এমবিবিএসের ফাইনাল ইয়ার পাশ করেছি। ইন্টার্নশিপ চলছে তখন। সবারই মোটামুটি এরকম একটা ধারণা ছিল, কয়েকটা ইমার্জেন্সি ডিউটি উতরে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। ডাক্তারির অনেকটাই শেখা হয়ে যায়। হয়েও গেল। আমরা কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ইমার্জেন্সির রাত জেগে ফেললাম। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভ হ’ল। যে কোনও নাইট ডিউটিতে রাত দেড়টা-দুটোর দিকে একবার ঘুম পায়। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলে তিনটে-সাড়ে তিনটের দিকে আর একবার প্রবল ঘুম পায়। চোখের পাতা জুড়ে আসে। তখন মেডিক্যাল কলেজের দু’নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এককাপ কড়া চা খেতেই হয়। চোখ লাল, চুল উস্কোখুস্কো, গলা শুকনো। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটে। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ যায়। কখন ন’টা বাজবে? নতুন আর একদল এলে আমাদের ছুটি! সে রাতজাগা চোখ বোধহয় চাতককেও হার মানায়। কোনোমতে ডিউটি বুঝিয়ে টলতে টলতে হোস্টেল ফিরি। পাঁচ নম্বর গেট পেরিয়ে মেইন বয়েজ হস্টেল। ফিরেই কোনোমতে একটু খেয়ে সোজা বিছানায়। দুপুরে কখন ঘুম ভাঙবে ঠিক নেই! ইমার্জেন্সির ডিউটি কষ্টকর হলেও মজা ছিল ষোলআনা। সেই প্রথম নিজের হাতে চিকিৎসা করতে শেখা। অসহ্য পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য হরেক কিসিমের সমস্যা নিয়ে যে রোগীরা আসতেন তাঁদের একটু উপশম দিতে পারলে মনে মনে কাঁধের ওপর ডানা গজাতো। কেউ দুটো ভালো কথা বললে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তাম। দুঃখ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা… বয়সের নিয়মে সবই বড্ড প্রকট তখন। সবকিছুতেই চড়া আবেগ।
যাক সে কথা। যে কথা বলবো বলে আজ ট্যাপটেপিয়ে লিখে চলেছি, সেটাই বলি। এরকমই বর্ষার দিন। ইমার্জেন্সি ডিউটি উতরে দেওয়া ‘বড় ডাক্তারেরা’ চললেন তারকেশ্বর গ্রামীণ হাসপাতাল। কমিউনিটি মেডিসিনের পোস্টিং। যদিও আউটডোরে বসে সব ধরনের রোগীই দেখতে হবে। হাওড়া থেকে ট্রেন। তারপর স্টেশনে নেমে অটো। তখন তারকেশ্বরে জল ঢালার সময়। ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা নেই। একটু অসতর্ক হলেই জল নিয়ে যাওয়ার বাঁকে লেগে আহত হওয়ার সম্ভাবনা। তার ওপর পুণ্যার্থীদের লাগামছাড়া উশৃঙ্খলতা। ট্রেনে ওঠার আগে বাঁকটা এগিয়ে দিয়ে দোলাতে থাকে। যাতে সামনে কেউ থাকলেও সরে যেতে বাধ্য হন। কেউ আহত হলেন কিনা সেসব জানতে তাদের ভারী বয়ে গেছে। এ বৃত্তান্ত আর দীর্ঘ করবো না। আসল কথায় আসি। ওখানেই হাসপাতালের কোয়ার্টারে আমি আর বন্ধু অদ্রীশ কয়েকদিন ছিলাম। রোজ এই কষ্টকর যাত্রা পোষাচ্ছিল না। আউটডোরে নিয়মমাফিক হাতে গোনা কিছু ওষুধ। প্যারাসিটামল, সেট্রিজিন, ওআরএস, ক্যালামাইন, পারমেথ্রিন লোশন… এইসব দু-একটা ওষুধ লিখে মনে মনে কলার তুলে দিচ্ছি। মনে আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস। সব রোগ সারিয়ে দেবো!
অনেকগুলো বছর কেটেছে। গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়েছে। এখনো রোগী সেরে উঠলে আগের মতোই আনন্দ হয়। ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের জায়গায় সাবধানী চাউনি এসেছে। এর মধ্যে আরও বেশ খানিকটা পড়াশোনা করা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই মনে হয়, আসলে শিখেছি যৎসামান্য। না শেখার ভাগটাই বেশি। প্রতিদিন পড়তে না বসলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। একটা জিনিস প্রায় মন্ত্রের মতো মানি, ‘নট আ সিঙ্গল ডে উইদাউট আ লাইন’। জুনিয়রদের পড়াতে ভালো লাগে। এখন যে হাসপাতালে কাজ করছি, সেখানে পিডিয়াট্রিক্সের হাউসস্টাফ এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনি ডাক্তাররা আছে। তাদের পড়াতে গিয়ে নিজেরও নতুন করে একবার ঝালাই হয়ে যায়। যে কোনও কারণেই হোক, জুনিয়ররা বলে, দাদা (খুব ছোটরা স্যার) তোমার দিনের রাউন্ড বা ওপিডি মিস করা যায় না। এতদিন সেটা অতিশয়োক্তি বলেই ভাবতাম। আজ আমার ডিউটি আছে বলে একজন বাড়ি যাওয়া বাতিল করে থেকে গেছে, এটা জানার পর অবাকই লাগছে। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। জীবনের কোনও মুহূর্তই হারায় না। হয়তো সময়ের ধুলো লেগে এককোণে পড়ে থাকে। ধুলো সরালে আজও মুহূর্তের গায়ে আবেগের সাতরঙ। তাতে অল্প বয়সের জোরালো আঁচ নেই। ধিকি ধিকি আঁচে অভিজ্ঞতার থকথকে অধঃক্ষেপ।
আজ সবকিছুতেই ভালো লাগার দিন। এগারো-বারো বছরের যে মেয়েটা এতদিন পারতপক্ষে বাইরে কোথাও যেতে পারতো না, ভালো করে স্নান করতো না সে এখন নির্ভয়ে আইসক্রিম খায়। ওর সাংঘাতিক অ্যালার্জিক রাইনাইটিস আর শ্বাসকষ্টের ধাত ছিল। মাস কয়েক চিকিৎসার পর অনেক ভালো আছে। মা জানিয়েছেন, “মেয়ে এখন পড়তে যাওয়ার আগে আপনার চেম্বারে উঁকি মেরে যায়। আপনি থাকলে ওর মনের জোর বেড়ে যায়।” লেখাটায় বড্ড বেশি ‘আমি-আমি’ গন্ধ লাগছে কি? লাগলে লাগুক। নার্সিসিস্ট বলবেন? সে বলুন। ভালো কিংবা খারাপ, বহুদিনই আর অন্যের মূল্যায়নে বিহ্বল হই না। এই ঘটনাগুলো তো মিথ্যে নয়। এই লেখাগুলোরও পাঠক মূলত আমিই। নিজের জন্যই মুহূর্তগুলো বাঁচিয়ে রাখি নাহয়…
এর মধ্যেই কাশীনাথ এসে গেছে। কাশীনাথ এগারো মাসের শিশু। খুব কাশিতে ভোগে। কাশীনাথের ঠাকুমার সাথে ‘তুমি’র সম্পর্ক। “ভালো করে একটু ওষুধ দাও তো দেখি বাবা… নাতিটা এত ভোগে যে কেন…” হাসতে হাসতে বলেছি, “বুঝলে ঠাকুমা, এই কাশীনাথ নামটাতেই যত গন্ডগোল। নামেই তো কাশি আছে। ওটা আগে বদলে সূর্যনাথ করতে হবে। তবেই সূর্যের তাপে কাশি পালাবে।”
সবাই মিলে একচোট হেসে ফেলি।