আজ ভোরে স্বপ্ন দেখছিলাম, সামনে ছড়িয়ে রয়েছে থরে থরে চিঠি। কোনও বিশেষ রকম কার্ডটার্ড নয়, আদি ও অকৃত্রিম চিঠি। পোস্ট অফিসের কাগজের স্ট্যাম্প দেওয়া ঘিয়ে রঙের মোটা কাগজের চিঠি। সব চিঠি আমাকে লেখা। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। আমিও লিখবো বলে একগোছা ফাঁকা চিঠি টেবিলে সাজিয়ে রেখেছি। যত্ন করে দু’লাইন লিখে তারপর প্রাপকের নাম-ঠিকানা লিখে পোস্ট অফিসের বাক্সে ফেলতে হবে। তারপর পিয়নের বাক্সে, ট্রেনে, গাড়িতে, প্লেনে চিঠিগুলো উড়ে যাবে। আমার লেখা ওই দু-লাইন নিয়ে।
ঝর্না কলমে লিখবো। অনেকগুলো রঙের দোয়াত সামনে সাজানো থাকবে। বিভিন্ন কলমে লেখার চরিত্র আলাদা৷ লেখা দেখেই বলে দিতে পারবো কোনটা কোন কলমে লেখা। প্রতিটি চিঠির চরিত্র আলাদা হবে। চিঠি দেখলেই বোঝা যাবে কোনটা খুব তাড়াহুড়োয় লেখা। কোনটা জানলার পাশে বসে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলগোছে লেখা। লেখায় হাতের স্পর্শটা থাকবে। নিষ্প্রাণ স্যোশাল মিডিয়ার মতো সব ‘ক, খ, গ’ সব ‘এ, বি, সি’র চরিত্র একরকম ফ্যাটফেটে হবে না। ব্যক্তিভেদে, স্থানভেদে, সময়ভেদে লেখাগুলো বদলে যাবে। চিঠির বুকে শব্দ ভেসে উঠবে। অক্ষরেরা খেলবে। প্রতিটি চিঠিতে প্রেরকের স্পর্শ লেগে থাকবে।
ছোটোবেলায় দাদুর লেখা চিঠি পেতাম। সব সাধুভাষায় লেখা। আমিও লিখতাম। এবড়োখেবড়ো লেখা। লাইন বেঁকে যেত। চিঠিগুলো গোছানো থাকতো। অনেক বছর বাদে চিঠিগুলো চোখে পড়লে মনে হ’ত, চিঠিগুলো হাতে নিয়ে কোনও দ্রুতগতির ট্রেনে বসে আছি। দু’পাশে হু হু করে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। সময়ের স্রোতে হাবুডুবু খেতে খেতেও চিঠিটায় মুখ গুঁজে খানিকটা ইতিহাসের গন্ধ শুঁকে নিচ্ছি। সেপিয়া রঙা দিন। মোবাইল আসেনি, শারজায় সচিনের মরুঝড় হয়নি, পোখরানে বুদ্ধ হাসেনি। দোমড়ানো টিনের বাক্স হাতে ইস্কুলে যাই, দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করি, তিড়বিড়িয়ে সারা পাড়া চরে বেড়াই। সেসব দিনের গন্ধ নিয়ে চিঠিগুলো বেঁচে থাকে। চিঠিরা বুড়ো হয়। কোণগুলো উই কেটে যায়, লেখা লালচে হ’তে হ’তে আবছা হয়ে আসে। কোন বইয়ের, কোন ফাইলের মধ্যে হারিয়ে যায় খোঁজ পাওয়া যায় না। বহু বছর বাদে চিঠি ফিরে আসে; বহুদিনের না-খোলা বাক্স, ট্রাঙ্ক, আলমারির অন্ধকার থেকে।
তারপর অনেক বছর কেটে যায়। চিঠি লেখার সময় থাকে না কারো। চিঠির সাথে জুড়ে থাকা মানুষগুলোও এক এক করে কোথায় হারিয়ে যায়! আমার ছুটতেই থাকি। ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে গেলে মুশকিল। আরও আরও দ্রুত হওয়ার দৌড়ে চিঠি এঁটে উঠতে পারে না। ‘যোগ্যতমের নির্বাচনের’ সূত্র মেনে চিঠি হারিয়ে যায়। মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিন ট্যাপটেপিয়ে দু-কথা লিখলেই কাজ সারা গেলে আর কষ্ট করে চিঠি লেখা কেন?
তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে, চিঠি ফিরবে। চিঠি আবার ফিরবে। যতই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আসুক, হাতের স্পর্শের কোনও বিকল্প হয় না। মানুষের গভীরতম অনুভূতি ছুঁয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুলি-তর্জনী হয়ে যে অক্ষরের ভালোবাসা চুঁইয়ে পড়ে তাকে ধারণ করতে পারে কোন স্ক্রিন? কোন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স? চোখের জল পড়ে যে চিঠির শেষ লাইনটা মুছে গেল, কোন স্যোশাল মিডিয়া তার নাগাল পায়? বাড়ির দরজার সামনে চিঠি আসার ডাক পেলে যে ঔৎসুক্য জাগে কোন ই-মেইল তার সাথে পাল্লা দেয়?
ঝর্না কলম ফিরছে। চিঠিও ফিরবে। কোনও দুরপাল্লার দ্রুতগামী ট্রেনের জানলার সামনে বসে কোনও ভবিষ্যতের ‘নায়ক’ হঠাৎই অতীতচারী হয়ে উঠবে। হয়তো পকেটে স্মার্টফোনের চেয়েও উন্নত কোনও যন্ত্র থাকবে। সামনে সুপার-ল্যাপটপ। কিন্তু সাথে একটা ছোট্ট, চামড়া-বাঁধানো নোটবুকও থাকবে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হ’লে ফোন নম্বরের সাথে সাথে ঠিকানাটাও লিখে নেবে খসখসিয়ে।
সপ্তাহখানেক বাদে একটা মোটা ঘিয়ে কাগজ পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়। ফোনের মেসেজ, ই-মেইল খুলে দেখার ইচ্ছে না-ই হ’তে পারে; চিঠির আবেদন উপেক্ষা করা কঠিন। ‘নায়ক’-এর অসমাপ্ত গল্প নাহয় কোনও অনাগত চিঠিতেই লেখা থাক…
চিঠি ফিরুক। স্পর্শ ফিরুক।