পুরুষ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট (ফিমেল) আদতে একজন অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফারি ট্রেনিং প্রাপ্ত সিস্টার, যিনি শিশু ও প্রসূতির টিকাকরণ, নানা রোগ দূরীকরণের সরকারি কর্মসূচির গ্রামীণ স্তরে রূপায়ণ, নানা রকমের রিপোর্ট তৈরি করা, তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করা, সেন্টারের ওষুধপত্রের হিসেব রাখা ইত্যাদি থেকে আরম্ভ করে প্রয়োজনে প্রসূতির স্বাভাবিক প্রসব পর্যন্ত করাতেন। তাঁদের সহযোগী মেল হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টদের সঙ্গী করে প্রত্যন্ত জেলাটির গ্রামগুলির অগণিত অশিক্ষিত, অনাধুনিক, অসহায় মানুষজনের মুশকিল আসান হয়ে এঁরা ঘুরে বেড়াতেন দাপটে।
চার পাঁচটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের তদারকিতে থাকতেন একজন হেলথ সুপারভাইজার। সব হেলথ সুপারভাইজারদের মাথার উপরে থাকতেন একজন ব্লক প্রাইমারি হেলথ নার্স। আর গোটা ব্লকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ব্লক মেডিক্যাল অফিসার বা বিএমওএইচ।
সংক্ষেপে, এটাই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার পিরামিডের প্রথম টিয়ার।
সব জেনেশুনে, গ্রামীণ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসের এই মানচিত্রকে, চতুর্দিকে অজস্র ডালপালা মেলে দেওয়া, মাটির গভীরে দূরদূরান্তে শিকড় ছড়িয়ে দেওয়া এক পিতামহ বৃক্ষের সঙ্গে তুলনীয় মনে হয়েছিল আমার।
কেন্দ্রীয় সরকারী অসংখ্য রোগ প্রতিরোধী প্রোগ্রাম তখন গুঁজে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের আঙিনায়। ন্যাশনাল ব্লাইন্ডনেস কনট্রোল প্রোগ্রাম, ম্যালেরিয়া ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম, রিভাইজ্ড ন্যাশনাল টিউবারকুলোসিস কনট্রোল প্রোগ্রাম, লেপ্রসি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম, যৌনরোগ প্রতিরোধী প্রোগ্রাম — কর্মসূচির যেন আর শেষ নেই।
তবে, সবচাইতে ঢাক ঢোল পিটিয়ে পালিত হতো ইন্টিগ্রেটেড পালস পোলিয়ো ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম, কারণ, দেশ তথা রাজ্যব্যাপী পোলিয়ো রোগের প্রাদুর্ভাবের ছবিতে উত্তরবঙ্গের এই অনাদৃত জেলাটি তখন এক কুখ্যাত নাম।
গ্রামীণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল প্রচার, যার আবশ্যক অনুষঙ্গ ছিল ‘হেলথ টক’। বাসরাস্তার ধারে, ব্যস্ত বাজারের মোড়ে, ছোটোখাটো জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘অমাইক’ গলায় বক্তৃতা করে যাচ্ছি আমি, আর লঝ্ঝড়ে অ্যামবাসাডরে চড়ে, আমার দিকে হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে কোনো গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছেন ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি — এ দৃশ্য এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই।
এবারে আসি সরকারি স্বাস্থ্য-পিরামিডের দ্বিতীয় টিয়ারের কথায়।
দ্বিতীয় টিয়ারে রয়েছে মহকুমা, জেলা ও স্টেট জেনারেল স্তরের হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র। যে সমস্ত রোগের চিকিৎসা ঐ প্রথম টিয়ারে হওয়া সম্ভব নয়, সেই রোগীরাই এসে পৌঁছবেন দ্বিতীয় টিয়ারে। অর্থাৎ এই দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে প্রত্যক্ষ নিরাময়ব্যবস্থা বা ‘কিওর’।
আর যে সকল রোগের আরোগ্যের জন্য বিশেষ রকম চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁরা পৌঁছবেন তৃতীয় পর্যায়ে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও অধুনানির্মিত মাল্টি এবং সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল।
সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যাচ্ছে, যে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি পর্যায় থেকে টারশিয়ারি স্তরে যখন পৌঁছবে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পিরামিডের প্রস্থ ক্ষীণ হয়ে আসবে। চওড়া ভিত, সরু চূড়া।
