চাচার সাথে আমার আলাপ ফুলবেড়ে ইএসআই হাসপাতালের বেডে। জুটমিলের শ্রমিক হিসেবে চাচা ভর্তি। সিওপিডি পেসেন্ট। মাঝে মধ্যেই ভর্তি হত। একটু সুস্থ বোধ করলেই চাচা নানান গল্প শোনাতো। চাচার চাকরি জীবন প্রায় শেষ হয়ে এলো। চাচার ইচ্ছে চাকরি শেষে পি এফ-এর জমানো টাকা হাতে পেলে সে ফিরে যাবে কাশীপুর গ্রামে।
মাঠের ধারের নিজের ছোট্ট বাড়িটায় গিয়ে মেরামতি করাবে, নতুন করে খড়ের ছাউনি লাগাবো। পাশে ছোট হলেও একটা পুকুর কাটাবে। নতুন করে সাজাবে। আমায় বলতো, বুঝলে ডাক্তার একদিন সময় করে চলে আসবে আমার ওখানে। তোমায় দেখাবো গোয়াল ঘরখানা, নিয়ে যাবো টানতে টানতে। ওরা তখন আরামে গামলায় মুখ ডুবিয়ে খেতে ব্যস্ত। বলতে বলতে চাচার চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে আসতো। নিজের শিরা বের করা হাত দুটোর দিকে তাকাতো চাচা। যে হাতে বাটাম তুলে চাচা মেরে ছিল তার আদরের দুলালকে একদিন সেই প্রচন্ড রাগের মাথায়।
চাচার কথায় স্পষ্ট ছবির মত দেখতে পেতাম। দেখতে পেতাম সেই হাত দিয়ে চাচা তার আদরের নতুন দুলালদের গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওরা হাম্বা বলে ডাক ছাড়ছে। চাচার কল্পনায় চাচা দেখতো পেত যে দূরে জমিদার বাড়িতে শুয়ে শুয়ে পক্ষাঘাতে বিছানা নেয়া শিবচরণ বাবু শুনতে পাচ্ছে সেই হাম্বারব। আমিনা দিদি এসে চাচা আর আমার সামনে ধরছে ফেনা ওঠা দুধের গেলাস। বাবলা তলায় কার যেন ছায়া পড়ছে বিকেলের পড়ন্ত আলোয়। কুষ্ঠরোগে বেঁকে যাওয়া আঙ্গুল দিয়ে কোনোক্রমে বাটিটা এগিয়ে ধরে ভিক্ষে চাইছে তর্করত্ন মশাই। চাচার গল্পটা বড্ড চেনা চেনা লাগতো, ধরতে পারতাম না।
তারপর একদিন গল্প গল্পই থেকে যায়। চাচার কারখানা লক আউট হয়ে যায়, মালিক পিএফ-এর টাকা মেরে চম্পট। চাচা এবার আরো অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়। চাচার অবর্তমানে তার আদরের আমিনাকে আড়কাঠির হাতে বেচে দেয় ফুলবেড়ে বস্তির মস্তান। চাচার আর ঘরে ফেরা হয় না। আমারও কাজের পালা শেষ হয়ে আসে।
চাচার নামটাই এদ্দিন জানা হয় নি। ফুলবেড়ে ইএসআই হাসপাতালে বসে আমার শেষ লেখা ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসে জানতে পারি। গফুর মিয়া। হাসপাতাল সুপার মাথা চুলকে পাশে এসে দাঁড়ান। কি বিপদ বলুন তো, পেসেন্টের তো কোনো নেক্সট অফ কিন নেই যাকে বলে পেসেন্ট পার্টি। এই ডেডবডি নিয়ে এবার কি করবো? ডেড বডি শব্দটা মনে ধাক্কা দেয়। পুরোনো বেড হেড টিকিট গুলো বার করে খুঁজতে থাকি। এইতো লেখা আছে। নেম গফুর মিয়া, এজ সেক্স: ফরটি ফাইভ মেল, এড্ড্রেস: কেয়ার অফ শ্রী শরৎ সি চ্যাটার্জি, সামতাবেড়, হাওড়া।
বিদ্যুৎ চমকের মতো সব মনে পড়ে যায়। সেই কবে দশ বছর বয়সে বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় বিকেলের আলোয় পড়ে ছিলাম। পড়ে ছিলাম আর কেঁদে ছিলাম। লজ্জায় কাউকে কোনোদিন বলতেই পারিনি। সুপার সাহেবকে বলি যে স্যার এ ডেডবডি বেওয়ারিশ নয়। কেউ না দিলে এই মানুষটিকে মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো। এ আমার ঋণ।
গফুর চাচার কাছে আমার এই ঋণ পঞ্চাশ বছর ধরে জমা হয়ে আছে। এ ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। আজ আমার আরেকবার কেঁদে নেওয়ার দিন। সেই দশ বছর বয়সে যেমনটা কেঁদেছিলাম, তেমনটা আরেকবার কাঁদবো মহেশের গলা জড়িয়ে ধরে।
মহেশকে বাঁচাতে না পারার, আমিনাকে বাঁচাতে না পারার, গফুরকে বাঁচাতে না পারার পাপে আমি পাপী। পাপী মানুষদের কাঁদতে হয়। কাঁদতে পারলে অন্তত বুঝতে পারবো এখনো একটু খানি মানুষ আছি, পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যাই নি। কমোডিটি ফেটিশ ভর্তি এই নিষ্ঠুর নাগরিক বিশ্বায়নের পৃথিবীতে আমাদের অমানুষ হওয়ার হাত থেকে যে মানুষটি দিয়ে বাঁচিয়ে গেছেন তার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি মরতে পারেন না। বেঁচে থাকবেন, তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে।