সচরাচর দেরি হয় না আমার তবে গতকাল বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। আর মাঝরাত্তিরের ইমার্জেন্সিতে হাসপাতালে অনেক সময় যেতে হয় বলে, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার অভ্যাস বরাবর।
সদ্য কেনা একটি ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তাই কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল করতে পারিনি।
“আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবি বাড়িতে?”
“না বাবা। এখনি একটা ইমার্জেন্সি পেশেন্ট ভর্তি হল। অপারেশন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ফিরতে আমার রাত হবে।”
“বুঝতে পারছি। তবু চেষ্টা করিস। ডাক্তারদের জীবন তো এমনই। পরিবারের জন্য কোন সময় থাকে না।”
চুপ করে রইলাম। বুঝতে পারলাম অন্য প্রান্তে বাবা ধীরে ধীরে ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন ।
আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের ভিতরে জমে থাকা রাতের অন্ধকারকে, জানালার শার্সিতে জড়িয়ে থাকা রাস্তার নিওন, সর্বদাই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় আমার বেডরুমে। যেন সবসময় চলছে আলো আঁধারের এক মায়াবী খেলা।
সময় দেখলাম মোবাইলের ডিসপ্লেতে। রাত একটা বেজে পনেরো মিনিট। ১৩ ই এপ্রিল, ২০২২। বাবার আমাদের সকলকে ছেড়ে দিয়ে কোন এক নক্ষত্রলোকে চলে যাওয়ার দিন। পাঁচ বছর ছুঁয়ে গেল আজকে।
তবে কি স্বপ্নটা নেহাতই কাকতালীয়? হয়তো তাই, কিম্বা হয়তো তাই নয়। কেউ জানে না তার উত্তর। আমি ঈশ্বর উদাসীন যুক্তিবাদী মানুষ। কিন্তু মাঝবয়সে এসে যখন পিছন ফিরে দেখি, তখন সবকিছু যেন যুক্তি দিয়ে মেলাতে পারি না আর।
১৯৮৮ সালের সে কোন এক বাদল ঝরা দিন। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে রয়েছি বাড়িতে। আজ জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট আউট। আমার সার্জেন বাবা বাড়িতে বলে গেছেন – “ছেলে যেন আজ রেজাল্ট দেখতে একদম না যায়। আমি মেডিকেল কলেজের অফিসে গিয়ে রেজাল্ট জেনে আসবো।”
কিন্তু বাবা বিকেলেও বাড়ি ফিরছেন না দেখে মায়ের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। আর যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো। ডেন্টাল কলেজের দেওয়ালে সাঁটানো লিস্টে ভিড়ের মাঝে নিজের নাম খুঁজে পেলাম না।
ভগ্ন মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে আসছি আর ভাবছি কী হবে আমার ভবিষ্যৎ? এত বড় একজন ডাক্তারের ছেলে হয়ে যদি জয়েন্ট এন্ট্রান্সে চান্সই না পেলাম তাহলে তো আমার ডাক্তার হবার স্বপ্ন আপাতত বিশবাঁও জলে! বাড়ি ফিরে বাবামাকেই বা মুখ দেখাব কি ভাবে? আর কিই বা ভাববে বন্ধুবান্ধবরা! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মুখ নীচু করে বাড়ি ফিরছি। লক্ষ্য করলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে,পাশে মা।
“কি হলো? কি দেখলি?”
