বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে একটা উনিশ বছরের মেয়ে ভর্তি হলো, মেয়েটি মাঝেমাঝেই দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো, কখনো সে দীর্ঘ কিছু ঘন্টা অজ্ঞান থাকে… অজ্ঞান অবস্থায় মাঝেমাঝে চোখ দিয়ে জল পড়ে, কোনো সাড়া দেয় না, যখন জ্ঞান থাকে তখনও বিশেষ কথা বলে না, খাওয়াদাওয়া করে না…. অসুখের কোনো “organic” কারণ পাওয়া যায়নি, পুরোটাই মানসিক উদ্বেগ থেকে, আর সেই জন্যই psychiatry ward-এ ভর্তি! এসব অসুখের ক্ষেত্রে যেটা হয়, তা হলো মনের অবচেতনে এমন কোনো অবদমিত আবেগ থাকে যা আমাদের সচেতন মন জানতে পারে না, অথচ এই অবদমিত আবেগ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ হয়ে ধরা দেয়…! এই অবদমিত আবেগ বা conflict খুঁজে বের করতে পারলে চিকিৎসায় অনেকটাই সুবিধে হয়। আমরা সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম!
এরপরে জানতে পারি, মেয়েটি সদ্য মা হয়েছে, তার কয়েক মাসের একটি কন্যা সন্তান আছে… মেয়েটির জন্মের পরে থেকেই এই উনিশ বছরের কিশোরী মা অসুস্থ হয়ে পড়ে… মেয়েটি তার শিশুকন্যাকে পর্যাপ্ত স্তন্যপান করাতে পারছে না! এবার চিত্র ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করলো… মেয়েটি জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি… সে “ভালো মা” হতে পারেনি। যতদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো মেয়েটির সাথে তার মা বা শাশুড়ি মা পালা করে থাকছিলেন… তাদের পিছনে আমার জীবনের বেশ কিছু ঘন্টা ব্যয় করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম – যে মেয়ের তো মা হওয়ার বয়স-ই হয়নি আর আপনারা সারাদিন “মেয়ে বাচ্চাকে রাখতেই পারছে না” বলে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবেন না! নইলে কিন্তু মেয়ে অজ্ঞান-ই থাকবে!
স্বাভাবিকভাবেই আমার এই জ্ঞানের বাণী তাদেরে কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না! মেয়ে হয়ে জন্মেছে, মা তো হতেই হবে, তাও হয়েছে একটা মেয়ের মা, সেটাও নয় মেনে নিলাম, তাই বলে, “বাচ্চাকে দুধ দিতে” পারবে না, বাচ্চাকে সামলাতে পারবে না?? বাচ্চা কোলে ধরিয়ে দিলেই অজ্ঞান হয়ে যাবে! একি আহ্লাদ??
যাই হোক এরপরে যখন round-এ গিয়েছি, দেখেছি সেই এক দৃশ্য! মা এবং শাশুড়ি মা আমার রুগীর ভালো মা হতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে রুগীর পাশে বসে… এবার দিলাম একজনকে বের করে… সিস্টারকে বলে এলাম যেকোনো একজন ভিতরে থাকবে, এতো গল্প ওর কানের পাশে বসে করা যাবে না… এরপরে ওষুধে, ইনজেকশন-এ মেয়েটা উঠে বসলো… কিন্তু বিশেষ কথা বললো না… অপুষ্টিতে ভোগা, উনিশ বছরের কিশোরী মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো… বাড়ির লোক ছুটি করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো… ছুটি হয়ে গেলো! সেই রুগী বাড়ি ফিরলো!
এর একমাস পরে আমার on call ডিউটিতে রাধারাণীর ওয়ার্ডে কল পেলাম… রাধারাণী বেশ অদ্ভুত একটা ওয়ার্ড, অনেক সময় সেখানে call পেলেও, রুগী খুঁজে পাওয়া যেত না! যাক সে গল্প অন্য দিন হবে – সেদিন খুঁজে পেলাম আমাদের পনেরো দিন ধরে সুস্থ করা রুগী আবার অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে….
তার মা আমায় দেখে চিনতে পেরে ছুটে এলো… এসে হাত-পা নেড়ে যেটা বললো সেটা হলো, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরে কিছুদিন মেয়েটি ভালো ছিলো, তারপরে তারা মেয়েকে বাচ্চা সহ শশুরবাড়িতে পাঠিয়ে ছিলেন… যথারীতি মেয়েটি বাচ্চা, সংসার, শশুড়বাড়ির চাপ একসাথে নিতে পারেনি … তার সচেতন মন, অবচেতনের কাছে আত্মসমর্পণ করে আশেপাশেরে চূড়ান্ত demanding জাগ্রত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে সে আবার অচেতন হয়ে গিয়েছে!!
তারপরে আবার সে পেশেন্ট ভর্তি হয়, আবার আমাদের দশ, পনেরো দিনের প্রচেষ্টায় ছুটি হয়ে বাড়ি যায়… এরপরে শুধু একবার OPD তে দেখেছিলাম তাকে… ওর বাবা নিয়ে এসেছিলো, কথা বলেছিলো একটা দুটো, ডিপ্রেশন তখনও ছিলো…. তারপরে আর সেই রুগীকে আমি ফিরে পাইনি… আমার আর জানা হয়নি মেয়েটি “ভালো মা” হতে পেরেছিলো কিনা, অথবা এই “ভালো মা” হওয়ার মানসিক চাপ-কে উপেক্ষা করে ভালো থাকতে পেরেছিলো কিনা!