তার বললে আমরা সাধারণ ভাবে বুঝি লম্বা সুতো বা দড়ির মত, ধাতু নির্মিত একরকম জিনিস। এই তার জিনিসটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করা কয়েকটি জিনিসের মধ্যে একটি। আমরা ছোটবেলায় জানতাম, তার মানে লোহার সরু তার, যা দিয়ে বেড়া বাঁধা হয়। একটু মোটা তার উঠানে দুটি বাঁশ দিয়ে টাঙানো থাকত, জামা কাপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য। তখন কাপড় মেলার জন্য নাইলনের দড়ি পাওয়া যেত না।
পুরনো বাংলা সাহিত্যে তার বললে টেলিগ্রাম করা বোঝাত। এখন টেলিগ্রাম বললে নতুন ছেলে মেয়েরা বুঝবেই না। আমরা বছর তিরিশ আগেও দেখেছি, রেল লাইনের পাশে দিয়ে টেলিগ্রাফের লোহার খুঁটির ওপর দিয়ে তিন চারটি তার চলে গেছে, মাইল এর পর মাইল। তখন দ্রুত সংবাদ পাঠানোর জন্য এই টেলিগ্রাফ একমাত্র উপায় ছিল। কবে যে সেই টেলিগ্রাফের তার আর লোহার খুঁটি উধাও হয়ে গেল , বুঝতেই পারিনি। তারপর দেখতাম ঐ রকম লোহার ফাঁপা খুঁটির ওপর দিয়ে টেলিফোনের তার। এই তারগুলো কালো প্লাস্টিক মোড়া থাকত, এজন্যই হয়ত এদের তার না বলে কেবল বলা হত।
গত বছর দশেকে মোবাইল ফোন এত ব্যপাক ভাবে বাজার দখল করল যে, সেই টেলিফোনের তার আর চোখেই পড়ে না। এই তার ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার আদি নাম ছিল বেতার। এখনও বেতার বললে রেডিও বোঝায়। বেতার তরঙ্গ ব্যবহার আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, সেই কোন বৃটিশ আমলে। সেই ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে আজকের মোবাইল ফোন -এ।
রেডিওর জায়গায় টি ভি এল। আমাদের দেশে প্রথম দিকে যে টি ভি ছিল সেগুলি দেখার জন্য অ্যান্টেনা লাগত। অ্যান্টেনা থেকে চ্যাপ্টা তার হয়ে সিগন্যাল বা বার্তা ঘরের ভেতরে রাখা টি ভি-তে আসত। এই চ্যাপ্টা তারও প্লাস্টিক ঢাকা, তাই কেবল। খুব তাড়াতাড়িই টিভির অ্যান্টেনা বাতিল হয়ে এসে গেল কেবল টিভি। সবার বাড়ীর ছাদে একটা করে অ্যান্টেনা লাগানোর দরকার নেই। তাছাড়া ক্যেবল টিভির ছবিও ঝকঝকে। কিন্তু এই কেবল টিভির জন্য বেশ শক্ত প্লাস্টিক ঢাকা তার , এ পাড়া থেকে ও পাড়া চলতে থাকল। রাস্তার পাশের বিদ্যুৎ এর খুঁটির তারের জটলায় আর এক রকম তার যোগ হল। মোবাইল ফোন এসে যাওয়ার পর ঐ তারের জটলা থেকে টেলিফোনের তার একটু একটু করে বিদায় নিল। তার পরের ধাপে এল ডিশ অ্যান্টেনা। আবার বাড়ীর ছাদে ছাদে বড় থালার মত ডিশ; তার থেকে ঘরের ভেতরে চলে আসে কেবলের তার।
টিভি আসার আগেই আমাদের চারিদিকের আকাশ জুড়ে এসে গেছে বিদ্যুৎ এর তার। শহরে তো এসেছে বহু যুগ আগে; প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুৎ এর তার ঢুকে গেছে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে। প্রথমে দেখলাম মাঠের ভেতর দিয়ে, ধানের জমির ওপর দিয়ে তিনটি করে মোটা তার চলে যায়, দূর থেকে দূরে। কিছুটা দূরে দূরে, কুড়ি বাইশ ফুট উঁচু শাল কাঠের বা সিমেন্ট এর খুঁটির ওপর দিয়ে ঐ তার চলে যায়। গ্রাম ছেড়ে বম্বে রোডে এলে দেখা যায় হাই টেনশন লাইন । বিরাট বিরাট উঁচু লোহার ফ্রেমের স্তম্ভের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে মোটা মোটা বিদ্যুতের তার। এই মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া মোটা বিদ্যুতের তারগুলো লোহার ওপর অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপ দেওয়া। প্রথম দিকে বিদ্যুতের তারগুলো শুধু তামার তৈরী হত। এখনও বাড়ীর ভেতরের সব বিদ্যুতের তারগুলো তামারই হয়। এই তামার তার প্লাষ্টিক দিয়ে মোড়া থাকে। বহু বছর আগে সিল্ক মোড়া বিদ্যুতের তার দেখেছি। কিছু কিছু বিদ্যুতের তার অ্যালুমিনিয়াম এরও দেখেছি। সাধারণ বিদ্যুতের তার দুই রঙের প্লাষ্টিক মোড়া দুটি তার পেঁচিয়ে রাখা হয়। যে কোন বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রের দুটি তার থাকে। ঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে নানান সমস্যা হয়, তাই আজকাল শহরের অনেক বিদ্যুতের তার বা কেবল মাটির তলা দিয়ে চালানো হচ্ছে।
মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার বললেই রেলের ওভার হেড তার বোঝায়। এ ছাড়া আর কয়েক বছর দেখা যাবে কোলকাতার ট্রামের তার। রেলের ওভার হেড তার ছেঁড়া আর ঐ তারে তারে কলাপাতা ছোঁড়া বঙ্গ জীবনের অঙ্গ।
একটু ভালো বা উচ্চ ক্ষমতাম্পন্ন যন্ত্রের জন্য তিনটি তার লাগে। বাড়ীর বিদ্যুতের জন্য প্রায়ই এই তিন নম্বর তারটি সাধারণ লোহার তার দেওয়া হয়। এই লোহার তারের ব্যবহারও ব্যাপক। সাধারণত এই তারগুলিকে বেড়া বাঁধার তার বলে। কঞ্চি বা গাছের ডাল, বাঁশের বাতা দিয়ে বেঁধে বাগান বা বাড়ীর বেড়া বাঁধা হয়। মুলী বাঁশের চাটাইও এই বেড়া বাঁধার লোহার তার দিয়ে বাঁধা হয়। সবজির ক্ষেতেও এই লোহার তার মাচা বাঁধার কাজে লাগাতে দেখেছি। শহর অঞ্চলে নতুন বাড়ি বানানোর সময়, লোহার রড বেঁধে যে খাঁচা করে ঢালাই করা হয়, সেই রড বাঁধার কাজে সরু লোহার তার প্রচুর ব্যবহার হয়।
আগে গ্রামের দিকে তালপাতা বা টালির ছাউনি শক্ত করে বাঁধার জন্য লোহার তার ব্যবহার হত। এই লোহার তার রাস্তার দু’পাশের গাছে টান টান করে বেঁধে মোটর সাইকেল আরোহীকে পেড়ে ফেলে ডাকাতি হয়েছে, এমন একটা গল্প শুনেছিলাম। গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমায় , বাঁশ বনের বাঘটিকে শক্ত লোহার তার দিয়ে বাঁধা ছিল, এমন যেন কার সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম, ও দিয়ে অদৌ কি বাঘকে বেঁধে রাখা সম্ভব?
