প্রায় ষোল সতেরো বছর আগের এক বর্ষণমন্দ্রিত সন্ধ্যায় পাশের রাজ্য থেকে এক ভদ্রমহিলা আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হলেন। একটি দুর্ঘটনায় তাঁর বাহুর হিউমেরাস হাড়টি প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে গেছে, ওপরের চামড়া, মাংসপেশি ও অন্যান্য সবকিছুই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেই সঙ্গে তাঁর ওই হাতের রেডিয়াল স্নায়ু ছিন্ন হয়ে গেছে, যার ফলে ওঁর কবজি ওপরে তুলতে পারছেন না ( Wrist drop ) এবং হাতটি ঠিক ভাবে মুঠো করতেও পারছেন না। ডাক্তারী পরিভাষায় যাকে বলে, Compound comminuted fracture shaft humerus with radial nerve injury. উনি আমার এক সতীর্থের কাছেই প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু রেডিয়াল স্নায়ুর ছিন্ন অবস্থা দেখে উনি রোগিনীকে আমায় দান করে দিলেন। এই ধরনের রোগীর চিকিৎসা আমাদের কারো কাছেই খুব সাদরে কাঙ্ক্ষিত গোছের নয়। তার কারণ, এই ধরনের রোগীকে অনেকবার অপারেশন করতে হয়, দীর্ঘদিন ধরে এর চিকিৎসা চলে আর এর ফলাফলও বেশ অনিশ্চিত।
যাই হোক সতীর্থের ভালোবাসার দান আমায় গ্রহণ করতেই হলো। রোগিনীকে ভালো করে পরীক্ষা করলাম। দুর্ঘটনার ইতিহাস শুনে বেশ দমে গেলাম। দুর্ঘটনার পর থেকে আজ অবধি চারদিন পার হয়ে গেছে। আসলে এই ধরনের আঘাতের চিকিৎসা চোট লাগার প্রথম ছ’ঘন্টার মধ্যে সঠিকভাবে শুরু করে দিতে পারলে ফলাফল সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু ওঁকে আমি পেয়েইছি চার দিন পরে। যাইহোক দ্রুত সব পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ করে ওঁকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠালাম। ওঁকে এবং ওনার স্বামীকে সব কিছুই খুলে বললাম। আরো আগেই অপারেশন করতে পারলে ফলাফল ভালো হতে পারতো কিন্তু এখন যতটা পারি চেষ্টা করে দেখি।
অ্যানাস্থেটিস্ট সহকর্মী ব্লক দিয়ে হাতটিকে সম্পূর্ণভাবে অবশ করে দিলেন। আমি হাত ধুয়ে অপারেশনে নামলাম। ব্যান্ডেজ খুলে দেখি ওঁর বাহুর চামড়া ও মাংসপেশি ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু একটা ভালো ব্যাপার ছিল যে ক্ষতস্থান বেশ পরিষ্কারই ছিলো। কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার্ বা ক্ষতস্থানযুক্ত হাড়ভাঙ্গার চিকিৎসায় সাধারণত হাড়ে প্রথমেই প্লেট স্ক্রু লাগিয়ে দেওয়া হয়না। External fixator নামক একটি যন্ত্র হাড়ের ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলোয় লাগিয়ে বাইরে থেকে হাড়টিকে বাঁধা হয়। কারণ ক্ষতযুক্ত হাড়ভাঙ্গায় জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই বেশী। তাই প্রথমেই প্লেট স্ক্রু লাগিয়ে দিয়ে জীবাণু সংক্রমণ হলে তার চিকিৎসা আরো জটিল হয়ে পড়ে। প্লেট স্ক্রু সবই খুলে ফেলতে হয়। হাড়ের অবস্থাও বেশ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন আমি প্রচলিত চিকিৎসার উল্টো পথে হাঁটলাম। ওই ক্ষতস্থান খুব সাবধানে ভালো ভাবে পরিষ্কার করলাম এবং টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হাড়গুলি সঠিক জায়গায় এনে বিশেষ ধরনের প্লেট এবং স্ক্রু লাগিয়ে ভাঙ্গাটিকে বাঁধলাম।
