বছর বর্ষার সময়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মহামারি (Dengue Epidemic)-কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ভয়াবহতম ডেঙ্গু সংক্রমণ আখ্যা দেন। এছাড়াও আসন্ন জলবায়ু সঙ্কটের অশনিসঙ্কেত এবং তার কারণে পতঙ্গ বাহিত রোগের (Vector Borne Diseases) প্রাদুর্ভাব (Prevalence) এর সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। গত বছর বাংলাদেশের ডেঙ্গু মহামারিতে এক লক্ষ ৩৫ হাজারের বেশি সংক্রমণ এবং ৬৫০ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। একই সময়ে এবং তার আগের বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ডেঙ্গু মহামারি ঘটে, বহু মানুষ মারা যান, জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চতুর্থাংশ শেষে ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশ যান নামাচ্ছেন, মহাকাশ যান ছোটাচ্ছেন সূর্যের বলয়ের কাছাকাছি, জল স্থল অন্তরীক্ষে কার্যকর আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করছেন, কৃত্রিম মেধাকে কাজে লাগিয়ে সহজে অনেক কাজ দ্রুত করে ফেলছেন, শ্রীনগর ও বারামুলার মধ্যে ১১৭৮ ফিট উচ্চতায় চেনাব রেল ব্রিজ বানিয়ে ফেলেছেন, হুগলী নদীর ১৬ মিটার নিচ দিয়ে মেট্রো রেল চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন। চিকিৎসকরাও রবোটিক সার্জারির মাধ্যমে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করছেন, Extracorporeal Membrane Oxygenation (ECMO) মেসিনের মাধ্যমে চূড়ান্ত সঙ্কটগ্রস্ত রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার এত উন্নতি সত্ত্বেও ডেঙ্গুর মত অসুখকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না কেন?
স্বাভাবিকভাবে সচেতন নাগরিক মননে এই প্রশ্নটি উঠছে। পতঙ্গ বিশারদ (Entomologist), ভাইরাস বিশেষজ্ঞ (Virologist), মহামারিবিদ (Epidemiologist), অণুস্তরীয় জীব গবেষক (Molecular Biologist), বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (Consultant Physician), টিকা বিশেষজ্ঞ (Vaccinologist), পরিবেশবিদ (Environmentalist), প্রযুক্তিবিদ (Technology Expert), স্থপতি (Town Planner) প্রমুখেরা গবেষণা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনবধি যেটুকু জানা গেছে তার উপর দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে এবং প্রাথমিকভাবে কারণ ও করনীয়গুলি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা।
(১) ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টিকারী আর.এন.এ. (রাইবো নিউক্লিক এসিড জেনেটিক উপাদান সম্পন্ন) ফ্ল্যাভি ভাইরাস (গোলাকার, ব্যাসার্ধ ৫০ ন্যানো গ্রাম) দের ধ্বংস করার মত কার্যকর ওষুধ বা ব্যবস্থার এখন পর্যন্ত অনুপস্থিতি।
Celgosivir প্রভৃতি Anti – viral drugs দিয়ে Clinical Trials আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। ২০১৫ তে ফরাসি ওষুধ প্রস্তুত সংস্থা ‘সানফি পাস্তুর’ তৈরি করেন ‘CYD –TDV’ ডেঙ্গু টিকা। ২০২৩ এ জাপানি ওষুধ প্রস্তুত সংস্থা ‘তাকেদা’ তৈরি করেন ‘QDENGA’ ডেঙ্গু টিকা। নিরাপত্তার ছাড়পত্র প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে এই দুটি টিকা ভারতে এখনও উপলব্ধ নয়।
(২) ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক (Vector) সংক্রামিত এডিশ মশা (প্রধানত Aedes aegypti, Aedes albopictus প্রজাতির) একটি ক্ষুদ্রাকৃতি (৪ – ৭ মিলিমিটার), হালকা (দুই মিলিগ্রাম), উড়তে সক্ষম, ক্রান্তীয় জলবায়ুতে (Tropical Climate) স্বচ্ছন্দ, সন্ধিপদী পতঙ্গ (Arthropod Insect) যারা সামান্য জল পেলেই দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। গাছপালা – ঝোপের মধ্যে; ঘরের জিনিসপত্র, পর্দা ইত্যাদির আড়ালে; অন্ধকার কোণে; আসবাবপত্রর তলা সহ বিভিন্ন জায়গায় সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। ফলে প্রকৃতি থেকে এদের নির্মূল কার্যত অসম্ভব।
