প্রথম পর্ব
(কিছু মাত্র না জেনে গ্রাম্ভারি প্রবন্ধ লেখার জন্য আমার বিশেষ দুঃখ্যাতি আছে-এখেনেও তাই হয়েছে। দয়াবান পুণ্যবান ভাগ্যবান মশাইরা মাফ করে দেবেন)
হাতুড়ের হাসি
শ্রাবণী অমাবস্যার সন্ধ্যা। পাশেই ইলামবাজারের জঙ্গল। একটা ভাঙাচোরা পুরোনো হিজিবিজি গাছ গজানো পুরোনো কালী মন্দির। নাম ডাকাতে কালী মন্দির। ডাকাতরা ডাকাতি সাকসেস হলে’ এখেনে নরবলি আর পুজো দিতো। এ্যাখন জঙ্গল কেটে সার্ফ। মানুষেরা চারপাশে আবার সবাই ভীড় করে’ আজ সন্ধ্যায় রীতিমতো জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছে। হাতুড়ে ওর পাশে একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া পানবিড়ির দোকানের ভিৎরবাগে বসে’ বিজবিজ করে’ ঘামছেন আর বিড়ি ফুঁকছেন। পটলা বাংলুর বোৎল নিয়ে আসবে। ঐ যে-বলতে না বলতেই পটলা প্যান্টে জামায় গুঁজে গুঁজে বোতল নিয়ে এলো। হাতে একটা ‘ছোলা-চ্যাপ্টা’র প্যাকেট। পকেট থেকে পেলাস্টিকের গেলাস বার করে’ জল এবং বাংলার মেশাল দিচ্ছিলো। হাতুড়ে বললেন “ঐ দ্যাখ পটলা কতো হলুমান….”
পটলা আড়নয়নে চেয়ে দেখলো। বেশ কিছু লোক বসে আছে। কেউ অন্যের উকুন বাছছে। কেউ খ্যাঁশখ্যাঁশ করে’ গা চুলকোচ্ছে। ছোটো (সাইজে) হলুমানগুলোর কিছু ঘুমোচ্ছে, কিছু আবার কামড়াকামড়ি -চ্যাঁচামিচি এইসব করছে।
এরপর একপাল সুসজ্জিত গন্ধগোকুল মানুষ প্রসাদ ভর্তি চ্যাঙারি হাতে গুমটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। ব্যাস, ঐ জানোয়ার সদৃশ জন্তুগুলো স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে দৌড়ে প্রসাদ কাড়ার জন্য কাড়াকাড়ি করতে লেগেছে। একটা খালি গা, হাফ প্যান্ট ঢ্যাঙ্গা দেড়েল জানোয়ার বসে’ বসে’ জানুসন্ধি চুলকোচ্ছিলো সে এ্যাক চ্ছুটে একটা খিচুড়ি ভর্তি চ্যাঙারি নিয়ে দ্দে দৌড়।
হাতুড়ে হাসলেন “ফিটেস্ট অভ সার্ভাইভাল”
বাংলা ভাসে চোখের জলে
টাপুর টুপুরবৃষ্টি পড়ার আওয়াজ পেয়ে হাতুড়ে দ্যাখেন বাংলার গেলাসে পটলার দু চোখ দিয়ে টপটপ করে’ জল পড়তে লেগেছে।শ্রাবণী অমাবস্যা ফোঁস করে’ একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসে কিছু শুকনো পাতা উড়িয়ে দ্যায়।
“হাতুড়েকা (রাঢ়বাংলার মানুষজন কাকাকে সংক্ষেপে কা বলে)তুমি ভগমানের তৈরি ঐ মানুষগ্যুলাঁকে হলুমান বৈললে?”
“আহা হলুমান তো আমাদের পূর্বপুরুষ রে।একটা জিন ডিলিটেড হলেই তুই আবার হলুমান হয়ে যাবি। যা ওদের গিয়ে বল তোমরা ভগমানের তৈরি…..”
পটলা বলে “তাপ্পর কামড়ায়্যেঁ দিলে?দ্ধো,যত্ত আলটুস ফালটুস কথা….মানুষ তো ভগমানের তৈরি গ্য। তুমি ফুক্কুড়ি দেওয়া কৈরছোঁ বটে”
হাতুড়ে কিছুক্ষণ টাক চুলকে’ বলেন “ভগমান? কোন ভগমান?”
“কুন ভগমান ইটোর মানে কী?”
