আজকাল মেয়েরা চাইলে ঠিক করতে পারেন কখন তিনি সন্তান ধারণ করতে চান। প্রসবের প্রকার- পদ্ধতির উপরেও তাঁর যথেষ্ট কর্তৃত্ব আছে। দুটি বিষয়েই যথেষ্ট আলোচনা হয়। কিন্তু যে বিষয়ে আলোচনা কম সেটা হল তাঁর গর্ভপাতের অধিকার। একটা জিনিস আগেই বলে নি, আজকের দিনে ফোর্সড মাদারহুডের কোন জায়গা নেই। আমার এই লেখা গর্ভপাতের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।আমার এই লেখা সংবিধানসম্মত ভাবে একজন নারীর প্রজননগত স্বাধিকারের পক্ষে।
আইন
উদারতার প্রশ্নে আমাদের দেশের গর্ভপাত আইন নিয়ে গর্ব করার অনেক কারণ আছে। ১৯৭১ সালে প্রথম যখন আমরা এই আইন আনি বিশ্বের খুব কম দেশই তখন গর্ভপাতকে আইনী স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আইন এসেছে তারও দু’বছর পরে। দুর্ভাগ্যবশত এখনও সেখানকার কিছু কিছু রাজ্য বেসুরো গায় এবং গর্ভপাত বেআইনি বলে ঘোষণা করে ছয়ের দশক পর্যন্ত ভারতবর্ষে সমস্ত রকমের গর্ভপাত ছিল অবৈধ। তারপর অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা এখন যথেষ্ট নারীকেন্দ্রিক এক উদার আইনের অধিকারী। বর্তমান আইন অনুযায়ী পরিস্থিতি বিশেষে একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক প্রথম কুড়ি সপ্তাহ অবধি গর্ভপাতের অনুরোধে সম্মতি দিতে পারেন। কুড়ি থেকে চব্বিশ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করাতে হলে দুজন চিকিৎসকের সম্মতি প্রয়োজন। এমনকি ২৪ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও আইনত গর্ভপাত করানো সম্ভব তবে এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র যৌন লাঞ্ছনার শিকার, নাবালিকা অথবা বিশেষ ভাবে সক্ষম নারীদের জন্য। এছাড়াও খুব দেরিতে ভ্রূণের বড়সড় অসঙ্গতি ধরা পড়লে যে কোন অবস্থায় গর্ভপাত সম্ভব। তবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একমাত্র সরকারি হাসপাতালের পূর্বগঠিত কোন মেডিকেল বোর্ড যেখানে থাকবেন বিভিন্ন শাখার একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
আইনের প্রয়োগ
আগের চেয়ে অনেক ভাল। তবু অনেক রাস্তা যেতে বাকি। বিশেষত দেরিতে আসা বা সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্য।
যথেষ্ট উদার আইন থাকা সত্ত্বেও এঁদের সবার কাছে এই আইনের সম্পূর্ণ সুফল আমরা পৌঁছে দিতে পারছি না। অনেক ক্ষেত্রে আনছি গর্ভপাত প্রক্রিয়ার শেষে অনভিপ্রেত জীবিত সন্তান। এই সব নবজাতক থাকছে ভীষণ অপরিণত বা অসুস্থ। সাম্প্রতিক সময়ে এ ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়। মাত্র এগারো বছরের কিশোরী বারংবার ধর্ষিত হয়ে গর্ভবতী হয়। মহামান্য উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁর গর্ভপাত করানো হয় ছাব্বিশ সপ্তাহে। জন্ম হয় অত্যন্ত অপরিণত একটি জীবিত শিশুর। পরিবার অস্বীকার করায় তার স্থান নির্ধারণ হয়েছে সরকারি হোমে। এ ঘটনা শুধু কলকাতায় ঘটেছে তা নয়। মুম্বইয়ও ব্যতিক্রম নয়। না জানি দেশের আরও কত জায়গায় এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। চালু আইনের আংশিক প্রয়োগবশত বিফলে যাচ্ছে একাধিক নারীর ন্যায্য আবেদন।
কঠিন সিদ্ধান্ত