এই প্রসঙ্গে, আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কালিয়াগঞ্জের সেই গ্রামীণ হাসপাতালে, ডিউটি চলাকালীন একদিন এক প্রসূতিকে নিয়ে তার বাড়ির লোক পৌঁছলেন ইমার্জেন্সিতে। মেয়েটি পূর্ণগর্ভা ও রক্তাল্পতার শিকার। তার উপর বাড়িতে দাইয়ের সাহায্যে প্রসবের ব্যর্থ চেষ্টার ফলে একেবারেই নেতিয়ে পড়েছে। গর্ভস্থ শিশুর অবস্থাও সঙ্কটজনক, তার হৃদ্স্পন্দন যথেষ্ট অস্বাভাবিক। বুঝলাম এই শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে এখনই, নয়ত এ বাঁচবে না। পরীক্ষা করে দেখলাম স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব নয়, এদিকে হাসপাতালে তখন সিজারের ব্যবস্থা ছিল না। জেলা হাসপাতাল ২৫ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পৌঁছানোর সময় দেবে না গর্ভস্থ শিশু। সহকর্মী এক চিকিৎসককে ডেকে আনলাম তাঁর বাড়ি থেকে। ফরসেপ্স ব্যবহার করে ভূমিষ্ঠ হলো বাচ্চা, কিন্তু কাঁদল না। তারপর নবজাতকের চিকিৎসায় আমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, ঐ গ্রামীণ হাসপাতালের সামান্য পরিকাঠামোর মধ্যেই সুস্থ করে তোলা হলো গলায় নাড়ি জড়িয়ে জন্মানো, শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে যাওয়া সদ্যোজাতকে। দায় এড়িয়ে রেফার করাই যেত দ্বিতীয় টিয়ারের হাসপাতালে, কিন্তু তাতে বিপন্ন হতো মা ও শিশু, দুজনেরই জীবন। ইদানীং, বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসাকেন্দ্রে মানবসম্পদের অপরিকল্পিত বন্টন এবং যন্ত্রপাতির অপ্রয়োজনীয় সরবরাহ লক্ষ্য করা যায়, যেটা স্বাস্থ্য দফতরের একটা ধারাবাহিক অবহেলার ফসল।
এই অবহেলা যদি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থার একটা কারণ হয়, অন্য দুর্বলতা হলো রোগীদের চিকিৎসার জন্য, তাঁদের পরিজনদের সঠিক পথের দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে সরকারি ব্যর্থতা। একজন রোগী বা তাঁর পরিজন নিজেদের বিচারবুদ্ধি বা পছন্দের উপর ভরসা করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বাছেন, যেটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। যে রোগীর চিকিৎসা প্রথম স্তরেই করা যেত, ‘বড় হাসপাতালে’র মোহে সেই রোগীকে এনে ফেলা হচ্ছে টারশিয়ারি স্তরের মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কখনো বা, দ্বিতীয় পর্যায়েই আরোগ্য করা যায় এমন রোগীকে, দায় এড়ানোর মানসিকতা থেকে বা প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মীর অভাবে রেফার করে দেওয়া হচ্ছে তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে। ফলে, বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে রোগীর সংখ্যায় দেখা দিচ্ছে বিপুল বৈষম্য। কোথাও কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠছে চিকিৎসক-নার্সদের, কোথাও বা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ না পেয়ে প্রত্যন্ত জেলার রোগীকে নিয়ে দৌড়োতে হচ্ছে দুশো কিলোমিটার দূরের স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে, আর কখনো বা বড় হাসপাতালে দুরারোগ্য রোগী বেড না পেয়ে রাস্তায় পড়ে মরে খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। আর আমাদের স্বাস্থ্যের পিরামিড ক্রমশ মাথা ভারী হয়ে উঠছে, যার সরু, দুর্বল পা সেই চওড়া মাথার ভার আর বহন করতে পারছে না।
জেলায় জেলায় মাল্টি সুপার হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন, স্বাস্থ্যের বুনিয়াদি ভিতকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। সরকারের সদিচ্ছা নিশ্চয় আছে বলে বিশ্বাস করি, সেই সদিচ্ছাকে সঠিক পথে চালনা করার প্রয়োজন রয়েছে। আগায় জল সেচন করে যেমন গাছের শিকড় পোক্ত করা যায় না, তেমনই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে, গাদাগুচ্ছের ‘বড় হাসপাতাল’ গড়ে, স্বাস্থ্যের বুনিয়াদ মজবুত করা সম্ভব নয়। রোগের প্রতিকারের চেয়ে রোগকে প্রতিরোধ করা অনেক বেশি জরুরি এবং অনেকাংশে সহজ কাজ।