এখন অবধি যতটুকু জানা গেছে বিবর্তনের (Evolution) পথ ধরে মানুষের পৃথিবীতে আগমন প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে। আর বিবর্তনের পথ ধরে মশার পৃথিবীতে আগমন প্রায় ২৩ কোটি বছর আগে। ফলে মানুষের চাইতে এই পৃথিবীকে ওরা বেশি জানে চেনে। পৃথিবীর প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সাথে অভিযোজন ক্ষমতাও ( Adaptation) বেশি। ২৫ +/- ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, ৮০ % আর্দ্রতা, মাঝেমাঝে বৃষ্টিপাত এবং ছোটো ছোটো অসংখ্য জায়গায় জল জমে থাকা (এমনকি গাছের পাতার ভাঁজে) তাদের বংশবৃদ্ধির আদর্শ পরিবেশ। এরা সাধারণত পরিষ্কার স্থির জলে ডিম পাড়ে। ৪০০ মিটারের মত উড়ে যেতে পারে এবং সমুদ্র স্তর থেকে ১০০ ফুট উচ্চতা অবধি সাধারণত বিচরণ করে। একসময় নগর কেন্দ্রিক থাকলেও এখন মানুষের সাথে ট্রেনে, ট্রাকে, বাসে, গাড়িতে চেপে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
(৩) মনুষ্যকৃত বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত শিল্পোন্নত এবং চীন, ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশগুলি কর্তৃক ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি, যথেচ্ছ বন ও বৃক্ষ সংহার, বিদ্যুৎ তৈরি থেকে যানবাহনে বিপুল পরিমাণ ফসিল ফুয়েল পোড়ানো, খোলামুখ খনি, বল্গাহীন নির্মাণযজ্ঞ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য সংস্থাপন প্রভৃতি কারণে সীমাহীন পরিবেশ দূষণের (Massive and Expanded Environmental Pollution) ফলে ধরিত্রীর জল বায়ু পরিবর্তন (Climate Change) ও বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global Warming) পরিস্থিতি এবং সেইজন্যে মশাদের শ্রীবৃদ্ধি ও বংশ বৃদ্ধি।
প্রতিনিয়ত জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও স্কান্দেনেভিয়ান দেশগুলি, সুইজারল্যান্ড, ইকুয়েদর, কোস্টারিকা, নিউজিল্যান্ড, জাপান, জার্মানি – কয়েকটি মাত্র দেশ ব্যা্তীত সার্বিক কোন সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরাও আমাদের চারিদিকে প্লাস্টিক সহ আবর্জনা ফেলে, সবুজ ধ্বংস করে, নদী – নালা – জলাভুমি বুজিয়ে, পাহাড় কেটে, বাধ দিয়ে, যত্রতত্র ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ও বাজার বসিয়ে এই কাজগুলিই করে চলেছি। এর পরিণামে যখন অপূরণীয় ক্ষতিগুলি নিজেদের ক্ষেত্রে হচ্ছে তখন অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছি অথবা দৈব ও নিয়তির দিকে ঠেলে হা হুতাশ করছি। অথচ আমাদের ঠিক বিপরীতটাই অনুশীলন করা উচিত।
(৪) আমরা ধর্মপ্রাণ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয়রা, বিশেষত উত্তর ও পূর্ব ভারতীয়রা, এবং তাদের মধ্যে প্রধানত শহরে বসবাসকারীরা যেমন পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতা সচেতন নই, তেমনই স্বাস্থ্য (Health) ও স্বাস্থ্যবিধি (Hygiene) সচেতন নই।
একদিকে আমরা যেমন সামগ্রিক পরিবেশকে প্রতিনিয়ত কলুষিত করে চলেছি, অন্যদিকে বিবিধ সংক্রামক রোগব্যাধির বাহক মশা, মাছি, আরশোলা, ইঁদুর, কুকুর, বিড়ালদের এবং তাদের বাসস্থান, বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র ও পাল (Colony) কে সঙ্গে নিয়ে চলেছি। ফলে আমাদের সমাজে এত জীবাণুর আধিক্য এবং তাদের দ্বারা এত রোগব্যাধির প্রকোপ। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও সঠিক প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমাদের পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্য বিধি সম্পন্ন হয়ে উঠতে হবে।
