অনেকদিন পর আবার নতুন স্ক্যালপেল।
মায়া এক আশ্চর্য প্রহেলিকা। এর নরম, সরু সুতোর জাল মানুষ নিজেই বোনে, নিজেই স্বেচ্ছায় তাতে জড়িয়ে পড়ে। তার আত্মাকে স্বেচ্ছায় সে সঁপে দেয় মায়ার কাছে। এই সমপর্ণেই যেন তখন তার শান্তি, তার আনন্দ।
কয়েক মাস আগের কথা। ব্রেস্ট ক্লিনিকে রুগী দেখছি। ইংল্যান্ডে স্তনের ক্যান্সারের প্রকোপ বেশ ভাল রকমের। এই দেশে তাই সেই ক্যান্সারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে ফেলার বিভিন্ন রকমের ফাঁদও পেতে রাখা আছে। পঞ্চাশ বছর বয়স হলেই নিয়ম করে স্তনের এক্সরে করা হয়। মেয়েদের বারবার শিক্ষা দেওয়া হয় নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখার জন্য। সন্দেহজনক কোন ‘লাম্প’ হাতে ঠেকলেই সে ছুটবে জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা ‘জিপি’র কাছে। জিপির দায়িত্ব তখন তাকে আমাদের কাছে পাঠানো। দু’সপ্তাহের মধ্যে সেই রুগীর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে দিতে হবে, কড়া নিয়ম আছে। তাই এই দেশে স্তনের ক্যানসার হলেও তা খুব আর্লি স্টেজে ধরা পড়ে যায়। সহজে তাকে সারিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, খুব কম সংখ্যক রুগী মারা যান এখন এতে। আমার ব্রেস্ট ক্লিনিকের কাজ জিপির পাঠানো রুগীদের পরীক্ষা করে তাদের প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো। ক্যান্সার ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে।
আমার সেদিনের ক্লিনিকে ততক্ষণে বেশ কয়েকজন রুগী দেখা হয়ে গেছে। ক্লিনিকে আমার সঙ্গে আছে নার্স মার্গারিট। আট নম্বর রুগীকে নিয়ে সে ক্লিনিকরুমে ঢুকল।
জুলি ব্রডির বয়স আশি। আমার সামনের চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে মার্গারিট অন্য আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। আমি তার আগেই তার নাম দেখে রেখেছি জিপির পাঠানো ‘রেফারেল লেটারে’। তাতে আরো লেখা আছে, ‘লাম্প অন রাইট ব্রেস্ট।’ জুলির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম, “হাই জুলি, আমি অনির্বাণ, আজকে আমি আপনাকে পরীক্ষা করব।”
জুলি বলল, “ভেরি সরি ডক্টর। তোমার কথা আমি শুনতে পাইনি। আ বিট ডেফ ইন বোথ ইয়ারস। কিছুদিন হল আমার হিয়ারিং এডটাও প্রবলেম করছে।”
আমি মজা করে গলা চড়িয়ে বললাম, “আচ্ছা, নো প্রবলেম, আই উইল শাউট অ্যাট ইউ।”
এই কথায় জুলি হাসতে লাগল। আমরাও হাসলাম। এরপরের কথোপকথন এইভাবেই হল, আমি জুলির অনেকটা কাছে গিয়ে একটু উঁচু গলায় প্রশ্ন করি, সে উত্তর দেয়। জানলাম গত কয়েকমাস যাবৎ ওর ডানদিকের স্তনে নাকি একটা শক্ত অংশ তৈরি হয়েছে।
“এতদিন আগে হয়েছে, আগে এলেন না কেন?”
“অতটা খেয়াল করিনি তো। আর বরটিও এখন আমার বুকের দিকে তেমন নজর দেয় না।”
জুলির রসিকতায় আবার হাসলাম তিনজনে। আমি মজা করার জন্য বললাম, “আজকে স্বামীকে নিয়ে এলেই তো পারতেন, ওকে দেখিয়ে দিতাম কী করে আপনার সঙ্গে গলাবাজী করতে হয়।”
এই কথায় জুলি চুপ হয়ে গেল। ওর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল ও। বলল, “পিটার ভাল নেই।”
এমন উত্তর আমি আশা করিনি। তাই কী বলব বুঝতে পারলাম না। মার্গারিট জুলির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “কী হয়েছে ওর?”