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীরা টেলিগ্রাফের তার কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি করতেন। এখন ডাকাতরা ফোনের আর সি সি টিভি র তার কাটে শুনি।
বনের বাঘকে তারের বাঁধনে আটকানো না হলেও বনের পাখীদের তারের খাঁচায় বন্দী করে রাখা আমাদের একটা খুব পুরনো বদ অভ্যাস। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পাখীদের লোহার তারে তৈরী খাঁচায় আটকে রাখা হয়। চিড়িয়া খানায় দেখছি, পাখী তো বটেই, বাঁদর শিম্পাঞ্জীও তারের খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে। ঘরের জানালায় শক্ত তারের জাল লাগিয়ে চুরি আটকানোর চেষ্টা দেখেছি। আর জানালার সুক্ষ্ম তারের জাল লাগিয়ে মশা আটকানোর চেষ্টাও হয়। বিরাট বিরাট খুব শক্ত তারের জাল লাগিয়ে তাই দিয়ে বড় বড় পাথর আটকে বাঁধ দেওয়া হয়।
এই লোহার তারকে মেশিনে পাক দিয়ে নানা রকম স্প্রিং তৈরী করা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজেই স্প্রিং ব্যবহার হয়। বাচ্চাদের হাতে এই স্প্রিং বা সামান্য একটা লোহার তার কি ভয়ংকর হতে পারে, যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যাবে না। এক সন্ধ্যায় চুঁচুড়ায় আমার কাছে একটি বছর দশের ছেলেকে আনা হয়েছিল। একটা লোহার তার নিয়ে খেলছিল, চোখে একটু লেগেছে। ছেলেটি ডান হাত দিয়ে ওর ডান চোখ চেপে ধরে এসেছিল। হাত সরিয়ে দেখি চোখটা ফেটে ভেতরের সব কিছু বেরিয়ে এসেছে। তার ছিটকে এসে যেমন চোখের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, স্টেনলেস স্টিলের সুক্ষ্ম তার চোখের অপারেশনেও ব্যবহার করা হয়। মালাই চাকির অপারেশনেও এরকম তার ব্যবহার করা হয়।
আর এক বিপজ্জনক তার হল ডিটোনেটারের তার আর ল্যান্ডমাইন- এর তার। সময় মত নিরাপত্তা কর্মীদের নজরে না এলেই ভয়ংকর বিপদ।
আজকাল রাস্তা ঘাটে অনেক লোক, বিশেষ করে কম বয়সি ছেলে মেয়ে দেখা যায়, দুই কান থেকে দুটি সরু তার নেমে, প্যান্টের পকেটে চলে গেছে; এগুলি হেড ফোনের তার।
একতারার তার আর দোতারার তার যে সুর তোলে তাতে আমাদের মত মেঠো বাঙালির মন উদাস হয়ে যায়। সেতার, সরোদ, বেহালার তারের সুর তো বিশ্বজনীন। বীণা আমরা যতো সরস্বতী দেবীর হাতে দেখেছি, ততোটা বাজাতে শুনিনি। কিন্তু প্রায় সব জলসায় যে গীটার বাজে, তাকেই যে রম্য বীণা বলে, অনেক পরে জেনেছি। আজকাল যে কোন জলসা, মিটিং, বক্তৃতা হলেই মাইকের তার পাড়া ছাড়িয়ে বেপাড়ায় অন্য পাড়ায় চলে যায়।
অর্কেস্ট্রা নামের প্রচুর বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে যে গান হয় তার সুর কি আমাদের মনের বীণার তারে সুর তোলে? কোন রকম বাদ্য যন্ত্র ছাড়াই প্রতুল বাবু যখন গেয়ে শোনান, “আমি বাংলায় গান গাই”, কষ্ট করেও ভাবতে পারিনা যে দুই বাংলার মধ্যে হাজার মাইল লম্বা একটা উঁচু কাঁটাতারের বেড়া আছে। লালন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ঐ কাঁটাতারের বেড়া ছাপিয়ে কোটি কোটি বাঙালির মনবীণা তারে সমান ঝঙ্কার তোলে। আমরা গেয়ে উঠি , “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।