শ্রীমান যাজ্ঞবল্ক্য আচার্য তার কোম্পানি থেকে একটা স্ট্রিকচার খেয়েছে।
এ লাইনে বহুদর্শী সিনিয়ার বাবলুচন্দ্র বিশী, ধাপে ধাপে উঠে রিজিওনাল ম্যানেজার এখন। লাইনের অন্যরা তাঁকে আর বাবলুদা’ বলে না। ডাকে মিস্টার বিসি বিশী বলে। ফাজিলেরা বলে বিসিদা’।
হাসাহাসিও করে ওই বিসি কথাটা নিয়ে।
বাবলুচন্দ্র সদাশয় মানুষ। রাগ করেন না।
স্ট্রিকচার খাবার পর ওই তাঁর কাছেই গিয়েছিল জগু মানে আমাদের যাজ্ঞবল্ক্য। শুনেটুনে বাবলুদা’ বললেন, ‘সব্বোনাশ! করেছ কী হে ছোকরা! কোনওদিন কোম্পানির ভালো চেয়ে কিচ্ছুটি করতে যেও না। তলার লেভেলে আমাদের নিরীহদের দেখছ বটে, ওপরতলার লোকগুলো মানে ওই মালিকশুদ্দু সব জাত সাপ। এই কথাটা হাড়ে হাড়ে জেনে রেখো।’
জগু মস্ত ওষুধ কোম্পানির নিম্নবর্গের এমআর। পড়েছে ধর্মসঙ্কটে। না না, প্রচলিত অর্থে ধর্মসঙ্কট বলতে যা বোঝায় তা নয়। পড়েছে ধর্ম সংক্রান্ত সঙ্কটে। ব্যাপারটা খুলে বলি।
এমনিতে শ্রীমান যে খুব ধার্মিক বা ধর্মবৎসল… আদৌ তা নয়। বিশেষত ঘোর আমিষাশী এই ছোকরা পর্ক আর বিফে ভারি আসক্ত। দধিকর্মার দই চিঁড়েতেও আপত্তি নেই। পুজোয় হাঁ করে প্যান্ডেল দেখে, মহরমের তাজিয়া দেখে, ক্রিসমাসের ঝুলন খেলা দেখে। অথচ বিশ্বাসে প্রায় নাস্তিক।
ঈশ্বরের দেখা পায়নি অ্যাদ্দিন। এই চাকরিটা পাবার পরে অবশেষে ঈশ্বররূপী পে প্যাকেট আর ইনসেন্টিভের দেখা পেয়েছে সে। এরই ভরসায় তার প্রাইভেট ঈশ্বরী বুঁচি মানে বনলতাকে ঘরে আনবার বাসনা বেচারার। তার মধ্যেই এ কী ফ্যাঁকড়া!
ওষুধ কোম্পানি ডাক্তারদের গিফট দেয়। এই গোপন তথ্য আপামর জনগণ জানে। কেন দেয়, কখন দেয়, কীভাবে দেয়, কী কী দেয় সেই সব বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। রোগী, তার বাড়ির লোক, বস্তুত আপামর জনগণ, সবাই কম বেশি সবাই জানে।
জগুকেও তার লিস্টে থাকা ডাক্তারদের ওজন বুঝে, কোম্পানির পাঠানো উপহার দিয়ে আসতে হয়। গিফটের ছদ্মবেশে ব্যক্তিগত চাওয়াও মেটাতে হয় কখনও। টেক স্যাভি ডাক্তারকে পেনড্রাইভ, পাওয়ারব্যাঙ্ক থেকে ল্যাপটপ, শৌখিন বৌ-ওয়ালা ডাক্তারকে দামি পর্দা-বেডশিট, লেডি ডাক্তারকে কসমেটিকস… থাক সেই অনন্ত লিস্টের কথা।
বরং এইবারের কথা বলি। কালীপুজোর গিফট পাঠিয়েছে কোম্পানি। দুই কিসিমের।
মাটির তৈরি মানে মিট্টিকা দিয়া দিতে হবে তেমন বড় নয় এমন ডাক্তারদের। আর ব্রোঞ্জ নাকি কাঁসার প্রদীপও এসেছে। সেটা দিতে হবে নামী প্র্যাকটিশনারদের। সেই হিসেবে লিস্টের ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে দামি ডাকতার মুহাম্মদ আনসারউদ্দিন মোল্লা। এমআরসিপি। ঘণ্টায় দশ বিশ হাজার টাকার ওষুধ লেখেন।
এই সব ডাক্তারদের আসল দাবীদাওয়া ট্যাকল করে উঁচু লেভেলের কেউ। শুধু এই প্রদীপ-টদীপ বিলি করতে হয় জগুকে। সেই করতে গিয়েই মস্ত ভুল করে ফেলেছে সে। আর সেই ভুলটিই কানে উঠেছে মালিক পক্ষের। যাজ্ঞবল্ক্য কালীপুজোর প্রদীপ দিয়ে এসেছে সেই আনসার ডাক্তারকে।
জগু ধম্মোকম্মো নিজে তো মানে না। মানলে জানত, এই দেশে কী কী বারণ। এই ২০২৩ সালেও। কড়া সনাতনী হলে আরবি নামের ছায়া মাড়ানো নিষেধ। পুজো-আচ্চায় মোচলমানের হাত লাগলে অশুদ্ধ। আবার সে রকম মুমিন হলে, পুজোর প্রসাদ খাওয়া যাবে না। নামাজের সময় ঢাকের বাদ্যি শুনলে দোজখ-বাস অনিবার্য।
এই ডাঃ আনসারউদ্দিন, গিফট দেবার পরে ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে খোদ কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে নালিশ করেছে, মুসলমান ডাক্তারকে কালীপুজোর গিফট দেবার এই অনাচারের কথা। যাজ্ঞবল্ক্য শো কজের চিঠি খেয়েছে কাজে কাজেই।
অভিযোগ তিনটে।
প্রথম দুটো চিঠিতে লেখা। তিন নম্বর অভিযোগ আর অনুযোগটা? একটু পরে বলছি।
একনম্বর অভিযোগ, সহজ ও সরল।
সে কেন ডাক্তারবাবাবুর ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রদীপ সহযোগে আঘাত দিয়েছে? ঘোর অন্যায় সেটা!
দ্বিতীয় অভিযোগটা অর্থনৈতিক। কেন সে এত দামি উপহারটা কোনও সনাতনী ডাক্তারকে নরম করার কাজে ব্যবহার করেনি। তাহলে তো কোম্পানির প্রেসক্রিপশন বাড়ত। আর আনসারুদ্দিনও ক্ষেপে গিয়ে প্রেসক্রিপশন কমানোর হুমকি দিত না।
এবারে তিন নম্বর, মানে সেই ফোনটা।
তৃতীয় ধমকটা এল ফোনে। গুজরাট থেকে কোম্পানির মালিক বিপুলভাই মোদি নিজে ফোন করে বলল, যাজ্ঞবল্ক্য বিধর্মী ডাক্তারকে মিট করছে করুক। ব্যবসায় ওসব দেখলে চলে না। পয়সার গায়ে ধর্ম লেগে থাকে না। সে তো এদেশের সব চেয়ে বড় বিফ এক্সপোর্টার তার মাসতুতো ভাই। ধর্মে ইয়ে। সে গোরুর মাংস সেল করে। প্রশ্ন সেটা না। প্রশ্ন হল, জগু তার সঙ্গের ব্যাগে গঙ্গাজল ক্যারি করে তো?
প্রশ্নের উত্তরে তো তো করছিল জগু। কড়া নির্দেশ এল তারপরই।
সেই রকম চেম্বারে ঢোকার পরে বেরিয়ে সে যেন অবশ্যই গায়ত্রী জপ করতে করতে দু ফোঁটা গঙ্গাজল দিয়ে ব্যাগটা শুদ্ধ করে নেয়।
জগু নেটে দেখেছে কোন এক ডাক্তার নাকি দাতা হর্ষবর্ধন হয়ে বলেছেন তাঁর গিফট পাওয়া প্রদীপ তিনি দান করতে চান। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে। স্পষ্টতই ধর্মীয় নিষেধের জন্য তিনি এই প্রদীপ নিজে ব্যবহার করবেন না। মাজারে বা অন্য ধর্মস্থানেও না।
হ্যাঁ, জগু জানে তিনি মাজারে যান। দরগায় যান। গেলে মোমবাতি জ্বালান। চিরাগও। যেহেতু তিনি সার্জেন, রোগীর পেট কেটে সেখানে রাখা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপেও অরুচি নেই তাঁর। অরুচি নেই আজমীঢ় শরিফ থেকে আনা মিছরি দানাতেও। নিষেধ শুধু পুজোর প্রসাদে।
সেই রকম কোনও মাজারে বা দরগায় তিনি এই প্রদীপ মোমবাতি অনায়াসে জ্বালাতেই পারতেন। কিন্তু যেহেতু পুজোর নামে উচ্ছুগ্য করা সেটি তিনি কিছুতেই করবেন না।
জগু এত সব কঠিন হিসেব বোঝে না। চাকরিটা টেকানো তার অতি দরকার। নইলে অপেক্ষা করে থাকা বনলতা ক্রমে ছায়ালতা হয়ে যাবে। তাই সে এসেছে সার্কিটে বিসিদা’ নামে পরিচিত এই ধুরন্ধরের কাছে।
বিসিদা সমস্তটা শুনে বললেন, ‘দোষ করল কোম্পানির পারচেজ অফিসার আর এসে পড়ল তোর ঘাড়ে।’
‘পারচেজ অফিসার আবার কী দোষ করল, বিসিদা?’
‘আরে, পারচেজ অফিসার খেয়াল করবে না, গিফট পারচেজ মানে ডাক্তার পারচেজ করার মেটেরিয়াল কোথায়, কোন জিনিস, কী ভাবে করবে?’
এই বলে নেট খুলে দেখাল দাদা। ‘দ্যাখ, এই সাইটে পরিষ্কার লেখা মুসলিম ডাকতারকে কী গিফট দিবি কোত্থেকে আর অন্যদেরই বা কী দিবি।’
দেখল জগু।
কোম্পানি পলিসি চেঞ্জ, সে ভারি কঠিন ব্যাপার। বিসিদা একটা শর্টকাটও বাতলে দিল।
সেই মত জগু বরং এর পরে পাড়ার জগদম্বা বাসনালয়ে গিয়ে এই দামি প্রদীপ বদলে নিয়ে সস্তা চিনামাটির কাপপ্লেট কী আর কিছু নিয়ে নেবে। সেটাই দেবে।
দোকানের রতন কাকু এটুকু হেল্প কি করবে না? হাজার হলেও রতন কাকুই তো বুঁচির মামা!
★