ভ্রূণমোচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ কাজ নয়। নারীর জন্য তো বটেই চিকিৎসকদের জন্যও কঠিন। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ গর্ভপাত করাতে চান না। দেরি হয়ে গেলে ব্যাপারটা আরও সত্যি। এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট নারী জীবিত সন্তানের জন্ম দিতে চাইবেন না এমনটাই ধরে নেওয়া যায়। নচেৎ মূল উদ্দেশ্য পরাভূত হতে পারে। অনভিপ্রেত সেই গর্ভাবস্থার কারণ হতে পারে যৌন লাঞ্ছনা বা দেরিতে চিহ্নিত হওয়া কোনো গুরুতর অসুস্থতা। এহেন অবস্থায় জীবিত সন্তানের প্রসব হলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও জটিল। জন্মকালে সকল জীবিত শিশুর যত্ন নিতে বাধ্য যে কোন চিকিৎসক। এটি তাঁদের কাছে নৈতিক তথা পেশাগত দায়বদ্ধতা। আধুনিক চিকিৎসার দৌলতে অসুস্থ বা অপরিণত এই নবজাতকেরা অনেকেই বেঁচে যায় অনেক দিন। কিন্তু বাঁচাটাই তো সব নয়। জীবনের গুনমান এবং যথাযথ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বাঁচতে হয়। অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিলেই দায়িত্ব চুকে যায় না।
মায়ের স্বাস্থ্যচিন্তা
গর্ভপাত প্রক্রিয়ায় অন্তঃস্বত্তার স্বাস্হ্য নিয়ে চিন্তা থাকা স্বাভাবিক। তবে সেসব বিপদের সম্ভাবনা পূর্ণ সময়ে ডেলিভারির চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। মনে রাখতে হবে এই একটি সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে থাকে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ, শান্তি, সামাজিক সম্মান ইত্যাদি। গর্ভপাতের পক্ষে বিপক্ষে এবং একটি অবাঞ্ছিত সন্তানকে পৃথিবীতে আনার বিষয়ে আমাদের অনেকের বিপরীতধর্মী বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু এই কঠিন পদক্ষেপের পরে যদি একজন নারী তাঁর জীবনের এক আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত অধ্যায় থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চান তাতে ক্ষতি কি? জোর করে তাঁকে সেই দুঃসহ সময়ে বন্দী করে না রাখলেই কি নয়!
মেডিকেল বোর্ড
চলতি বছরের শুরুর দিকে কেন্দ্রের নির্দেশিকা আসার অব্যবহিত পরেই রাজ্যে জুড়ে গঠিত হয়েছে ত্রিশটিরও বেশি মেডিকেল বোর্ড। সারা দেশে পাঁচশোরও বেশি। চব্বিশ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে বা কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে এঁদের ডাক পড়ে। একাধিক বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ সম্মিলিত এই বোর্ডগুলি যথাসম্ভব ভালো কাজও করছেন। তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন প্রসবের আগেই বন্ধ না করার ব্যাপারে। উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই ২০১৭ সালে আমাদের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত একগুচ্ছ নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবেই বলা রয়েছে কোন কোন পরিস্থিতিতে এবং কিভাবে গর্ভপাতের পূর্বে ভ্রূণের হৃৎস্পন্দন আগে থামিয়ে দেওয়া উচিত। ক্রূরমতি শোনালেও এটি সমগ্র চিকিৎসারই একটি অঙ্গ এবং অন্তঃসত্ত্বার হিতসাধনই এর মূল লক্ষ্য।
ভ্রূণের অধিকার
গর্ভস্থ ভ্রূণের অধিকার রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সেভাবে দেখতে গেলে একটি ভ্রূণের জীবিত অবস্থায় জন্মানোর অধিকার আছে। সুস্থ অবস্থায় জন্মানোর অধিকারও থাকা উচিত। আবার না-জন্মানোর অধিকারও থাকবে নাই বা কেন? শেষ অংশটি পরে যারা অবাক হলেন তাদের জানিয়ে রাখি দু’বছর আগে ইংল্যান্ডে এক তরুণী তার মায়ের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কেস জিতেছেন এই মর্মে। মেয়েটির মেরুদন্ডে রয়েছে ভয়ানক জন্মগত ত্রুটি। ২০ বছর বয়সে তিনি দাবি করেছেন তাঁকে এই অবস্থায় পৃথিবীতে আনাটাই নাকি ঠিক হয় নি! (তথ্যসূত্র Times of India, 3 Dec 2021)।
পাঠকবর্গের নিজ নিজ বিশ্বাস বা নৈতিক অবস্থানের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায় যে, আইনের চোখে জন্মলাভের আগে কোন ভ্রূণ মানবমর্যাদা পায় না। ফলে তার কোন অধিকার থাকতে পারে না। মরাল স্টেটাসের প্রশ্ন আলাদা। মানবপ্রজাতির এক আগত সদস্যের প্রতি আমাদের হয়তো আরো মানবিক হওয়া উচিত। বিশেষত: ছ’মাস মাতৃগর্ভে কাটানোর পর সে যখন ‘Viable’ বা বাধ্যতামূলকভাবে আর মা-নির্ভর নয়। কিন্তু দাঁড়িটা টানা হবে কোথায়? মানুষের জেনেটিক কোড আছে এমন কোনো সত্তাকেই তো মানুষ বলা উচিত। আর সেই জেনেটিক কোড আরোপিত হয় ডিম্বাণুর নিষেকের সাথে সাথে। আর সে জন্যই তো ক্যাথলিকরা কোনো অবস্থাতেই গর্ভপাত সমর্থন করেন না। তাছাড়া প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে তো Viability এর সংজ্ঞাও বদলে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ২৮ সপ্তাহ। উন্নত দেশে ২৪, আবার কোথাও কোথাও ২২ ! কিন্তু Viability stage পেরিয়ে গেলেই সত্যিই কি সে স্বাধীন? অপরিণত শিশুকে কি Ventilator এ দিতে হয় না? অনেক পরিপুষ্ট সদ্যোজাতেরও তো সহায়তা লাগে। আর Viability দিয়ে দেখতে গেলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে যায়। আমাদের মানবিকতা কি তাহলে কারো নির্ভরশীলতার সাথে লিঙ্কড্?
মায়ে ভ্রূণে দ্বন্দ্ব
হবু মায়ের সাথে গর্ভস্থ ভ্রূণের স্বার্থ যে সবসময় এক বিন্দুতে মেলে তা নয়। সেখানে যদি সংঘাত লাগে তবে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত গর্ভধারিণীর। এককথায় ভ্রূণের অধিকার যদি বা কিছু থাকে তা বিমূর্ত (notional)। গর্ভস্থ ভ্রূণের আইনসম্মত কোন অধিকার নাই। অনিবার্য পরিস্থিতিতে নিরুপায় নারী যদি আইনসম্মত উপায়ে গর্ভপাত চান তাঁকে হতাশ করা যায় না। দেশের সংবিধান তাঁকে প্রজননগত স্বাধিকার দিয়েছে। সংশোধিত গর্ভপাত আইন তারই অন্যতম হাতিয়ার।
অন্তিমে
গর্ভপাত নিয়ে যে কোন আলোচনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও নৈতিক সংঘাতপূর্ণ হতে পারে। হয়তো সে কারণেই আরও বেশি করে বিষয়টি সামনে আসা উচিত। মায়ে ভ্রূণে স্বার্থসংঘাত লেগে গেলে তো পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এখানে মধ্যপন্থা খোঁজা খুব মুশকিল। এটা অলিখিত সত্য যে, ভ্রূণ যত পরিণত হয় তার নৈতিক মর্যাদাও তত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে শারীরিক সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হবার আগে পর্যন্ত মায়ের অধিকারই শেষ কথা। তাই গর্ভধারণের মত গর্ভপাতেও থাকা উচিত নারীর সম্পূর্ণ অধিকার। আইনের বিধান বা চিরায়ত পিতৃতন্ত্র যেন কোন ভাবেই তার অধিকারকে খাটো করতে না পারে। দিনের শেষে চিকিৎসক, বিচারক, সমাজ সংস্কারক যখন ঝাঁপ বন্ধ করে চলে যান, অসহায় নারী পড়ে থাকেন একা। এমনকি তাঁর বা নবজাতকের জন্য থাকে না কোন সামাজিক সুরক্ষা। জীবনভর তাঁকেই বয়ে বেড়াতে হয় সব দায়ভার। কাজে কাজেই…
”নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার?”