দুঃসহ দিনের স্মৃতি এবং সরকার
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের মনে রাখার ক্ষমতা বোধহয় কমে আসছে। দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে নানা ঘটনা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমরা মনে রাখতে পারছি না…. নাকি মনে রাখতে দিচ্ছে না? কারণ ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যে নানা ব্যবস্থাপনায় কোনো খামতি রাখেনি শাসকেরা। তবে চাইলেও ভুলে যাওয়া যায়নি অতিমারীর অভিঘাতে, কাজ হারিয়ে, পেটের আগুন নেভাতে লঙ্কা ক্ষেত থেকে ফিরতে চেয়ে, হেরে যাওয়া জামলো মকদমকে। চেষ্টা করেও ভোলা যাচ্ছে না রেল লাইনে ছড়ানো রুটি, বাঁচার তাগিদে মাইলের পর মাইল হেঁটে ফিরতে গিয়ে মাংস পিণ্ডে পরিণত হওয়া পরিযায়ী মানুষগুলোকে। এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া পরিচয় হারানো শত শত ভারতবাসীর লাশ। ভোলা যাচ্ছে না দেশের রাজধানীতে কুড়ি লক্ষ টাকায় বিক্রি হওয়া কোভিড প্যাকেজ। কি করে ভুলে যাবো একটা নল থেকে পালা করে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টার বীভৎস দৃশ্য। স্বাস্থ্য নিয়ে লিখতে বসলে, ভুলে যাওয়ার অভ্যাসের মধ্যেও এখনো কিলবিল করে ওঠে দুঃসহ এই দৃশ্যগুলো।
হঠাৎ করে ঘাড়ের উপর এসে পড়া কোভিডকে কাবু করতে, প্রস্তুতি ও পরিকাঠামোর ঘাটতি মেরামতির জন্যে সরকারকে সময় দিয়েছিল দেশবাসী। ক্ষোভ হয়েছিল, রাগ হয়েছিল। স্বাধীনতার অমৃতকালেও আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কেন রেডি থাকবে না সেই প্রশ্নে। তবে বহু ক্ষয় ক্ষতি স্বীকার করেও মানুষ সময় দিয়েছিল সরকারগুলোকে। যাতে খামতি মিটিয়ে একটা শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কুলাঙ্গারের মতো, মানুষের দেওয়া সময় হেসে খেলে উড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্র এবং সঙ্গে দোসর আমাদের রাজ্য। না হলে সৎকারের জন্যে সন্তানের মৃতদেহ ব্যাগে ভরে বাবাকে ফিরতে হয় বাড়িতে? দুর্ঘটনায় আহত তরতাজা যুবককে পিংপং বলের মতো এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে লাট খেয়ে, মাটিতেও জায়গা না পেয়ে, বাড়িতে গিয়ে মরতে হয়? পরিচিত স্বাস্থ্যকর্মীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্যে গভীর রাতে দৌড়াতে হয় প্রাক্তন মন্ত্রীকে? একটা বেডের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে আক্ষেপ করতে হয় আগের সরকার থাকলে দু মিনিট লাগতো ভর্তি করতে। কয়েক দশকের ভয়ঙ্করতম রেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষগুলো চিকিৎসার জন্যে রাজ্যের হাসপাতাল ছেড়ে উড়িষ্যার হাসপাতালে চলে যাচ্ছে এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে দেখতে হয় আমাদের? এসবের কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয় না। বরঞ্চ টুকরো টুকরো এই ছবিগুলো থেকেই ধারণা করা যায় রাজ্যের স্বাস্থ্যের অস্বাস্থ্য। আমাদের ধারণা ছিল কোভিডের দুঃসহ স্মৃতির পরে সরকার সক্রিয় হবে। মানবিক হবে। তবে যে সরকার ন্যায্য দাবি করলে বলে ঘেউ ঘেউ করবেন না, মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখুন, কেন্দ্রে চলে যান…. তার কাছে বেশি কিছু আশা করা বৃথা। শহরের হাসপাতালগুলোর বাইরের চেহারার কিছু পরিবর্তন হলেও, ভেতরটা একই রয়ে গেছে। সুদৃশ্য গেট, নিলসাদা রঙের প্রসাধনী উন্নয়নে স্বাস্থ্যের কঙ্কালসার চেহারা কিছুতেই আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। অনুন্নত অঞ্চল উন্নয়নের টাকায় সুপার স্পেশালিটি নামে কিছু সুদৃশ্য ঘর বাড়ি তৈরি হলেও,পরিষেবা পাল্টে গেছে বলে শোনা যায়নি। সুপার স্পেশালিটি দূর অস্ত, স্পেশালিটি সার্ভিসও সব ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না। না হলে কেন প্রতিদিন আমাদের দেখতে হবে এই সমস্ত হৃদয় বিদারক ঘটনা? কেন চলতেই থাকবে দালালের দাপাদাপি। কেন ট্রলি পেতে, ট্রলি থেকে বেডে উঠতে, স্ক্যান, ইউএসজির জন্যে নিয়ে যেতে রুগীকে গুনতে হবে গাঁটের কড়ি? কেন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে করতে হবে অপেক্ষা? কেন সাধারণ অপারেশনের ডেট পেতেও বছর ঘুরে যাবে? কেন আউটডোরের আতঙ্কের লাইন থেকে মুক্তি পাবে না অসুস্থ রুগী? বিনামূল্যে চিকিৎসার ফ্লেক্স, ব্যানার, হোর্ডিংয়ে ভরে যাওয়া রাজ্যে কেন মানুষকে ঘটিবাটি বেচেতে হবে স্বাস্থ্যের জন্যে? সংবিধানে দেওয়া অধিকার তাহলে গেল কোথায়?
ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণেই গ্রামীণ স্বাস্থ্য…
গ্রাম বাংলার মানুষ বর্তমানে তার নিজের স্থানীয় সরকার তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। অবশ্য বলা ভালো তারা চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে লুম্পেন, দুস্কৃতী নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে তােরা আদৌ নিজের পঞ্চায়েত তৈরির অধিকার পাবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদের রাজ্যের সাম্প্রতিক সময়ের ঐতিহ্য মেনে চলছে বিরামহীন রক্তপাত, খুন, বিস্ফোরণ, হুমকি, বাইক বাহিনীর দাপাদাপি। কেন্দ্রীয় বাহিনী আটকাতে খরচ হচ্ছে জনগণের ট্যাক্সের টাকা।
গ্রামীণ সমাজে গোটা মাসের মুদি মসলা, চাল ডালের বাজেট থাকলেও, বেশিরভাগ মানুষের স্বাস্থ্যের কোনো বাজেট থাকে না। হঠাৎ করে আসা বিপদে পোষা গরু-বাছুর, জায়গা-জমি, ঘটি-বাটি বেচে দেওয়ার ঘটনা আখছার শুনতে পাওয়া যায়। গ্রামীণ মানুষের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যার ৯০ শতাংশই সাধারণ জ্বর-জ্বালা, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়ার মতো রোগ, পরিশ্রুত জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা হলেই যার প্রকোপ অনেকাংশে রুখে দেওয়া যায়। এসবের জন্যে আমাদের দেশে কিছু প্রকল্প চালুও আছে । কিন্ত আমাদের রাজ্য সরকার প্রকল্পগুলির নাম পরিবর্তনে যতটা তৎপর, রূপায়ণে ততটাই অনাগ্রহী। ন্যাশনাল হেলথ মিশনের অন্তর্ভুক্ত নানা প্রকল্পের টাকা ফেরত যাওয়ার খবর মাঝে মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে। নানা ছুতোনাতায় বছরের অনেকটা সময় স্কুল বন্ধ রাখাই আমাদের রাজ্যের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে সরকার মিড-ডে মিলের টাকা বাঁচাচ্ছে, অন্যদিকে খাদের কিনারায় চলে যাচ্ছে শিশুর পুষ্টি। তবে গ্রামের মানুষের চাহিদা কম। অল্পেই তারা সন্তুষ্ট। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো কথা বললেই তারা খুশি। সরকার অবশ্য গ্রামে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগে উদ্যোগী বলে মনে হয়ও না। বেশিরভাগ হেলথ সেন্টার, ব্লক হাসপাতালে বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীর পদ ফাঁকা পড়ে আছে। রাজ্যে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তার তৈরি হলেও বিগত তিন বছর নিয়োগ বন্ধ আছে। একদিকে সরকারি হাসপাতাল ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মেডিক্যাল কলেজ খোলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে, আর অন্যদিকে গরিব গ্রামীণ মানুষের জন্যে বরাদ্দ হচ্ছে ডিপ্লোমা ডাক্তার। সরকার কি গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যের দায় এড়াতে চাইছে? নাকি স্বাস্থ্য ব্যবসার জন্যে খোলা বাজার করে দিতে চাইছে? গ্রামের মানুষ আর শহরের মানুষের জীবনের দাম কি আলাদা হতে পারে?
গাঁ-গঞ্জের সঙ্গে যাঁদের একটু যোগাযোগ আছে তাঁরা নিশ্চইয়ই জানেন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাগুলোতে এখন মুদি, চা, বিড়ি, সিগারেটের দোকানের চেয়ে ওষুধের দোকান, ডায়াগনস্টিক ল্যাবের সংখ্যা বেশি। গজিয়ে উঠছে অসংখ্য পলিক্লিনিক,ছোট ছোট নার্সিং হোম, যাদের নূন্যতম পরিকাঠামো আছে বলে মনে হয় না। হেলথ সেন্টার, ব্লক হাসপাতাল, গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে যদি চিকিৎসা পাওয়া যেতো, প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যেত, সাধারণ পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে ব্যাঙের ছাতার মতো ওষুধের দোকান, ডায়াগনস্টিক গজিয়ে উঠবে কেন? চাহিদা না থাকলে,মুনাফার সুযোগ না থাকলে কেউ লগ্নী করবে? যে মানুষের রুটি রুজি দিন মজুরি, সে কাজ কামাই করে, দীর্ঘ লাইন দিয়ে শুধু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিতে যাবে কেন? প্যান্ডেডেমিকের আকার নেওয়া উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ওষুধ কি পাওয়া যায় গ্রামের হাসপাতাল গুলোতে? দীর্ঘদিন মেরামত না হওয়ায় জরাজীর্ণ বেশিরভাগ ব্লক, গ্রামীণ হাসপাতাল, এমনকি কিছু জেলার মেডিক্যাল কলেজেও ভর্তি হলে বাড়ি থেকে চাদর বালিশ নিয়ে যাওয়াই দস্তুর। মরচে ধরা লোহার বেডে তোষক থাকলেও, সেগুলো শতছিন্ন, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, ছারপোকার নিশ্চিন্ত আশ্রয় স্থল। তাও সবার জুটবে এরকম নয়। মাটিতে ভর্তি হতে পারলেই যথেষ্ট। বেশিরভাগ লেবার রুমগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। বহু গ্রামীণ হাসপাতালে আলাদা আউটডোর বিল্ডিং নেই। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, টিনের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে চিকিৎসা পাওয়াই দস্তুর। ওষুধ ছেড়ে দিন,অভিযোগ আসছে স্যালাইনও নাকি কিনতে হচ্ছে। গ্রামের মানুষের জন্যে আউটডোর হওয়া উচিত বিকালে। দিনের কাজ শেষ করে বিকালে ডাক্তার দেখাতে পারলে তাদের রুজি বাঁচে। দিনের দিন পরীক্ষা নিরীক্ষা হলে, ওষুধের পুরো কোর্স একসঙ্গে দেওয়া হলে, গ্রামীন মানুষের সুবিধা হয়। রুজি নষ্ট করে, জ্বর,জ্বালা সর্দি কাশির মতো সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্যে দিনের পর দিন হাসপাতালে আসা সম্ভব? বিনা পয়সায় চিকিৎসার ফ্লেক্স, ফেস্টুন হোর্ডিংয়ে রাজ্য ভরে গেলেও, কতো গ্রামীণ মানুষ শুধু স্বাস্থ্যের জন্যে, প্রতিদিন দারিদ্র সীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, তার খবর সরকার রাখে?
ঢাক ঢোল পেটানো স্বাস্থ্যসাথীর আওতা থেকে বাদ চলে গেছে হার্নিয়া, হাইড্রোসিল সহ বেশ কিছু অপারেশন। অথচ এই অপারেশনগুলোই বেশি সংখ্যক মানুষের প্রয়োজন হয়। হাড়ের অপারেশন এই প্রকল্পে করাতে গেলে সরকারি হাসপাতালের সার্টিফিকেট লাগছে। নার্সিং হোম, কর্পোরেট হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী শুনলে মুখ বেঁকিয়ে উদাস হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় প্রমাণ বকেয়া থাকলে তারাই বা কি করবে? ধার বাকিতে কতদিন আর ব্যবসা চলতে পারে। আউটডোর চিকিৎসার ওষুধ,পরীক্ষা নিরীক্ষা আবার স্বাস্থ্যসাথীর বাইরে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতেও এখন লাগছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। গোটা পরিবারের জন্যে বরাদ্দ টাকা, সরকার নিজের বিজ্ঞাপিত বিনা মূল্যের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে কেটে নিচ্ছে। তাই বলে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে ভর্তি হলে, ছারপোকা হীন ভালো বিছানা পাওয়া যাবে, অপারেশনের তারিখ আগে পাওয়া যাবে বা পরীক্ষা দিনের দিন হয়ে যাবে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। গ্রামীণ মানুষের আর এক বিপদ রেফার। এমনিতেই রেফার হলে খোরাকি দিয়ে লোক নিয়ে শহরে আসতে হয় গ্রামীণ মানুষকে। রেফার হওয়া রুগীর শহরের হাসপাতালে ভর্তির নিশ্চয়তা না থাকায় নার্সিং হোম, কর্পোরেট হাসপাতালগুলো ফাঁদ পেতে রাখে আপ্যায়নের জন্যে। ফলে রেফার রুগীর কার্যত ঘটি বাটি বিক্রির জন্যে রেডি হয়েই যেতে হয়। আবার কেন রেফার হচ্ছে বলাও মুশকিল। কারণ শুধু গ্রামীণ হাসপাতাল নয়,জেলা, এমনকি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোতেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেই, ডাক্তার নেই, স্বাস্থ্যকর্মী নেই। সব মিলিয়ে এক বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ মানুষ স্বাস্থ্যের জন্যে গরিব থেকে আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে, দারিদ্র সীমার নীচে চলে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে সরকারি পরিকল্পনায় গ্রামীণ স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা।
১ লা জুলাই, ২০২৩ গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত।