একটা ফুটফুটে বাচ্চা সেদিন চেম্বারে দেখাতে এসেই তড়বড় করে বলল–‘আমাকে একটা নৌকো বানিয়ে দেবে?’ একটু অবাক তো হলামই–ঘরে ঢুকেই এ আবার কেমনতর আবদার।
সঙ্গে ঝকঝকে বাবা মা মিটিমিটি হাসছিলেন। ওনারা বললেন –‘ওকে দেখুন দিদি, নৌকোর ব্যাপারটা পরে বলছি।’
অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস নামে একটা সমস্যা আছে ক্ষুদে রোগীর, খুব কমন চামড়ার সমস্যা শিশুদের, কিছুটা বংশগত –কষ্ট কম বেশি, তেমন ভয়ের রোগ নয়, একটু বড় হলে এমনিতেই কমে যায় অনেক ক্ষেত্রে। শীতে বাড়ে –এনার ঝামেলাটা সেখানেই, ইনি বারোমাসই শীতের দেশে থাকেন। কিভাবে কি যত্ন নিতে হবে সব বলাটলা হল। কিছু ওষুধপত্তর লিখলাম।
এবার ক্ষুদে রোগীর বাবা বললেন –‘আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারবেন না, এত বছরে কত পেশেন্ট দেখেছেন –‘
তরুণ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাই– সত্যিই মনে এতটুকু কোন স্মৃতি নেই। চশমার আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ফিটফাট ড্রেস- -পাশে স্মার্ট সুন্দরী স্ত্রী। নাহ –একটুও মনে পড়ছে না।
তরুণ বললেন –‘আমি তিরিশ বছর আগে আপনাকে দেখাতে এসেছিলাম আমার দিদার সঙ্গে।’
নিজের পাকা চুলে একবার হাত বোলাই– হায় রে! মেঘে মেঘে যে সাঁঝ ঘনাল, তেত্রিশ বছর হয়ে গেল, একই শহরে ডাক্তারি করছি!
‘আমার তখন আট বছর বয়ে…’
এরপর সেই তরুণের কথায়, তিন দশক আগের কোন এক ভুলে যাওয়া সন্ধ্যার চিত্ররূপ নির্মিত হতে থাকে আমার মনে —
ডাক্তার দিদি–‘আপনারা বাচ্চাটার একদম যত্ন নেন না, এরকম খড়ি ওঠা গা হাত পা থাকলে এ রোগ কোনদিন সারবে না।’
দিদা বললেন ‘কি করব বলুন –আমার বয়স হয়েছে, প্রেশার সুগার আর্থ্রাইটিস– একা পেরে উঠি না।’
–‘আপনার পক্ষে সম্ভব নয় মানছি, ওর মা বাবা কি করে?’
–‘ওর মা নেই, মারা গেছে দু’বছর হল। বাবা আবার বিয়ে করে নতুন সংসারে, ওকে দেখে না একেবারেই, আমার কাছেই থাকে নাতি।’
‘
নীরবতা’ ছাড়া ডাক্তারদিদির এ সময়ে আর কিছু করার থাকেনা। পরের বার যখন দেখাতে এল, নাদুসনুদুস ছেলেটা বলল–‘আন্টি আমি এখন নিজে নিজে তেল মাখি, ময়শ্চারাইজার মাখি –দেখো , কতটা সেরে গেছে। অভীক, সোনু ওরা পারে না, এখনো ওদের মা চান করিয়ে দেয়।’
খুঁড়িয়ে হাঁটা দিদিমা চোখ মুছে বলেন –‘যার যেমন কপাল। ছ’টায় ইস্কুলের বাস আসে, আমি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ি, কোনদিন সকালে উঠতে না পারলে নাতি আমার নিজেই পাঁউরুটিতে মাখন মাখিয়ে টিফিন নিয়ে যায়।’
ছেলেটা বলল–‘আমি নিজে জামা ইস্ত্রী করতেও পারি। দিদা রাতে ফোৎ ফোৎ করে ঘুমিয়ে পড়ে, আমাকে গল্প বলে না –অভীকের মা ওকে বেডটাইম স্টোরি শোনায়।’
ডাক্তারদিদির ছেলের বয়স তখন সবে এক বছর, সেই বাচ্চাটাকে উজাড় করে অনেক কিছু দিতে ইচ্ছে হল। সাধ্য আর কতটুকু। সে সময় ফাঁকা চেম্বার –একটা দুটো পেশেন্ট।
তরুণ বলে –‘আপনি সেদিন প্যাডের পাতা ছিঁড়ে আমাকে একটা কাগজের নৌকো বানিয়ে দিয়েছিলেন– আর বুদ্ধু ভুতুমের রূপকথার গল্প বলেছিলেন। তখন আপনার এত বড় চেম্বার ছিল না, ছোট্ট একটা টেবিলের উপর হাতে ঠেলে কাগজের নৌকো চালিয়ে বলেছিলেন–“খুব ভালো করে পড়াশোনা কর, তাহলেই এই নৌকো চড়ে কলাবতী রাজকন্যার কাছে পৌঁছে যাবে। তুমি সত্যি ভালো লেখাপড়া করলে দেখবে নৌকোটা নিজেই চলছে একদিন।”
আমি তখন শ্রোতা , তরুণ বলে চলে –‘আমি জানেন তো যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম কাগজের নৌকোটা, মাঝে মাঝে বের করে টেবিলে রেখে দেখতাম নিজে চলছে কিনা –তারপর আবার পড়তে বসতাম –‘
থামলে বলি, ‘তারপর তুমি তো ইঞ্জিনিয়র হলে আর কলাবতী রাজকন্যেকে পেলে কোথায়?’
পাশে জিনস টপ পরা তরুণী এবার ঠোঁট টিপে একটা মিষ্টি হাসি গিফট দিয়ে বলল– ‘কলেজেই। সেই ছোটবেলার গল্পটাই ওকে আপনার কাছে আসার সময় বলছিল ওর বাবা, তাই নৌকোর বায়না আমরা এক আত্মীয়ের বিয়েতে এসেছিলাম ইউএসএ থেকে–ছেলেও বাবার স্কিন প্রবলেমটা পেয়েছে, ভাবলাম -আপনাকে একবার দেখিয়ে যাই।
ওহ এই কথা, দাঁড়াও –ঝটপট একটা কাগজের নৌকো বানিয়ে হাতে দিলাম –নিল হাসিমুখে। মনে মনে বললাম –‘তোমার বাবার মনখারাপ নদীতে সেদিন এ নৌকো চলেছিল, তোমার সুখ সাগরে হয়তো টুপ করে কোথায় ডুবে যাবে, মনেই থাকবে না –‘তবু মনে রেখো –।’
ওরা চলে গেল।
অসুখের হাত ধরে কত সুখও যে আসে আমাদের কাছে –গলার কাছে কি যেন একটা আটকে চোখে জল এল।