(৫) চূড়ান্ত প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও এডিশ মশার ডিমের টিঁকে থাকার ক্ষমতা (Desiccation)।
প্রবল দাবদাহ ও ঠাণ্ডা এবং সম্পূর্ণ শুষ্কতার মধ্যেও এডিশ মশার ডিম এক বছরের বেশি টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। তারপর সামান্য জল পেলেই একদিনের মধ্যে লার্ভায় রুপান্তরিত হয়। তাই শুধু জল জমা নিবারণই নয় প্রতিটি জলাধার ও জল রাখার পাত্র মাঝেমাঝে শুকিয়ে ভিতরের দেওয়াল বা গাত্র ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। সম্ভাব্য জল জমার জায়গাগুলি বর্ষার আগে জল বয়ে যাওয়ার ঢাল বজায় রেখে ভরাট করে (Landscaping and Land Filling) দিতে হবে। নিষ্কাশন ব্যবস্থার (Drainage System) ফাটলগুলি মেরামত করে, ঢাল (Slanting) বজায় রেখে, জমে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করে ময়লা জল যাওয়ার নাব্যতা (Flow) বজায় রাখতে হবে। ড্রেন ঢাকতে হলে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা খাল বা মূল ভূগর্ভস্থ ড্রেনে পড়ার আগে পুরোটাই ঢাকতে হবে। আংশিক ঢাকলে সেগুলির নিচের অংশ মশাদের থাকার ও বংশবৃদ্ধি করার নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠবে।
(৬) এডিশ মশার সংক্ষিপ্ত জীবন চক্র এবং দ্রুত বংশ বৃদ্ধি।
উড়ন্ত অবস্থায় (Swarming) পুরুষ ও স্ত্রী মশা সঙ্গমের (Mating) পর স্ত্রী মশার দেহে ডিম নিষিক্ত হয় এবং স্ত্রী মশা সেই ডিম পাড়ে। একবারের সঙ্গমের থেকে প্রাপ্ত পুরুষ মশার শুক্রাণু স্ত্রী মশা তার জীবিত অবস্থায় দেহের মধ্যে জমা রাখতে এবং বারবার নিষিক্ত করে ডিম পাড়তে পারে। স্ত্রী মশা একেকবারে কমপক্ষে ১০০ টি করে ডিম পাড়ে এবং তার তিন সপ্তাহের আয়ুষ্কালে অন্তত তিনবার ডিম পাড়ে। স্ত্রী এডিশ মশা খুব অল্প জলেই ডিম পাড়তে পারে। জলের উপরের স্তর লাগোয়া সামান্য উপরে পাত্রের দেওয়ালের গায়ে ডিম পারে। একরকম আঠার মত পদার্থ দিয়ে ডিম গুলি পাত্রের সাথে লাগানো থাকে। ডিম পাড়ার আগে স্ত্রী এডিশ মশার মানুষ বা পশুর রক্ত খাওয়ার প্রয়োজন হয়। স্ত্রী এডিশ মশা মানুষ ও প্রাণীর রক্ত খেয়ে এবং পুরুষ এডিশ মশা ফুল, ফল ও গাছের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। প্রধানত দিনে, ভোর ও বিকেলের দিকে বেশি, কামরায়। তাই এদের কামড়ের থেকে বাঁচতে দিনের বেলাতেও মশা প্রতিষেধক ব্যাবস্থা গুলি নিতে হয়।
নিষিক্ত ডিমগুলি জলের সংস্পর্শে এসে একদিনের মধ্যে শূককীটে (Larva) পরিণত হয়। শূককীটের আবার চারটি স্তর রয়েছে। প্রতিটি স্তরের পর শূককীটরা খোলস ছাড়ে (Moulting)। শূককীট অবস্থায় পাঁচ দিনের মত থেকে মূককীটে (Pupa) রুপান্তরিত হয়। সেই অবস্থায় তিনদিনের মত থাকে। তারপর উড়ে যায়। ডিম (Egg) থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা (Adult Mosquito) হতে মাত্র সাত থেকে ১০ দিনের মত লাগে। এডিশ মশার জীবনচক্র (Life Cycle) সংক্ষিপ্ত। অন্যদিকে তার বংশবৃদ্ধি দ্রুত ও ব্যাপক হারে। স্ত্রী এডিশ মশা মানুষের বসতির কাছাকাছি বা মধ্যে সাধারণত থাকতে পছন্দ করে। আর তাই মানুষকে বেশি কামড়ায় এবং তাদের দ্বারা মানুষ বেশি সংক্রামিত হয়। সেই কারণে জল জমতে না দেওয়ার পাশাপাশি ঘরের বাইরে ও ভেতরে পরিচ্ছন্ন এবং আলো – বাতাস যুক্ত রাখতে হয়।
(৭) যদি কোন স্ত্রী এডিশ মশা ডেঙ্গু সংক্রামিত ব্যাক্তির (Infected) দেহ থেকে রক্তপান করে ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী আর.এন.এ. ফ্ল্যাভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয় তাহলে সে তার সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল সংক্রামিত থাকে এবং তার ডিম থেকে জাত শত শত এডিশ মশাও জন্মসুত্রে (Congenitally through Vertical Transmission) এবং জীবনভর সংক্রামিত থাকে।