“দ্যাখ পটল, খেষ্টানদের মানে একেশ্বরবাদী ইব্রাহিমীয় ধর্মে সৃষ্টির গল্প এভাবে বলে, সমুদ্র, আকাশ, পাখি এবং প্রাণী এবং অবশেষে, আদম(প্রভু তৈরি করেন)। অধ্যায় ২, শ্লোক ৭; পড়: প্রভু ঈশ্বর মাটির ধূলিকণা থেকে মানুষ তৈরি করেছিলেন এবং তার নাকের মধ্যে জীবনের শ্বাস ফুঁকেছিলেন এবং মানুষ হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত আত্মা। হাওয়া আদমের পাঁজর থেকে তৈরি হয়েছিল।
তারপর একটি ধূর্ত সর্প ইডেনে প্রবেশ করে এবং আসল পাপ একটি নিখুঁত বিশ্বকে দাগ দেয়।
যদিও যীশুকে ঈশ্বরের প্রকৃত পুত্র বলা হয়।” (গুগল অনুবাদ)
পটলা খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ঈষৎ লবণাক্ত বাংলু খেয়ে বলে “বুইঝতে লারলাম গ্য”
“তাহলে এবার ইসলামের গল্পটা শোন
“কোরান বর্ণনা করে কিভাবে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন: “আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি শব্দযুক্ত কাদামাটি থেকে, আকৃতিতে ঢালা কাদা থেকে…” (১৫:২৬)। এবং, “তিনি কাদামাটি থেকে মানুষের সৃষ্টি শুরু করেছেন এবং তার বংশধর তৈরি করেছেন তরল পদার্থ থেকে” (৩২:৭-৮)। সুতরাং, পৃথিবীর সাথে মানুষের একটি মৌলিক সংযুক্তি রয়েছে।
যদিও ইভের সৃষ্টির বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়নি, কোরান এটা স্পষ্ট করে যে আদমের সাথে একই প্রকৃতি এবং আত্মা থেকে একটি “সঙ্গী” তৈরি করা হয়েছিল। “তিনিই আপনাকে একক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার সঙ্গীকে সদৃশ প্রকৃতির তৈরি করেছেন, যাতে তিনি তার সাথে প্রেম করতে পারেন” (৭:১৮৯)। কোরানে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু ইসলামী ঐতিহ্যে তাকে “হাওয়া” (ইভ) বলা হয়।”(গুগল অনুবাদ)
পটলা গোলগোল চোখে একটু পান করে। তারপর বলে “তা’লে বাকি ধর্মরা কী বুঁল্যা করে?”
“সব তো জানি না রে। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ধর্ম আছে তো। তবে হিন্দুধর্মের ব্যাপারটা সমস্কৃত বুঝি বলে’ একটু বোঝাতে পারবো”
“তো ব্যুঝাও ক্যানে”
ভাগবত পুরানে বলে পৃথিবীর আদিতে পৃথিবীতে শুধু জল ছিলো। সেখানে বলেছে আপ এব সসর্দাদৌ। সেই জলের মধ্যে বিষ্ণু শায়িত ছিলেন। ওনার নাভি থেকে উৎপন্ন হলেন ব্রহ্মা। তিনি ফের আকাশ, বাতাস, সপ্তদীপ্তা বসুন্ধরা, স্বর্গ, অসুর টসুর সৃষ্টি করে ভাবলেন এবার কটা মানুষ তৈরি করা যাক। উনি তখন সাতটা ঋষি তৈরি করলেন-মানে সপ্তর্ষি। কিন্তু তারা শুধু বসে’বসে’ তপস্যা করতে লাগলো। তখন তিনি ওদের আকাশে তারা বানিয়ে দিয়ে শেষে সায়ম্ভুব মনু আর শতরূপাকে তৈরি করলেন। ওরাই প্রথম নরনারী।”
পটলা মাথা চেপে’ ধরে বললো “সব কিছুই পৃথিমির কাদা ত্থে এয়েছে। আমার মাথার ভিৎরে ক্যামন বগবগ কৈরতে লেগেছে। তা’লে আমি কুথাকে এলম? ঐ কাদা মাটি না মনু? এর মধ্যি ভগমান কুথাকে এলো?”
ভাঙা বুদ্ধিজীবী
“হাতে বাংলুর বোতল মুখে প্রশ্ন!আত্মণাং বিদ্ধি। তুই তো বুদ্ধিজীবী হয়ে গেলি রে পটলা। ভগমান সব তৈরি করেছে এটা কে বলেছে? যখনই কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে বা উচ্চ বংশের বিরুদ্ধে, তখনই তার মুখ বন্ধ করা হয়েছে। সে নিষাদ সন্তান একলব্য, হোক, ঢাকার মসলিন শিল্পী হোক বা কোপার্নিকাস, গ্যালিলেই, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল যেই হোক। সব ধর্মেই বলে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, কেউ বলে সাত ঘোড়ার রথে, কেউ বলে এমনি এমনি। তার বিরুদ্ধে যেই গ্যাছে সে শেষ। সাদাচামড়ারদের দেশে বা এদেশে। তাহলে নতুন বোতল খোল – এবার মানুষ কোত্থেকে এলো সেটা বলা যাক।”
(ক্রমশঃ)