মাঝে বেশ কিছুদিন বিরতির পরে আবার একটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করেছি। সরকারি হাসপাতালে টানা কিছুদিন কাজ করলে হাঁসফাঁস করে। রোগীর চাপ তো থাকেই কিন্তু সেটা বড় ব্যাপার নয়। আসল জিনিস হ’ল সবকিছুর অপ্রতুলতা। যেদিকে তাকাই, নেই আর নেই। অর্ধেকের বেশি প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই। সব ধরনের পরীক্ষা করানোর উপায় নেই। যন্ত্রপাতি নেই। স্থায়ী চিকিৎসক-নিয়োগ শেষ কয়েক বছরে হাতেগোনা। কম বেতনের ঠিকে-ডাক্তার দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা চলছে।
তবে সবকিছুর মাঝে একটা জিনিসের জন্যই সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে ভালো লাগে- এখানে গল্প তৈরি হয়। জীবনের গল্প। সেইসব জীবন যারা ঝকঝকে চেম্বারের ‘দামী চিকিৎসা’র সাথে এঁটে উঠতে পারে না। অধিকাংশই পাড়ার ওষুধ দোকান বা এরওর পরামর্শে ‘ঘেঁটে যাওয়া’ রোগ নিয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছোয়। সীমিত সামর্থ্যে সেসব রোগ ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি। রোগটুকুই ছুঁই। রোগী ছোঁওয়া হয় না। ঠোঁটের কোণে ঘা দেখে রোজ ফল খাওয়াতে বলি। ফল কেনার খরচ কত, মনে আসে না। সারা গায়ে চুলকুনি ভরে থাকা বাচ্চাটাকে শুধু ঢিলে সুতির জামা পরাতে বলি। মনে পড়ে না, ওর বছরে একবারই জামা হয়, পুজোর সময়। দশ মাসের বাচ্চা শুধু *মুল দুধ খেয়ে বড় হয় আর দিনের পর দিন শুকিয়ে যায়। যত শুকোয় তত মাদুলির ওজন বাড়ে। কপালে কাজলের টিপ বড় হয়। তিন কেজি বাচ্চার গায়ে পাঁচ কেজি মাদুলি। খাওয়া-দাওয়া ঠিক করার পরামর্শ দিয়ে আসি। পয়সা খরচ করে প্যাকেটের হাবিজাবি গুঁড়ো খাবার কিনতে বারণ করে আসি। হয়তো বাচ্চাটা ভালো হয়ে যাবে। বুঝতে পারবো না, কোন সামাজিক পরিস্থিতিতে থাকলে লোকে অস্থিচর্মসার বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে না এনে মাদুলিওয়ালার কাছে দোষ কাটাতে নিয়ে যায়। আন্দাজই করতে পারবো না, কেন জন্ডিস নিয়ে ভর্তি থাকা বাচ্চাটার গলায় জন্ডিসের মালা, পেটে জন্ডিস কাটানোর পোড়া দাগ। ওই যে বললাম, শুধু রোগটুকুই ছুঁই। রোগ সারে ঠিক। রোগী সারে কি?
ইদানিং খুব বেশি লিখি না। বয়স বাড়লে প্রাথমিক উদ্যমে মরচে পড়ে। একটা সময় মনে হ’ত কলমের আঁচড়ে সব পরিবর্তন করে ফেলবো। এখন বুঝি, সেসব সদ্য-পাশ ডাক্তারের ইউটোপিয়া। বেশ জানি, কিছু নিস্ফল চেঁচামেচি ছাড়া কিছুই করে উঠতে পারবো না শেষমেশ। সব কেমন নিয়মের মতো হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু এখনো মন খারাপ করায়। উদ্বেল করায় না। আগেরদিনই ইমার্জেন্সিতে পৌঁছোনোর মিনিট কুড়ির মধ্যে বছর চারেকের বাচ্চাটা মারা গেল। উঁচু থেকে পড়ে গিয়েছিল। যখন হাসপাতালে এসেছে তখন দমকা দেওয়া শেষ শ্বাস চলছে, চোখের মণি স্থির, কুঁচকে ছোট হয়ে গেছে। হয়তো তার কয়েক মিনিট আগেই ফুটফুটে মেয়েটা খেলে বেড়াচ্ছিল। জীবন কী সস্তা, না?
শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের একটি ক্লিনিকেও মৃত্যুর গল্প। বছর দশেকের মেয়েটার উচ্চতা বাড়ছে না। এ হেন টনিক আর ভিটামিন নেই, যে খায়নি। অথচ একবার ভালো করে চোখে দেখলেই সমস্যাটা বোঝা যায়। পরীক্ষার পরে থাইরয়েডের সমস্যা নিশ্চিত করা গেছে। ওষুধ শুরু হয়েছে। বছর পনেরো-ষোলোর দাদার সাথে এসেছিল। কথায় কথায় দাদার কাছে জানলাম, ভরা কোভিডের সময় তাদের মা মারা গেছে। অনাক্রম্যতার রোগ ছিল। কোলকাতায় চিকিৎসা হ’ত। কোভিডের জন্য কোলকাতা যাওয়া সম্ভব হয়নি। রোগ বেড়েছে। শেষ অবস্থায় হাসপাতালেও ভর্তি করা যায়নি। ওই বাড়িতেই যেটুকু… মা মারা যাওয়ার পরে সব কিছুতেই অবহেলা হয়েছে। বোনকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। বলতে গিয়ে ছেলেটার চোখ ছলছল করছিল কি? কে জানে… বাইরে লম্বা লাইন। এতকিছু ভাবলে চলে নাকি? রোগী ছোঁওয়া বাকি থেকে যায় বারবার।
অনেকদিন লিখি না। অনেক কথা জমেছে। কাকে ছেড়ে কার কথা লিখি? ওই যে তিন বছরের বাচ্চাটার পেট ব্যথার সমস্যা নিয়ে দাদু-দিদা নিয়ে এসেছিলেন, তার কথাই বা ভুলি কি করে? সামান্য পেটে ব্যথার ইতিহাস বলতে গিয়ে কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নাকি? বিস্ময় আর সন্দেহ নিয়ে তাকিয়েছিলাম। পরবর্তী মিনিট পাঁচেক এত দীর্ঘ হবে ভাবিনি। বাচ্চাটার বাবা রাজমিস্ত্রী। নির্মীয়মান উঁচু বাড়ির কাজ করছিলেন। ভারা থেকে পড়ে… গতকালই… তিন বছরের ছেলে বাবাকে শুধু দেওয়ালের ছবিতেই চিনবে।
রোগী দেখতে বসা আসলে সিনেমা দেখার মতো। শুধু পরপর দুটো দৃশ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। হঠাৎ করেই কেন জানিনা, লোকজন এখন খুব ফাইমোসিস নিয়ে পড়েছে। মানে, ছেলে বাচ্চাদের পুরুষাঙ্গের সামনের অংশটা পাতলা চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকার ব্যাপারটা। একটা বয়স অব্দি এটা একদম স্বাভাবিক। পরের দিকে ধীরে ধীরে চামড়াটা খুলে আসে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই)। কার পরামর্শে জানি না, সবাই এখন দু-তিন মাস বয়সের বাচ্চারও চামড়া না খোলার ব্যাপারে চিন্তিত। বিভিন্ন ধরনের তেল দিয়ে দিন-রাত মালিশ চলছে। তার মধ্যেই একজনের দাবী বাচ্চার ‘ওটা’ খুব ছোট। শেষ ট্রেন ধরার মতো তাড়াহুড়োয় প্যান্ট নেমে গেল। যদিও দেখলাম, ‘ওটা’ এমন কিছু ছোট নয়।
– আসলে ডাক্তারবাবু ওটাই তো আসল জিনিস তাই দেখিয়ে নিচ্ছি। ছোট হলে তো মুশকিল।
– না, না। ছোট নয়। এই বয়সে এইটুকু হলেই কাজ চলে যাবে।
আশেপাশে হাসির ধুম নেমেছে বুঝতে পারছিলাম। যদিও ভদ্রমহিলা থামতে রাজি নন।
– দেখুন, ক’বছর বাদে বৌমা আসবে। আসল জিনিস ঠিক করে রাখতেই হবে।
এসব সময়ে মাস্ক খুব কাজে দেয়। চোখে চশমা, মুখে মাস্ক। অভিব্যক্তির অধিকাংশই বাইরে থেকে দেখা যায় না। স্টেথো নামিয়ে টেবিলে রাখি। আরও একটা দিন শেষ হয়ে যায়। ঝুড়ি ঝুড়ি গল্পের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরি। চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে সন্ধ্যাতারায় চোখ রাখি।
বি.দ্র.- ছবির সাথে লেখার কোনও সম্পর্ক নেই। বৃষ্টি নামার আগের আকাশ দেখতে সবারই খুব ভালো লাগে নিশ্চয়ই। তাই দিলাম।