স্ত্রী এডিশ ইজিপ্টি বা অ্যালবোপিক্টাস প্রজাতির মশা সংক্রামিত মানুষের রক্তপানের পর তার দেহে একটি তারের (Single Stranded) আর.এন.এ. ফ্ল্যাভি ভাইরাস ৮ – ১০ দিনের মধ্যে বাহ্যিক জীবন চক্রের মাধ্যমে (Extrinsic Life Cycle) পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। একে জীবাণুর বাহ্যিক উন্মেষকাল (Extrinsic Incubation Period) বলে। ফ্ল্যাভি ভাইরাস মশার কোন ক্ষতি করেনা। ডিম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মশা খুঁজে পাওয়া ও ধ্বংস করা কঠিন, তাই লার্ভা স্তরে এডিশ মশা নিধন করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
এবার সংক্রামিত স্ত্রী এডিশ মশা যখন মানুষকে কামড়ায় (Bite) তখন ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টিকারী ফ্ল্যাভি ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে আভ্যন্তরীণ উন্মেষকালের (Intrinsic Incubation Period) পর্বে অসংখ্য প্রতিলিপি (Replication) সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ে ৪ – ৭ দিনের (সর্বাধিক ৩ – ১৪ দিন) মধ্যে রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে। মশার কামড় ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় মায়ের থেকে সন্তানের সংক্রমণ (Vertical Transmission) হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রামিত রক্ত দানের (Blood Transfusion) মাধ্যমে এবং ডেঙ্গু সংক্রামিত ব্যাক্তির থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন (Organ Transplantation) করলে ডেঙ্গু সংক্রমণ হতে পারে। গর্ভবতী নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে ও প্রতিষেধক ব্যাবস্থা গুলি নিতে হয়। রক্তদান ও প্রতিস্থাপনের আগে অন্যান্য পরীক্ষার সাথে ডেঙ্গুর স্ক্রিনিং পরীক্ষা করতে হয়।
(৮) কোন ব্যাক্তির এক ধরনের ডেঙ্গু হলে (Any Serotype from DEN V1, DEN V2, DEN V3, DEN V4 and DEN V5) পরেরবার সেই ধরনের বা অন্য কোন ধরনের অথবা দুই ধরনেরই ডেঙ্গু হতে পারে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে গুরুতর ডেঙ্গু (Dengue Haemorrhagic Fever or DHF) হওয়ার সম্ভবনা।
DEN V2 প্রজাতির (Serotype) সংক্রমণ বেশি দেখতে পাওয়া যায়। DEN V5 সংক্রমণ প্রায় পাওয়াই যায় না। ডেঙ্গুর আর.এন.এ. ফ্ল্যাভি ভাইরাসের দেহে তিনরকম প্রোটিনের (C, M, E) স্তর এবং স্তরহীন সাত রকম প্রোটিন (NS1, NS2a, NS2b, NS3, NS4a, NS4b, NS5) থাকে। NS1 পরীক্ষায় সংক্রমণের প্রথম দিন থেকেই পজিটিভ ফল আসতে পারে। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ৫ – ৭ দিন লাগে। প্রথমে IgM ও পরে IgG শ্রেণীর অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠে। এই ধরনের অ্যান্টিবডির দেহমধ্যে উপস্থিতি রোগাক্রমণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বহন করে।
তাই সংক্রমণের ক্ষেত্রে এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ELISA based NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়। আর ছয় থেকে দশদিনের মধ্যে MAC – ELISA অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়। প্রথমটি বাছার (Screening Test) এবং দ্বিতীয়টি প্রামাণ্য পরীক্ষা (Confirmatory Test)।
বিভ্রান্তিকর ফলের জন্যে Rapid Rest গ্রহণীয় নয়। ELISA হল Enzyme-linked Immunosorbent Assay। ১৯৭১ এ বিজ্ঞানী ইভা ইংভাল ও পিটার পার্লম্যান এই আধুনিক নির্ণয় পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। MAC – ELISA হল IgM Antibody Capture Enzyme-linked Immunosorbent Assay। পরীক্ষাটির নির্দিষ্টতা (Specificity) অনেক বেশি। এছাড়াও RT – PCR (Reverse Transcriptase – Polymerase Chain Reaction) ও Real Time R – T PCR কিংবা Virus Isolation & Virus Culture পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করা যায়।
গুরুতর ডেঙ্গুর (Dengue Haemorrhagic Fever or DHF) ক্ষেত্রে রক্ত ও অন্যান্য পরীক্ষা করে রোগের গতিপ্রকৃতি এবং দেহের ক্ষয়ক্ষতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় শ্বেত কণিকা (WBC or Leucocytes) কমে যাওয়া (Leucopenia with Relative Lymphocytosis) দেখতে পাওয়া যায়। তার সাথে ESR বেড়ে যায় এবং অণুচক্রিকা (Thrombocytes or Platelets) কমে যায়। AST সহ Liver enzymes গুলি বেড়ে যায়। C – Reactive Protein (CRP) এবং d – Dimer এর ফলাফল বেড়ে যায়। ঘটে রক্ত কোষ গুলির ঘনীভবন (Haemoconcentration)। Haematocrit Values (HCT) এবং রক্তের লোহিত কণিকা (RBC or Erythrocytes), Hb%, PCV (Packed Cell Volume), MCV (Mean Corpuscular Volume), MCHC (Mean Corpuscular Haemoglobin Concentration) ইত্যাদি গড়ে ২০ % এর মত বেড়ে যায়। অণুচক্রিকা কমতেই থাকে। এই সময় প্রতিনিয়ত HCT ও Platelet Count করা প্রয়োজন। HCT ৩ – ৪ ঘণ্টা পরপর করতে পারলে খুব ভাল।
(৯) ডেঙ্গু সংক্রমণের পর একেক ব্যাক্তির একেক রকম প্রতিক্রিয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণ উপসর্গহীন (Asymptomatic) হয়। প্রথমবার সংক্রমণ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever or DF) হয় যা নিজে থেকেই সেরে যায় (Self – limiting)। দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে সাধারণত গুরুতর ডেঙ্গু (DHF) হয় যা অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক রূপ নিয়ে সঙ্কটজনক ডেঙ্গু জ্বরে (Dengue Shock Syndrome or DSS) পর্যবসিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে যার ফলে মৃত্যু হতে পারে। আবার ডেঙ্গু সংক্রমণ জনসংখ্যার মধ্যে বেশি মাত্রায় (Endemic) থেকে যাওয়ার ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ অনেকসময় অন্যভাবে প্রকাশিত (Atypical Manifestations) হয়।
সাধারণত সংক্রামিত মশা কামড়ালে ৪ – ৭ দিনের মধ্যে (উন্মেষ কাল বা Incubation Period) রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ (Clinical Manifestations) প্রকাশ পায়। ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে দ্রুত লসিকা গ্রন্থিগুলিতে (Lymph Glands) ছড়িয়ে পড়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। তারপর বিভিন্ন রক্ত কণিকাকে আক্রমণ ও ধ্বংস করতে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের (DF) ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রবল জ্বর (High Grade Fever), প্রবল মাথা ব্যাথা (Severe Headache), চোখের পিছনে প্রচণ্ড ব্যাথা (Acute Retro Orbital Pain), গায়ে ব্যাথা (Myalgia), গাঁটে গাঁটে ব্যাথা (Arthralgia), গায়ে লালচে ছোপ (Erythematous Rashes), ক্ষুধামান্দ্য (Anorexia), বমি ভাব (Nausea), বমি (Vomiting) ইত্যাদি উপসর্গ (Symptoms) দেখা যায়।
ডেঙ্গু অন্য যে উপসর্গ গুলি (Atypical manifestations) নিয়ে উপস্থিত হতে পারেঃ রক্তক্ষরণ, ঝিমুনি, অস্থিরতা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, বারবার বমি, পেট ব্যাথা, চোখ মুখ ফুলে যাওয়া, মাথা ঘোরা, হাত পা ঠাণ্ডা হওয়া, কম প্রস্রাব হওয়া ইত্যাদি।
(১০) অনেক ভাইরাল রোগ একবার হলে দ্বিতীয়বার হয় না। কিন্তু ডেঙ্গু সংক্রমণ একাধিকবার হতে পারে। বরং পরবর্তী সংক্রমণ গুলিতে (Repeat Infections) সমস্যা ও জটিলতা অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে পরবর্তী সংক্রমণে অন্য ধরনের (Heterologous) ভাইরাসের প্রজাতির সংক্রমণের ফলে। যার পরিণতি হতে পারে DHF এবং DSS।
