রূপকথার গল্প তো কম বেশি সবাই জানি বা পড়েছিও। এ গল্পটা অনেকেই হয়তো জানেন। বিশেষতঃ যাঁরা একটু আধটু বিদেশী লেখকদের লেখা বই পড়তে ভালোবাসেন, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখা গুলো পড়েছেন, এবং শেষমেশ যাঁরা একটু সিনেমা বা এই জাতীয় বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান!
না, আমি তেমন বই পড়ুয়া নই। সিনেমা নিয়ে কলেজ লাইফে বেশ খানিকটা সময় কেটেছে বটে। তখন বেশিরভাগ ব্যাপার গুলো পরেরদিন সকালে হাওয়া হয়ে যেত!
তবু আমার মতো অনেকেরই জানার কথা বা পড়ার কথা। কারণ, এই চরিত্রটি যদিও বা তৈরি হয়েছিল ১৮৮৩ সালে, একটি নভেলের সৌজন্যে, কিন্ত তারপর সে প্রায় দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন।
আশা করি, সবাই মোটামুটি টিনটিন-এর কথা জানেন। কি অসম্ভব মাতামাতি ছিল টিনটিন নিয়ে!
এক সম্রাট অব্দি নাকি বলে বসেছিলেন- তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী টিনটিন!
কিন্ত অতটা না হলেও, এই চরিত্রটিও একটি রূপকথার মতো নভেলেরই চরিত্র। যতদূর মনে পড়ে – ছোটবেলায় আমাদের আশেপাশে এই চরিত্র নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। না হওয়ার একটা বড় কারণ হয়তো- ভাষার সমস্যা। কিন্ত খোঁজ নিলে জানা যাবে- তাঁকে নিয়ে যা মাতামাতি হয়েছে বিদেশে, সেটা বাস্তবে কোন মানুষকে নিয়ে হওয়া সম্ভব নয়! সিনেমা নাটক- কি না হয়েছে তাঁকে নিয়ে!!
শেষ অব্দি ডিজনি ও অ্যানিমেশন ফিল্ম বানিয়েছে! এবং সেই ফিল্ম সম্ভবতঃ ডিজনির প্রথম দু’টো সৃষ্টির মধ্যে একটি! যাঁরা দেখেছেন- তাঁদের দ্বিমত হবার জায়গা নেই!
চরিত্রের স্রষ্টা ইতালিয়ান কার্লো কল্লোডি। সাল ১৮৮৩।
চরিত্রের নাম আশা করি বুঝে গেছেন এতোক্ষণে।হ্যাঁ, এক এবং একমাত্র পিনোচ্চিও (Pinocchio)।
হঠাৎ এই চরিত্রটি নিয়ে পড়ার একটা কারণ আছে। ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম- ভাবছিলাম বলার চাইতেও খুব মানসিক চাপে ছিলাম কিছু জিনিস ভেবে। বলেই ফেলি- আমার আশেপাশের কিছু মানুষকে, যাঁদের আমি সাধারণত আড়ালে আবডালে ফলো করি (আজকাল টোলের শিষ্য হবার তো চল নেই, তাই ফলো করি বললেই বোঝা যায় ফেবু বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের লেখা বা আঁকা বা গান ও অন্যান্য সৃষ্টিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। অবশ্যই লুকিয়ে। আমার বোঝার ক্ষমতা সীমিত। তাই সে চেষ্টা কোন কাজে লাগে না!), সেইসব মানুষদের কিছু অদ্ভুতুড়ে ব্যবহার তথা লেখালেখি বা মন্তব্য আমাকে প্রচণ্ড রকম আঘাত দিয়েছে।
এবার সে সব নিয়ে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক আর অযথা তাঁদের বিরক্ত করতে চাই না বলেই হোক- আমি চুপ থেকে গেছি। যেমন সব সময়েই চুপ থাকি। কিন্ত চুপ থাকা মানে তো আর চুপ থাকা নয়, নিজের ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন উঠতে থাকে। অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। জবাব পাই না!
যাইহোক, আসল কথা বলি। কিছু লেখাপড়া জানা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, হ্যাঁ যথারীতি তাঁদের নামীদামী ডিগ্রীও আছে, পেশাদার হিসেবে সফলতাও বেশ ঈর্ষণীয়, জ্ঞানের দিক থেকেও সমীহ করার মতো , তাঁরা এমন কিছু কথা বলছেন বা লিখছেন, সেগুলো না সত্যি, না তাতে কোন বাস্তবতা আছে, না সেগুলো অনুকরণীয়!! বরং সেগুলো দিনের আলোয় দেখলেই বোঝা যায়- মিথ্যা, কুৎসা অথবা জাস্ট এক ধরনের ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশন।
এবার বাঙালি জাতি (ভারতীয় হিসেবে বললেও একই ব্যাপার!) হিসেবে সবদিনই আমরা সাধারণতঃ আইডল ক্রাইসিসে ভুগি। মানে আইডল যতক্ষণ সবদিক থেকে ভালো, ততক্ষণ মাথায় তুলে রাখি, যেই না কিছু একটা বিগড়ে গেল, অমনি তেড়ে খিস্তি দিই, সঙ্গে সঙ্গে অন্য আইডলের খোঁজে লেগে পড়ি!!
