৩২ নম্বর গোরাচাঁদ রোডের লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকলাম যখন, সময়টা মনে হয়েছিল থমকে আছে।
ডানদিকে ছোট্ট একটা লাল সিমেন্ট বাঁধানো ঘর, উপরে টিনের চাল। তার ছাদ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছে একটা প্রাচীন বটগাছ। গাছে’র পাশে একটা আস্ত শিবলিঙ্গ, রোজ পুজো হয় তাতে। কলেজের পাঁচিলের গায়ে লেগে থাকা মসজিদ আর গেটের ভিতরে শিব মন্দিরের কেমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান!
বাঁদিকে একটু এগিয়ে লেডিস হোস্টেল। আর তার ঠিক পিছনে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে অডিটোরিয়ামে।
যে সময়ের কথা বলছি তখন আশি’র দশক শেষ হচ্ছে । মনমোহিনী অর্থনীতি তখনও খুলে দেয়নি দেশের বাজার । অধুনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি র দল বিজেপি, রাজনৈতিক ভাবেও এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি।
রবিবারের কোন এক সকাল। রাস্তা থেকে চেনা গলার ডাক শুনে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে কলেজের দুই সিনিয়র, জ্যোতি’দা আর হীরক’দা। আমার ফার্স্ট ইয়ার তখন। এদের সম্ভবত ফোর্থ ইয়ার চলছে । সিনিয়রদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন মাথায় করে, নীচে নেমে এলাম।
“শোন, শুনেছিস নিশ্চয়ই আমাদের কলেজের কালচারাল ফেস্ট ‘অ্যাগন’ এর কথা। সাত দিন পরেই শুরু হতে চলেছে। “
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম “হ্যাঁ শুনেছি। আর সেই ফেস্ট উপলক্ষে তো ক্লাসের জনতার প্রবল উত্তেজনা। এটাতো আমাদের প্রথমবার এই ফেস্টিভাল দেখা,তাই না । ” হেসে বললাম আমি।
“ঠিক।আর সেই জন্যই তোর কাছে আসা।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে, হীরক দা বলে চললো ” ইন্ট্রা কলেজ নাটকের কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়ে আমাদের ‘কাক চরিত্র’ নাটকটি সিলেক্টেড হয়েছে ‘অ্যাগন’ এ পার্টিসিপেট করার জন্য। সেই অনুযায়ী রিহার্সাল চলছিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছে নাটকের ‘সাধু’ চরিত্রটিতে অভিনয় করা ভাস্করের আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়া। জ্যোতির কাছে খবর পেলাম তুই নাটক করিস।আর ঠিক সে’জন্যই তোর কাছে আসা। ওই সাধু চরিত্রটা তোকে’ই করতে হবে ফাইনালের দিন।”
এবার আমার চমক লাগার পালা। ছোট থেকেই এ পাড়া, ও পাড়ায় নাটক করলেও সাতদিনে নতুন চরিত্র তুলে, তা মঞ্চস্থ করার কথা ভাবলেই তো চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে।
তাও ‘অ্যাগন’ এর মতো কলকাতা শহরের একটা নামজাদা ইন্টার কলেজ নাটকের কম্পিটিশনে!!
আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সিনিয়রদের আমার মত ফার্স্ট ইয়ারের উপর কনফিডেন্স দেখে আর কিছু বলতে পারলাম না।
রিহার্সালে প্রথম দিন থেকে তাই অসুবিধাগুলো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এমনিতেই মনোজ মিত্রের ‘ কাক চরিত্র’ নাটকটি খুব জনপ্রিয়। ভুলভাল হলে খুব বদনাম হবে এই ভয়ে খুব তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে ফেললাম।
কিন্তু সমস্ত হিসেব গুলিয়ে দিলেন ‘সুধীনদা’।
তার মতো গ্রুপ থিয়েটারের একজন পরিচালককে নিয়ে আসা হলো আমাদের অ্যামেচার অ্যাক্টিংকে একটু পেশাদারি পালিশ দেওয়ার জন্য।
সেটা আমার জীবনে প্রথম কোনও পেশাদার নির্দেশককে খুব কাছে থেকে দেখা। রাতারাতি পুরো নাট্যাভিনয়ের স্টাইলটাই বদলে দিলেন তিনি। শেষ দিন লিন্টন হোস্টেলে প্রায় সারারাত জেগে চলল নাটকের মহড়া। সে রাতের খুঁটিনাটি মনে না থাকলেও, ঘটনাটি মনে রয়ে গেছে।
নির্দিষ্ট দিনে কোন এক সন্ধ্যার অডিটোরিয়াম। বাহারি সব রঙিন আলোয় ঝিকমিক করছে গোটা কলেজ। পরীর মত উড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েরা। শশব্যস্ত উদ্যোক্তাদের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে এক মঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে। কোথাও চলছে গান,ডিবেট অথবা কুইজের কম্পিটিশন। অন্য কোনও লেকচার থিয়েটারে চলছে ক্রিয়েটিভ রাইটিং অথবা এক্সটেম্পো’র প্রতিযোগিতা। মাইকে মুহুর্মুহু ভেসে আসছে কম্পিটিশনের বিবিধ আবেদন নিবেদন।
ব্যাকস্টেজে মেকআপ রুমে দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে । প্রতিযোগিতায় যোগদান করা অন্য কলেজের নাটক সমাপ্তি’র হাততালি ভেসে আসছে কানে।
অপেক্ষায় আমাদের কলেজ। মঞ্চের পর্দা উঠবে ‘কাকচরিত্র’ অভিনয়ের জন্য।
হাই পাওয়ারের চশমা খুলে, সাধু’র গেরুয়া আলখাল্লা আর গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না আমি। শুধু বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো।
যাই হোক যথা সময়ে আমাদের নাটক শেষ হলো। করতালি আর শিসের আওয়াজে এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে বিশেষ ঝোলাই নি। কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়ে আমরা কলেজের মুখ রক্ষা করতে পেরেছিলাম সেইবার।
দিন এগিয়ে এসেছে অনেক। বয়েস আর থমকে দাঁড়িয়ে নেই। উৎসাহ থাকলেও পেশাদারি জীবনের ব্যস্ততা সময় দেয়নি অন্য কিছু ভাবনার।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেও অডিটোরিয়ামটা আর খুঁজে পেলাম না।
নীচ থেকে দারোয়ান গোছের কেউ একটা জানিয়ে দিল আমাদের কলেজ জীবনের অডিটোরিয়াম এখন সরে গিয়েছে অন্যত্র।
এইবার বুঝতে পারলাম দরজাটা হারিয়ে যাওয়ার মানে। মন খারাপ হলো ভীষণ।
সন্ধ্যার নাটকের মঞ্চ আর নেই!
হারিয়ে গিয়েছে সেই ঝিকমিকে আলো, ব্যাকস্টেজে’র টেনশন আর অডিয়্যান্সের কালো কালো মাথার সারি।
মেকআপ রুমের আয়নায় আচমটাই বদলে যাওয়া চেহারা দেখতে দেখতে চমকে ওঠা আর ভাগ করে খাওয়া আধপোড়া সিগারেটের কাউন্টার।
অতীতে ফিরে যাওয়ার পাসওয়ার্ডটাই যেন ফেলে দিয়েছি কোথাও। অনেক খুঁজেও তার হদিস মিলছে না। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে লক্ষ্য করলাম কলেজ বাড়ি গলোয় লেগে থাকা সেই হলুদ আর লাল রঙ সময়ের গতি’তে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
গেটের পাশের সেই শিব মন্দিরের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে নতুন বিল্ডিং। নীলসাদা রঙের আঁচড়ে যেন বদলে গিয়েছে গোটা কলেজ’টাই।
Sotti re . Nostalgia