“ডিমেনশিয়া। পিটারকে এখন বাড়ির মধ্যেই রাখি সারাদিন। বাইরে বেরোলে রাস্তা চিনতে ভুল করত, আজকে একজন প্রতিবেশীকে বাড়িতে ওর কাছে রেখে এসেছি।”
আমি বললাম, “ওহ, সরি। এরকম মজা করাটা আমার ঠিক হয়নি।”
জুলি আমার এই কথার উত্তর দিল না। ওর চোখদুটো তখনও যেন দিগন্তে আটকে রয়েছে। ও আমি বা মার্গারিট কারোর দিকেই তাকিয়ে নেই। ও বলল, “পিটার আমাকে আর চিনতে পারে না।”
এই বলেই জুলি শিশুর মতো কেঁদে উঠল। আমার সামাজিকতার বোধের অভাব আছে, এই কথায় চুপ করে গিয়েছিলাম। মার্গারিট চেয়ার থেকে উঠে টিস্যু নিয়ে এসে জুলির হাতে দিল। জুলি তাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমি সরি, এই বয়সে এসে কোন ইমোশনই যেন আর নিজের বশে থাকে না। একটুতেই অনেক হাসি, একটুতেই চোখে জল এসে যায়। আই অ্যাম সরি তো এমব্যারাস ইউ টু। আমার আর পিটারের বিয়ে হয়েছে ৫০ বছর আগে। তখন আমি তিরিশ, পিটার পঁচিশ। বুঝে শুনে কমবয়সী ছেলেকে বিয়ে করেছিলাম, সো দ্যাট আই ক্যান হ্যাভ এনাফ অফ হিস ইয়ুথ।”
এই বলে জুলি চোখ টিপেই হাসতে লাগল। ঘরের গুমোট আবহাওয়াটা যেন কাটল এতে। আমরা হাসলাম আবার।
“সেই পিটারই কেমন হয়ে গেল, এখন সারাদিন ডাইনিং রুমের সোফায় বসে থাকে। ও সব ভুলে গেছে। আমাদের বাড়ি, আমাদের কথা, আমাকে, সব। বাট স্টিল হি ইজ মাইন। ওর খেয়াল রাখতে রাখতে আমার দিন কোথা দিয়ে কেটে যায়।”
এই কথাগুলো বলতে বলতেই আবার জুলির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। মনে হল আবার ও এই ক্লিনিকে নয়, কোন নির্জন প্রান্তরে বসে কোন অসীমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি আবার গলার জোরে কেজো কথায় ফিরে এলাম। জুলিকে কিছু প্রশ্ন করার পরে তৈরি হলাম ওকে পরীক্ষা করার জন্য। ও নার্স মার্গারিটের সঙ্গে পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
আমি পর্দার ওপাশে যাওয়ার পরেই বুঝলাম জুলি অনেক দেরী করে ফেলেছে। টিউমারটা ছোট নয়, ওর ডান স্তনের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অংশের দখল নিয়েছে। টিউমারের ওপরের চামড়া পাতলা হয়ে গেছে, তাতে কালচে নীল শিরা উপশিরা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জুলির ডান বগলেও বেশ কয়েকটা লাম্প পেলাম, ক্যান্সার লিম্ফনোডে ছড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা এত বড় হয়ে গেছে, আর বলছেন খেয়াল করেননি?”
জুলি মুচকি হেসে বলল, “অলওয়েজ ওয়ান্টেড বিগার ব্রেস্টস, গট ওয়ান অ্যাট লিস্ট।”
আমার আর হাসি পেল না, চুপ করে পর্দা ঘেরা জায়গার বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় ততক্ষণে বুঝেছি যে টিউমারটা যতটা বড় হয়েছে তাতে বুকের সিটিস্ক্যান করলে হয়ত দেখা যাবে ক্যান্সার লাংসেও ছড়িয়েছে, স্টেজ ফোর। এই বয়সে কেমোথেরাপির ধাক্কা জুলি নিতে পারবে? ওকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
জামা পড়ে নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল জুলি। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কমপিউটারের দিকে তাকিয়ে জুলির জন্য এক্সরে, বায়প্সির রিক্যুয়েস্ট করছিলাম আর ভাবছিলাম, সত্যিই কি জুলির এখন জানার প্রয়োজন যে ওর বুকের মাংসপিন্ডটা ক্যানসার? জুলি যাতে শুনতে না পায় তাই মার্গারিটের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললাম, “ভাবছি এখনই ওকে বলব না যে ওর লাম্পটা খুব সম্ভবত ক্যান্সার।”
মার্গারিটও তখন একমত হল আমার সঙ্গে। বায়পসি রিপোর্ট আসতে ১০ দিন লাগে। ততগুলো রাত এই আশি বছরের বৃদ্ধা নাই বা জানলেন তার বুকে বাসা বাঁধা মারণরোগের কথা, ততদিন একটু শান্তিতে ঘুমোন না হয়। এতটুকু তো আমরা করতেই পারি। জুলিকে বললাম আপনাকে এই টেস্টগুলো দিলাম, আজকেই হয়ে যাবে। এখনই চিন্তার কিছু নেই, রিপোর্ট এলে আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। জুলিও ‘আচ্ছা’ বলে উঠে পড়ল।
জুলির পরে আমি আরো পাঁচজন রুগীকে দেখে সেদিনের মতো ক্লিনিক শেষ করলাম, এবারে বাড়ি ফিরব। লিফট দিয়ে একতলায় নেমে পার্কিং লটের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, খেয়াল করলাম একটা চেয়ারে জুলি বসে আছে। বুঝলাম ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে ও। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। জুলিও দেখতে পেয়েছে আমাকে, সেও হাসল আমাকে দেখে। জুলি হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল, আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি জুলির মুখে তখনও হাসি লেগে রয়েছে। ডান হাতটা মাথার উপরে তুলে ও আমাকে বলল একটু মাথাটা নিচু করো, আমি করলাম। ও নিচু স্বরে বলল, “ক্যানসার, তাই তো?”