“নাম নেই বাবা। চান্স পাই নি।”
“কি আজেবাজে বকছিস! আমি নিজে দেখে এসেছি তোর নাম।র্যাংক ৩৪৭। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পেয়ে যাবি তো বটেই। আমি অফিসে বসে দেখে এসেছি। আন্ডারলাইন করে রেখেছি তোর নাম। অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে আসতে হল।”
আমি বিস্ময় এবং চূড়ান্ত অবিশ্বাসে বাবাকে প্রশ্ন করে চলেছি ভুলভাল। তারপর কোনমতে সামান্য খেয়ে আবার ছুটেছি লিস্ট দেখতে। ইতিমধ্যে সেখানে ভিড় কমে গিয়েছে অনেক। শান্ত মনে নিজের নামটা খুঁজে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম সেই দিন। আর অবশ্যই দেখতে পেয়েছিলাম শেফার্স কলমের নীল কালির আন্ডারলাইন করা দাগটা। বাবার হাতের।
আসলে ডেন্টাল কলেজের যে লিস্টে আমার নাম খুঁজে পাইনি সেটাতে আমার নাম থাকার কথাও ছিল না। কারণ সেটা ছিল সিডিউল কাস্টদের লিস্ট। যাইহোক মোদ্দাকথা বাবা সেদিন না দেখলে সম্ভবত আমার ডাক্তারি পড়াই হতো না।
হঠাৎই যেন আজ মাঝরাতে সেই সব অতীত এক লহমায় চোখের সামনে অভিনীত হয়ে গেল।
ততক্ষণে ঘরের আধো অন্ধকার, এয়ার কন্ডিশনার মেশিনের ফিসফিসানির শব্দে যেন আরও বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। চোখের ঘুমকে আলবিদা জানিয়ে, উঠে বসেছি বিছানায়। দেওয়াল ঘড়িটিতে শব্দ তুলে, কারো তোয়াক্কা না করে নিজের মতো এগিয়ে চলেছে সময়। যেমন করে এগিয়ে চলে প্রতিক্ষণ।
১৩ই এপ্রিল, ২০১৭। দীর্ঘদিন অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী বাবার চলে যাওয়ার পালা আসন্ন। বাড়িতে অক্সিজেন, নেবুলাইজেশন দিয়ে রাখা হয়েছে। বাবার কথামতোই কোন ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ভর্তি করা হয়নি। ছেলেমেয়েরা সবাই জড়ো হয়েছেন। যে কোন মুহূর্তে চলে যেতে পারেন সেই আশঙ্কায়।
আমাদের হাসপাতালে আজ এক তরুণ রোগীর ইমার্জেন্সি ব্রেন টিউমার অপারেশন রাখা রয়েছে। রোগীটি অজ্ঞান অবস্থায় ভর্তি হয়েছে আজ ভোর রাতে। বাবার শারীরিক অবস্থার কথাও জানালাম আমার সিনিয়রকে। সিনিয়র কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু আমি জানি, আজকে অপারেশন না করতে পারলে আর বাঁচানো যাবে যুবকটিকে। বাবা হয়তো চলে যাবেন যখন তখন এবং সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ব্রেন টিউমারকে অপারেশন করে বার করে দিতে পারলে, বাঁচবে একটি যুবকের প্রাণ।
তাই বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে গেলাম হাসপাতালে। অপারেশন শেষ করার পরেও বাড়িতে ফোনে জানা গেল, বাবা তখনও শ্বাস নিচ্ছেন। বাড়িতে ফিরে সবার সাথে কথা বলছি। দেখছি বাবার শ্বাসকষ্ট আরও বাড়ছে। এবার মনে হয় চলে যাওয়াই ভালো। দেখতে পারছি না আর। আচমকাই কেন জানি, আমার ডাক্তার ছোট দিদি বললে, “ভাই, আমরা সবাই বাবার মুখে জল দিয়েছি এক তুই ছাড়া। তুই দিবি না জল? আমার মনে হয় সে জন্যই বাবা যেতে পারছেন না!”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলাম। দুজন চিকিৎসক এই সব কি কথা বলছে আরেক জন মৃত্যুপথগামী শল্য চিকিৎসকের সামনে দাঁড়িয়ে!
কিন্তু কেন যেন অস্বীকার করতে পারলাম না। বাবাকে জল খাওয়ানো তো কোন অপরাধ নয় তা ভেবেই এক চামচ জল ঢেলে দিলাম বাবার মুখে।
আর অলৌকিক ভাবে ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার শ্বাসকষ্টের গতি কমে আসতে লাগলো। সারাদিনের যাবতীয় যন্ত্রণার উপশম করে তিনি ধীরে ধীরে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন। শুধু আমি দেখলাম তার চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে। তখন সত্যিই মনে হলো তিনি যেন আমার এই এক চামচ জলের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। যুক্তিবাদী, ঈশ্বর উদাসীন মানুষ। ভূত বা ভগবান কাউকেই প্রত্যক্ষ করিনি। তাই তাদের প্রতি আমার আস্থা বা বিশ্বাস কোনটাই নেই। কিন্তু জীবনে সম্ভবত সব কিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। আমার এই অভিজ্ঞতা হয়তো সে রকমই কিছু একটা।
আজ মাঝরাতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা এই সমস্ত দৃশ্য পট দেখতে দেখতে অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। ঘুমভাঙা বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দেখলাম আকাশের মাঝে একফালি চাঁদের সাথে ফুটে আছে হাজারো নক্ষত্রের দল। এলোমেলো উদাসী হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর কোথাও যেন একটা নাম না জানা তারা খসে পড়লো।
মনে মনে বললাম, ভালো থেকো বাবা, যেখানেই থাকো। তোমার আশীর্বাদের ছোঁয়া লেগে থাক আমাদের সকলের শরীরে।
সকল প্রজন্মে।
খুব সুন্দর সহজ সরল ভাষা। মন ছুঁয়ে গেল । মন চলে গেল কয়েক বছর পেছনে । ভালো থেকো ।
It would better if there is a option to translate the text .