এবার ছিন্ন হয়ে যাওয়া রেডিয়াল স্নায়ু খুঁজতে শুরু করলাম। এই স্নায়ুটি সাধারণভাবে বাহুতে কোন শাখায় বিভক্ত হয় না। পু্রোবাহুতে (forearm) এটি দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু বেশ বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে এই রোগিনীর রেডিয়াল স্নায়ু বাহুতেই দুটি ভাগে ভাগ হয়েছে এবং এই দুটি শাখাই আঘাতে ছিন্ন হয়ে গেছে। শরদিন্দুর ভাষায় ‘ গন্ডের উপর পিন্ড ‘র মতো, আমায় ছিন্ন স্নায়ুর দুটি প্রান্তের জায়গায় ওই ক্ষতিগ্রস্ত মাংসপেশি ও অন্যান্য ট্যিসুর মধ্য থেকে চারটি প্রান্তকে খুঁজে বার করতে হলো। শেষমেশ খুঁজে পেলাম, এবার স্নায়ু সেলাই করার পালা। সত্যি বলতে কি, আঘাতে স্নায়ু ছিন্ন হয়ে গেলে তার সেলাইও আঘাতের প্রথম ছঘন্টার মধ্যেই করে ফেলতে হয়। না হলে আঘাত শুকিয়ে গেলে, আঘাতের অন্তত দেড় মাস পরে ওই সেলাই করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমি প্রচলিত চিকিৎসার উল্টো দিকে হেঁটে প্রথমেই স্নায়ু সেলাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ছিন্ন স্নায়ুর চারটি প্রান্ত কাছাকাছি এনে, মুখগুলি সামান্য কেটে সূক্ষ্ম নাইলনের সুতো দিয়ে সাবধানে সেলাই করে দিলাম। স্নায়ুর গায়ে সূঁচ ঢোকাতে গেলে প্রায়ই ট্যিসু কেটে যাচ্ছিল( আঘাতের চারদিন পরে ট্যিসু খুবই ভঙ্গুর ও নরম হয়ে যাওয়ায়) , তাই অতি সাবধানে সেলাই করতে হয়েছিল। এবার মাংসপেশি ও অন্যান্য ট্যিসু ও সাবধানে সেলাই করলাম। চামড়া একটা দুটো সেলাই দিয়ে বাকিটা খোলা রেখে দিলাম। তার পর ব্যান্ডেজ করে প্লাস্টার করলাম।
এতখানি ঝুঁকি নিয়ে প্রচলিত চিকিৎসার সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে অপারেশন শেষ করে বেশ ভয়ই করছিল। খারাপ কিছু হলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না এ আশঙ্কা খুব অমূলক ছিলো না। রোগিনীকে ওয়ার্ডে পাঠানো হলো, উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধের ব্যবস্থা করা হোল। রোগিনীর রক্তাল্পতার জন্য রক্ত দেওয়া হলো । যাইহোক দু’দিন বাদে দুরুদুরু বক্ষে আবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে রোগিনীর ব্যান্ডেজ খুললাম, দেখি জীবাণু সংক্রমণ ঘটেনি, ক্ষতস্থান মোটামুটি ভালোই আছে।খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। জ্বরজারিও কিছু নেই, ব্যথাও কমেছে। তারপর থেকে একদিন অন্তর অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ওঁর ড্রেসিং করেছি। আস্তে আস্তে ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসতে লাগল, আমায় চামড়া সেলাই আর করতে হয়নি। প্রায় দু সপ্তাহ বাদে অল্প যে দুচারটি সেলাই চামড়ায় দিয়েছিলাম সেগুলি কেটে দিলাম। তারপর নতুন করে প্লাস্টার করে রোগিনীকে ছুটি দিলাম।
অপারেশনের পরের এক্স রেতে হাড়ের ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলির অবস্থান মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল। ছুটি নিয়ে রোগিনী বাড়ি গেলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, কারণ এই কদিন প্রতি নিয়ত ভেবেছি এই বোধ হয় সংক্রমণ হলো । পিছনে তাকিয়ে পরে ভেবেছি, কেন সেদিন প্রচলিত চিকিৎসার উল্টো পথে হেঁটেছিলাম? কেন এক্সটার্নাল ফিক্সেটর না লাগিয়ে প্রথমেই প্লেট স্ক্রু লাগিয়েছিলাম? আসলে এক্সটার্নাল ফিক্সেটর লাগালে ভেঙে যাওয়া হাড়ের টুকরোগুলি একদম ঠিকঠাক ভাবে বসে না, আর তার উপরে ওই ফিক্সেটর লাগানো অবস্থায় ছিন্ন রেডিয়াল স্নায়ুর সেলাই খুবই শক্ত কাজ, যা আমি সম্ভবত পারতাম না, ফলে আমায় ওই সেলাই কয়েক মাস বাদেই করতে হতো। তখন আবার ওই স্নায়ুর ছিন্ন প্রান্তগুলি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াতো। আমি তাই একটা মরিয়া চেষ্টা করেছিলাম পৃষ্ঠদেশে প্রহারের প্রভূত সম্ভাবনা মাথায় রেখেই।
রোগিনীকে বাড়ি পাঠানোর পরেও কিঞ্চিৎ ভয় যে ছিল না তা নয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে দেরিতে সংক্রমণও হয়ে থাকে। যাইহোক চিকিৎসক ও রোগিনীর অতীব সৌভাগ্য যে সেসব কিছু হয়নি। মাস দুয়েক বাদে রোগিনী আবার দেখাতে এলেন। দেখলাম এক্স রেতে হাড়ের অবস্থা বেশ সন্তোষজনক। নতুন হাড় গজিয়ে হাড়ভাঙ্গা ভালো ভাবেই জুড়ছে। প্লাস্টার খুলে দিয়ে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করা হলো। রেডিয়াল স্নায়ুর অবস্থাও ভালোই । ছিন্ন স্নায়ু সেলাই করার পর সেই সেলাই জুড়ে গেলেই স্নায়ুটি আবার কাজ করতে শুরু করে এমনটি হয়না। আসলে সেলাইয়ের পর, ওই সেলাইয়ের জায়গা থেকে স্নায়ুটির ওপরের প্রান্ত, ওই স্নায়ুর নীচের প্রান্ত বরাবর নতুন করে গজাতে থাকে প্রতিদিন এক মিলিমিটার করে। এই ভাবে গজাতে গজাতে একদম শেষ অবধি (এক্ষেত্রে আঙ্গুলের ডগা অবধি) যায়।
রোগিনীকে আগেই বলে রেখেছিলাম হাত পুরো ভালো হতে অনেক দিন লাগবে। ওঁর আঙ্গুলের ডগা থেকে ওই স্নায়ুটির ছিন্ন অংশের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ সেন্টিমিটার ছিল তাই হিসেব মতো প্রায় চারশো দিন লাগার কথা পুরো স্নায়ু স্বাভাবিক হতে। ওরকমই সময় লেগেছিলো ওনার হাত ভালো হতে। দেড় দুমাস অন্তর উনি আমায় দেখাতে আসতেন, ওঁর হাতের অগ্রগতি লক্ষ্য করতাম। আমার সৌভাগ্য যে উনি ধৈর্য ধরে আমার নির্দেশগুলি এত দীর্ঘ সময় ধরে পালন করে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যেদিন উনি ওনার কব্জি পুরো তুলতে পারলেন আর হাত ভালো করে মুঠো করে আমায় দেখালেন ওনার মুখ হাসিতে ঝলমল করছিলো। দুহাতে আমায় ‘নমস্তে’ জানিয়ে বিদায় নিলেন। আমার চোখটা একটু জ্বালা করে উঠলো।
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে, ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।
চমৎকার লেখা। অভিনব অভিজ্ঞতা। তবে এখনকার যুগে এত রিস্ক এবং গালাগালি ও মারধোর খাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যেও এরকম চিকিৎসা করা প্রয়োজন কিনা, সেটাই ডাক্তারদের জন্য ভাবনার বিষয়। রুগী সেরে উঠলে সব ভালো। রুগীর প্রাণ সংশয় হলে কিন্তু হাতজোর ও নমস্কারের পরিবর্তে কি জোটে তা সব ডাক্তারই এখন জানেন। সাবধানে থাকিস বন্ধু। খুব ভালো থাকিস।
ইন্দিরা।
সেতো জানি। তুই ও কম জানিস না। অসফল হলে আমার ভাগ্যে কি জুটতো ! তবুও সারা জীবন এমন ঝুঁকিতো আমরা সবাই নি। কেন করি এমন, তা বলতে পারবো না। হয়ত বাহবার লোভে। জানিনা। তুই ও খুব ভালো থাকিস।
প্রতিভাবানেরাই প্রচলিত পথের উল্টোদিকে হাঁটবার সাহস দেখাতে পারেন । যে পথে যে বিপদ আছে , আছে অসফলতার সম্ভাবনা — তা তাঁরা সম্যক জানেন । তবু অপরিসীম আত্মবিশ্বাস তাঁদেরকে সেই পথে চালিত করে । ফলে দুর্লভ সফলতাও আসে যাকে আর পাঁচটা সাফল্যের সঙ্গে মেলানো যায় না । জনগন ও তাঁকে আলাদাভাবে চিনতে পারেন । আর এইভাবেই কখন যে তিনি প্রতিভাবান বা idol হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যান তিনি নিজেও টের পান না ।
ডাঃ কীর্তনিয়া , আপনি দীর্ঘজীবী হোন এবং আপনার প্রতিভার স্পর্শে আরো বহু মানুষ সুস্থ জীবন ফিরুন ,এই কামনা করি ।
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
অসামান্য লেখা!
ভালোবাসার আরেক নাম অনিরুদ্ধ ?
অনেক ধন্যবাদ দাদা, প্রণাম নেবেন।