আমি যেন তড়িতাহত হলাম। জুলির দিকে তাকালাম, কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও বলল, “তুমি বেশ সেন্সিবল কাজ করেছ ডাক্তার, বুড়িকে স্ট্রেস দেবে না ভেবেছিলে। কিন্তু আমি কানে কালা হতে পারি, চোখে তো এখনও বেশ ভালই দেখি। দেখলাম কম্পিউটারে আমার ইনভেস্টিগেশনের রিক্যুয়েস্ট করার সময় লিখলে সাসপেকটেড ব্রেস্ট ক্যান্সার। কী তাই তো?”
বলেই বৃদ্ধা খিলখিল করে হাসতে লাগলেন আবার। আমার মুখ দিয়ে শুধু সরি টুকু বেরোল। জুলি তার উত্তরে বলল, “আই ডিডন্ট মাইন্ড অ্যাট অল, তুমি শুধু আমাকে বল আমি আর কতদিন বাঁঁচব, পিটারের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে হবে তো। ডিমেনশিয়া ইস নট গোয়িং টু কিল হিম সুন।”
আমি বললাম, “এখনই বলা যাবে না। আগে রেজাল্টগুলো আসুক।”
“লায়ার।” এই একটা শব্দ বলে জুলি আর কিছু বলল না। ওর মুখের হাসি তখন আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখে সেই শূন্য দৃষ্টি। ট্যাক্সির অপেক্ষা এখন যেন অনন্তকালের। আমি এবারে পার্কিংলটের দিকে হাঁটা লাগালাম। পিছনে ফিরে আর তাকাইনি, সেই সাহস ছিল না।
জুলি সেদিন যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন ওর স্বামী পিটার হয়ত বাড়ির ডাইনিং রুমের সোফায় বসে আছে। জুলি বাড়ি ফিরলে সে হয়ত তাকিয়েও দেখেনি, জানতে চায়নি ডাক্তার কী বলল। জুলির ক্যান্সার হওয়ার কষ্টটা ওর একার। কিন্তু এই মারণ রোগের খবরে ও নিজের জন্য চিন্তিত নয়, ওর চিন্তা পিটারের খেয়াল কে রাখবে। যে পিটার ওকে আর চিনতে পারে না।
দীর্ঘ দাম্পত্যে ভোর, সকাল, দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল নামে তখনকার সেখানে জরা, ব্যাধি এসে পাকাপাকি ভাবে বাস করা শুরু করে দিয়েছে। পুরুষটি তার স্ত্রীর মুখটিকে ভুলেছেন, তার সঙ্গে বাস করা নারীটির কোন অস্তিত্ব তার কাছে নেই। সেই মেয়েটির বুকের ক্ষতর থেকেও এই না চিনতে পারার ক্ষত অনেক গুণে বড়। তবু তার মনের সবটা জুড়ে ওই ক্রমে পাথর হয়ে যেতে থাকা মানুষটা, যে এককালে ওর দিকে তাকিয়ে হাসত। এই দাম্পত্যের কতটুকু শুধু দায়িত্ববোধের জন্য? কতটুকু প্রেম? কতটুকু নির্ভরতা?
নাকি গোটাটাই আসলে সেই আশ্চর্য মায়ার জাল? যাকে মানুষ নিজেই বুনে নিজেই তার গিঁটে, ফাঁসে জড়িয়ে পড়ে।
অ সা ধা র ণ