গুরুতর ডেঙ্গু জ্বরের (DHF) ক্ষেত্রে সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলি ছাড়াও পেট ব্যাথা (Pain Abdomen), অস্থিরতা (Restlessness), সুস্পষ্ট লাল ছোপ (Petechiae & Purpura), শ্বাসকষ্ট (Respiratory Distress), পাতলা পায়খানা (Diarrhoea), রক্তক্ষরণ (Haemorrhage), খিঁচুনি (Convulsion), নেতিয়ে পড়া (Fatigue), অজ্ঞান হয়ে (Unconscious) যাওয়া ইত্যাদি ঘটে। অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাধারণত জ্বর শুরুর পর (Fever Stage) চতুর্থ দিন থেকে জ্বর কমে গিয়ে (Defervescence) এই সঙ্কট পর্বের (Critical Stage) সূত্রপাত হয়। এই সময় রক্ত নালীগুলি থেকে রক্ত চুয়ে বেরতে থাকে (Capillary Permeability), দেহের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরীক্ষা করলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া (Cold clammy skin), দুর্বল দ্রুতগামী নাড়ি (Rapid weak pulse), রক্তচাপ কমে যাওয়া এবং উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপের পার্থক্য কমে যাওয়া (Hypotension & Narrowing of Pulse Pressure), ফুসফুসের আচ্ছাদনে ও পেটে জল জমে যাওয়া (Pleural effusion & Ascites), প্রস্রাব কমে যাওয়া (Anuria) ইত্যাদি লক্ষণগুলি (Signs) দেখা যায়। Tourniquet Test অর্থাৎ কোন রবারের ব্যন্ড দিয়ে (ওয়ার্ডে রক্ত নেওয়া বা ফ্লুইড চালানোর সময় ব্যাবহার হয়) বা স্টেথোস্কোপ দিয়ে আরও নির্দিষ্টভাবে রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের কাপড় (Cuff of B.P. instrument) Systolic ও Diastolic Blood Pressure এর মাঝে পাঁচ মিনিট ফুলিয়ে (Inflated) রেখে দিলে চামড়ায় ২.৫ বর্গ সেন্টি মিটার (এক বর্গ ইঞ্চির মত) জায়গায় ১০ টির বেশি লালচে ছোপ পাওয়া যাবে। এই সময় রক্তক্ষরণ ও রক্তকোষগুলির ঘনীভবন (Haemoconcentration) হতে থাকে এবং রক্তের অনুচক্রিকা কমতে থাকে।
সংকটজনক ডেঙ্গু জ্বরে (DSS) উপসর্গগুলি বিশেষ করে রক্তক্ষরণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে রোগী একেবারে অচেতন অবস্থার দিকে (Coma) চলে যায় । দেহের প্রধান অঙ্গগুলি একে একে অকেজো হতে থাকে (Multi Organ Failure)। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ (Comorbidities) থেকে থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। জটিলতাপূর্ণ ও বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যাযুক্ত এই ধরনের ডেঙ্গুকে Expanded Dengue Syndrome বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিশেষে মৃত্যু ঘটতে পারে।
(১১) ডেঙ্গুর নতুন সংক্রমণের অ্যান্টিজেন এবং আগের সংক্রমণের ফলে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি র বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় (Cross reaction) রোগের মাত্রা, ব্যাপকতা ও জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
পরবর্তী সংক্রমণে আগের সংক্রমণজনিত T Cell mediated Antibody র সাথে নতুন সংক্রমণের অ্যান্টিজেনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে। শারীরিক প্রতিরোধ ব্যাবস্থা (Immune System) বহিরাগত ভাইরাসগুলিকে চিহ্নিত করে (Opsonization) Monocytes, Macrophases প্রভৃতিদের মাধ্যমে গিলে খেয়ে (Phagocytosis) নিষ্ক্রিয় করতে চায়। এর ফলে অনেক সংক্রামক ও অন্যান্য কোষের মৃত্যু (Apoptosis) ঘটে। শুরু হয় Antibody Dependent Enhancement (ADE) এর কর্মকাণ্ড। দেহের প্রতিরোধ ব্যাবস্থার অংশ Dengue virus infected Monocytes, T-lymphocytes প্রমুখ বিশেষ করে Complement Products যার মধ্যে Cytokines, Chemokines ইত্যাদি রয়েছে, দ্রুত ও প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হতে থাকে। অন্যদিকে অবশিষ্ট সংক্রামক ভাইরাসগুলি প্রতিলিপি (Replication) করে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলে। তার প্রতিক্রিয়ায় Cytokines এর ঝড় সৃষ্টি হয় (Cytokine Tsunami)।
এমনিতে Cytokine এর প্রদাহ সৃষ্টিকারী ভুমিকা প্রমাণিত। এবার তার ঝড়ের ফলে দেহের রক্তনালী গুলির Endothelial Cells ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে Endothelial Glycocalyx এরও ভূমিকা থাকে। ক্রমশ রক্তনালী গুলিতে ছিদ্র হতে থাকে। রক্তনালীর মধ্যে থেকে রক্তরস (Plasma) এমনকি রক্ত কোষ (Blood Cells) চুয়ে (Capillary Permeability) বাইরে বেরিয়ে আসে (Leakage)। এই কারণে Haemorrhage, Pleural Effusion, Ascites, Haemoconcentration ইত্যাদি ঘটে। Thromboplastin Time বেড়ে যায়, Fibrinogen Concentration কমে যায়। রক্ত কণিকা গুলিও সংক্রামিত হয়, ধ্বংস হতে থাকে অণুচক্রিকা গুলি (Platelets)। রক্তনালী গুলি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় (Vasculopathy)। রক্ততঞ্চন ব্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায় (Coagulopathy)। রোগী বিধ্বস্ত (Shock) হয়ে পড়ে। দেহস্থ প্রধান অঙ্গগুলি (Vital Organs) অকেজো হয়ে পড়ে (Failure)।
(১২) ডেঙ্গুর জীবাণু, রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ, ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া এবং তাদের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন (Dynamism) সম্বন্ধে অনেক চিকিৎসক, নার্সিং কর্মী এবং স্বাস্থ্য কর্মী ওয়াকিবহাল নন। তাদের অনেকেরই হালফিল প্রশিক্ষণের (Updated Training) ব্যবস্থা করা যায়নি।
সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে রোগীকে বিশ্রামে রাখতে হবে। দিনে তিন থেকে পাঁচ লিটার জল পান করতে হবে। ফলের রস, প্রয়োজনে ও.আর.এস. খেতে হবে। খাদ্য হবে সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর। ঠাণ্ডা বা ঈষৎ উষ্ণ জল দিয়ে গা মোছা যেতে পারে। ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশি জ্বর হলে প্যারাসিটামল দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে সাধারণত হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়না। অন্য একটি মত সমস্ত ডেঙ্গু রোগীকেই হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হবে।
গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে এবং পর্যাপ্ত ফ্লুইড দিতে হবে। ডেঙ্গু নিরাময়ের নির্দিষ্ট কোন ওষুধ না থাকায় উপসর্গের চিকিৎসা (Symptomatic Treatment), Fluid Management এবং Life Support চিকিৎসার তিনটি প্রধান দিক। রক্তের মত (Isotonic) এবং একই বিনিময় ক্ষমতা সম্পন্ন (Iso – osmolar) ফ্লুইড দিতে হবে (NaCl, Ringer Lactate, Balanced Crystalloid)। রক্তচাপ খুব কমে গিয়ে শক হলে Colloid (Dextran) দিতে হবে। রোগীকে সবসময় নজরদারিতে (Monitoring) রাখতে হবে। ১০% এর বেশি অথবা বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হলে Blood Transfusion এর ব্যাবস্থা করতে হবে। অণুচক্রিকা কমে গেলে Platelet Transfusion করতে হবে।
ফ্লুইড দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিমাপের জন্যে Holleday – Segar Formula:
রোগীর ওজন ১০ কিলো গ্রাম এর কম হলেঃ ১০০ মিলি লিটার প্রতি কিলো গ্রাম ওজনে।
রোগীর ওজন ১০ – ২০ কিলো গ্রাম এর মধ্যে হলেঃ ১০০০ মিলি লিটার + ৫০ মিলি লিটার প্রতি কিলো গ্রাম ওজনে ১০ কিলো গ্রাম এর বেশি ওজন থেকে।
রোগীর ওজন ২০ কিলো গ্রাম এর বেশি হলেঃ ১৫০০ মিলি লিটার + ২০ মিলি লিটার প্রতি কিলো গ্রাম ওজনে ২০ কিগ্রার কিলো গ্রাম এর বেশি ওজন থেকে।