আমারও হয়েছে খানিকটা সেই অবস্থা! কিন্ত এ বিষয়ে আমি অন্যদের মতো আইডল খোঁজার চেষ্টা ও করিনি, কিংবা গালাগালিও করিনি। আমি খালি বোঝার চেষ্টা করছি- রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, প্রাত্যহিক জীবনের নানা ছোটখাটো ঘটনাকে নিয়ে ও কেন সেইসব মানুষগুলো এ রকম নির্লজ্জের মতো মিথ্যাচার করে চলেছেন?? কারণ কি?? হঠাৎ এরকম ভাবে ভাবার কারণ কি? চিন্তা ভাবনা জ্ঞানের এহেন দৈন্যতা এইসব মানুষদের!!!
এতোদিন এনারা তো এমন ছিলেন না! হ্যাঁ, দেখছি বটে- বেশ কিছু লাইক বা লাভ ইমোজি পাচ্ছেন, বেশ কিছু কমেন্ট পাচ্ছেন প্রশংসার, সাথে দু’একটা সত্যিকারের সুতীক্ষ্ণ খোঁচাও- কিন্ত তাঁরা দিনকে দিন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন!!
প্রশংসাসূচক কমেন্ট আর লাইক বা লাভ ইমোজির জন্য এহেন নেশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়া তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি মানুষকে নিয়ে আমার মতো সাধারণ মানুষদের সত্যিই খুব সমস্যা এখন। আরো বড় সমস্যা- এনারা লোকসমাজে বলে বেড়াচ্ছেন- যে আমি ভাই কারো মনে করার দায় নেবো না! কোন কথা নয়! তোমার পছন্দ না হলে, তুমিই ফোটো!! সঙ্গে দু’চারটি অতীব সুপাঠ্য বা সুশ্রাব্য গালিও দিতে ছাড়ছেন না!! খানিকটা রোদ্দুর রায়ের মোক্সা খিস্তি কালচার বলা যায়!! একের পর এক মিথ্যাকে সত্যি বলে এবং উল্টোটাও প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন!
এ বিষয়ে স্বনির্বাচিত কিছু তথ্য এবং ব্যাখ্যাও কাজে লাগাচ্ছেন!! ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন! নতুন নতুন তথ্যকে সত্যি বলে মেনে নিচ্ছেন!! মেনে নিতে বলছেন!! বিশেষতঃ রাজনীতি নিয়ে তো যা ইচ্ছে খুশি বলছেন!!
আমার মতে, ইতিহাসের এ এক সন্ধিক্ষণ! কারণ, প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন তথ্যের আমদানি আর পুরানোকে অস্বীকার করার যে ঘৃণ্য চেষ্টা করে চলেছেন এইসব শিক্ষিত মানুষেরা, (অশিক্ষিত তিনি যত সচেতনই হোন না কেন , ইতিহাস বিকৃত করা তাঁদের কাজ নয়!) কুযুক্তির অবতারণা করে যেভাবে ইতিহাসকে আঙ্গুলের ডগায় নাচাতে চাইছেন, তার সাথে একমাত্র তুলনীয় হতে পারে – জর্জ অরওয়েলের নভেল 1984-এর গল্পের প্লট!!
মনে করে দেখুন- সেখানেও ঠিক একই কাজ করা হয়েছিল! ক্ষমতার অঙ্গুলি লেহনে সেখানে তৈরি করা হয়েছিল এমন এমন সব নিয়ম কানুন, যা আসলে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের মেরুদণ্ড যে শিক্ষা তাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট!!
ঠিক একই ভাবে এইসব শিক্ষিত মানুষেরা, (জানি না এরকম বিধ্বংসী খেলায় এনারা কেন মেতেছেন!!) নতুন নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করে ছেড়ে দিচ্ছেন!! এমন এমন তথ্য নিয়ে পাতি অশিক্ষিত মাথামোটা রাজনৈতিক দলের মাতাল চ্যালা চামচাদের মতো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছেন, ভয় পেয়ে যাচ্ছি! সন্দেহ করে ফেলছি- এনাদের আমি বা আমরা এক সময় আইডল ভাবতাম?? সত্যিই তো??
এনারা বাংলার ভারতের পৃথিবীর ইতিহাস তো পড়েছেন!! নতুন তথ্য পেয়ে সেই ইতিহাস বিকৃত করতে লেগেছেন কেন?? কিসের স্বার্থে??
যদ্দুর জানি- এনাদের টাকা পয়সা ইনকাম করার জন্য এসব করার দরকার হবে না! (অবশ্য আমি আমার মতামত বলতে পারি!) রাজনীতিবিদরা যা ইচ্ছে খুশি করুন, তাঁদের বলা না বলায় সত্যিকারের ইতিহাসের এক কণা ও পাল্টায় না, কিন্ত এনারা কেন?? কিসের লোভ?? একি সেই perpetual war-এর প্লট তৈরি করা নয়??
জানি না।
যাকগে, যেটা বলতে এলাম, পিনোচ্চিও। সে ছিল একটি পাপেট। কাঠের তৈরি। যেহেতু রূপকথার ব্যাপার, তাই তার মানুষের মতোই সব ক্ষমতা ছিল, এবং সে গল্পে আসলে জীবিত একটি পাপেট!!
এর কথা মনে পড়ে গেল এই কারণে যে- এতো বিখ্যাত পিনোচ্চিও-র কিন্ত একটা খারাপ দিক ছিল।
কি সেটা? না, তার বদভ্যাস ছিল মিথ্যা বলার!!
কিন্ত এই মিথ্যা বলার জন্য তার একটা শাস্তিও ছিল!!
কি সেই শাস্তি?? অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে হোক- যখনই সে মিথ্যা কথা বলতো, তার নাকটা ইঞ্চিখানেক বড় হয়ে যেত!! ভাবুন কি ভয়ানক ব্যাপার!!
কিন্ত সে মিথ্যা না বলে থাকতে পারতো না! তাই একসময় তার নাক এতো বড় হয়ে গেল যে, সে ঘরে থাকলে নাক বাইরে চলে যেত!!
মনে পড়ছে, আমাদের ছোট বেলায়ও শুনতাম বড়রা ভয় দেখাতো, মিথ্যা বললে নাকের ডগায় বিষফোঁড়া হবে!! ভয় পেতাম!!
এবার আমি আসলে ভয় পাচ্ছি!
এনাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরা, এরকম ক্রমাগত মিথ্যা বলে চলায়, এনাদের মিথ্যার দ্বারা আমার মতো বহু অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকদের মগজ ধোলাই হতে দেখে ভয় পাচ্ছি!! নিজের জন্য নয়, ভয় পাচ্ছি এনাদের জন্য! যদি এনাদের নাকও অমনি করে বেড়ে যেতে থাকে প্রতিটি মিথ্যা বলার পর??বেড়ে না যাক, যদি কাটা যায় প্রতিবার?? যদি এনারা আর কোনভাবেই সমাজে রূপকথার হিরোর মতো সম্মান না পান?? যদি আমার মতো তুচ্ছ ফলোয়ার রা জেনে ফেলেন যে ইনি মিথ্যা বলেছেন, সেই কারণে নাক বড় হয়ে গেছে বা কাটা পড়েছে?কি হতে পারে এই দেশ এই সমাজের ভবিষ্যৎ??ভাবতেই ভয় পাচ্ছি।
ভয় পাচ্ছি- কাল সকালে হয়তো দেখবো আরেকটি মিথ্যাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করতে নেমেছেন! অন্যের থেকে কুযুক্তি ধার করছেন!
ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির থেকে পাওয়া এডিট করা তথ্য নিয়ে চুড়ান্ত অসভ্যের মতো চিৎকার করছেন!
হয়তো দেখবো- মিথ্যা বলার অপরাধে, সত্যের অপলাপ করার অপরাধে এনাদের নাক, ক্রমশঃ বড় হতে হতে পেরিয়ে গেছে ঘর দোর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে ও ডাস্টবিনের দিকে!
এতো মিথ্যার দায় এনারা শোধ করতে পারবেন?নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস ধ্বংসের দায় এনারা শোধ করতে পারবেন??
মনে হয় না।
গল্পের পিনোচ্চিও, একদিন ভালো ছেলে হয়ে উঠেছিল!!
আমার খুব ভয় লাগছে- এনারা সত্যিই আর কেউ শেষ পর্যন্ত পিনোচ্চিও হয়ে উঠতে পারবেন কিনা!নাকি এক একটি শিক্ষিত, ধূর্ত, মিথ্যাবাদী বিখ্যাত পাপেট হয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন??
পিনোচ্চিও-র পুনর্জন্ম হয়েছিল! এনাদের হবে তো??
সব ইতিহাসের কিন্ত পুনরাবৃত্তি হয় না!!
ভালো লেখা।