সংকটজনক ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ফ্লুইড থেরাপির পাশাপাশি Oxygen Therapy, Airway Management, Mechanical Ventilator, Catheterization প্রভৃতি র ব্যাবস্থা করতে হবে। Infectious Ward এর ICU বা ITU তে ভর্তি রেখে ভাল করে নজরদারি ও যত্ন করতে হবে। বারবার HCT, Platelet Count করে দেখতে হবে। রক্তক্ষরণ না থাকলে Platelet Count ১০০০০/ মিলিমিটার৩ এর নিচে পৌঁছলে Platele Transfusion করতে হবে। ১০ % এর বেশি রক্তক্ষরণ হলে কিংবা উপর্যুপরি বা টানা শকের (Refractory Shock) পরিস্থিতি হলে Packed Red Cell Transfusion করতে হবে। রক্তক্ষরণের সাথে Coagulopathy থাকলে Fresh Frozen Plasma / Cryoprecipitate Transfusion করতে হবে।
ডেঙ্গু রোগ থেকে আরোগ্যর পর্বে (Recovery Phase) Overhydration প্রধান সমস্যা। তাই IV Fluid খুলে ফেলা হয় অতিরিক্ত ফ্লুইড যাতে দেহ ধীরেধীরে শুষে (Absorb) নিতে পারে।
(১৩) প্রতিবিধান নিয়ে দেশের কর্মনীতি প্রস্তুতকারকরা (Policy Makers) যা নিদান দেন বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ করে উঠতে পারেন না। আবার যারা করতে সক্ষম তারা করেন না।
Remote Sensing পদ্ধতিতে মশাদের বাসস্থান চিহ্নিত করে তাদের ড্রন ইত্যাদি দিয়ে ধ্বংস করা, Integrated Vector Management, মশার জিন পরিবর্তন, মশার প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া, শব্দ তরঙ্গ দিয়ে মশাকে বিপথগামী করা, ডেঙ্গুর টিকা তৈরি করা ইত্যাদি আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে বহু চর্চা হলেও এগুলি উপলব্ধ নয়।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের National Vector Borne Disease Control Programme (NVBDCP) এর নির্দেশিকা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করা যেতে পারেঃ
ক) জ্বর হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেখান ও রক্ত পরীক্ষা করুন। সময় মত চিকিৎসা না করলে গুরুতর ডেঙ্গু রোগে প্রাণসংশয় হতে পারে।
খ) মশাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমবেতভাবে সমগ্র এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখুন, জল জমতে দেবেন না। কোথায় জল রাখার প্রয়োজন হলে ঢাকা দিয়ে রাখুন এবং / অথবা সাতদিনে একবার জমা জল পালটে ফেলুন।
গ) নির্মীয়মাণ ও পরিত্যাক্ত গৃহ, বাজার, গ্যারেজ, শোকপিট, গাটার, ড্রেন, ডাস্ট বিন ইত্যাদির প্রতি বিশেষ নজর রাখুন। প্রয়োজনে ঢাকনি বা নেটের ব্যাবস্থা করুন। মশার লার্ভা দেখতে পেলে ২% পাইরেথ্রিয়াম ইত্যাদির অথবা হরবাল স্প্রে করে বিনাশ করুন। জল জমার গর্ত গুলি জমির ঢাল রেখে বুজিয়ে ফেলুন।
ঘ) এলাকার জলাশয় গুলি সংরক্ষণ ও সংস্কার করুন। সেখানে মশার লার্ভাভুক গাপ্পি ও গাম্বুসিয়া মাছ ছাড়ুন। যেখানে সম্ভব সাঁতার কাটা, নৌকো চালানো বা রটেটর চালানোর ব্যাবস্থা করুন।
ঙ) বাড়ির চারপাশ, ছাদ, ড্রেন এবং বাড়ির মধ্যেটা পরিষ্কার রাখুন। কোথাও জল জমতে দেবেন না। জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার ও ঢেকে রাখুন। চৌবাচ্চা, ড্রাম, বালতি, ফুলদানি, এয়ারকুলার, পশু পাখির খাবার জায়গা ইত্যাদি মাঝেমাঝে শুকিয়ে পরিষ্কার করুন।
চ) দিনে ও রাতে ঘুমনোর সময় মশারি ব্যাবহার করুন। শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীদের নিরাপত্তার (Protection) বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
ছ) ঘরের বাইরে সুতির ফুলশার্ট, ফুলপ্যান্ট, মোজা ও ঢাকা জুতো ব্যাবহার করুন। মহিলারাও ঢাকা পোশাক এবং ঢাকা জুতো – মোজা পরুন। ঘরের মধ্যেও সুতির ঢাকা পোশাক পরুন।
জ) ঘরের মধ্যে আলো বাতাস ঢোকার ব্যাবস্থা রাখুন। ভোরে ও সন্ধ্যায় মশা চলাচলের সময় কিছুক্ষণ দরজা জানালা বন্ধ রাখুন। মশা তাড়ানোর জন্যে নিম কেক, সিট্রনেলা তেল প্রভৃতি ব্যাবহার করুন।
“ আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে। …” বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমুল্য শিক্ষাকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
————————
০৮.০৩.২০২৪