প্রতিটা মানুষ একটা বৃত্তের মতো। তার আশেপাশের মানুষ গুলোর বৃত্তের খুব কাছাকাছি চলে আসে সে। কিন্তু সমাপতন কি হয় আদৌ?
||
গত বছরের এই সময়ের কথা, আমি অন কলে আছি, আমার জুনিয়র ম্যাথিউ এসে খবর দিল বছর চল্লিশের একজন রুগীকে ভর্তি করা হয়েছে সার্জারি ওয়ার্ডে, জেমস স্টুয়ার্টের নাকি তিন ধরে পায়খানা হচ্ছে না, পেট ফুলে গেছে, খুব ব্যথাও হচ্ছে।
জেমসকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে যখন ঢুকলাম তখন ওর সাথে ওর স্ত্রী মার্গারেট আর দুই কন্যাও বসে আছে। সবারই মুখে চিন্তার ছাপ। জুনিয়র সার্জেনটি গোটা হিস্ট্রিটা আমাকে আবার বললেন, আমি চুপ করে শুনলাম সবটা।
এবারে মার্গারেট আমাকে বলল,- আমি খুব চিন্তায় আছি ডক্টর, আর দু’ঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট, মাদ্রিদে যেতে হবে একটা মিটিংয়ের জন্য। এদিকে জেমসের এই অবস্থা, ওকে ছেড়ে যেতেও ভয় লাগছে।
– ফিরবেন কবে?
– পরশুর সন্ধ্যের ফ্লাইটেই ফিরে আসার কথা।
– তাহলে চলেই যান, জেমসের ব্লাডের রিপোর্ট তো সব ভালই। কন্সটিপেশনটা কেন হচ্ছে সেটা বোঝার দরকার। সেটা বার করতে আমাদের একটা দিন লাগবেই। চিন্তার কিছু নেই, আপনি ঘুরে আসুন।
এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে মার্গারেট ঠিক করল মাদ্রিদ চলেই যাবে। আরো মিনিট কয়েক বসে দুই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা রাতে দিদিমার কাছে থেকে যাবে। মেয়েরা বেরোবার আগে একে একে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। আমাকে যাওয়ার আগে বলে গেল,- প্লিজ লুক আফটার মাই ড্যাড ডক।
ওরা চলে যাওয়ার পরে ঘরে তখন শুধু আমি, ম্যাথিউ আর জেমস। আমি জেমসকে বললাম,- গ্রেট কিডস ইউ হ্যাভ গট মিস্টার স্টুয়ার্ট।
– থ্যানকস, উই লিভ ফর আওয়ার ফ্যামিলি ইসন্ট ইট?
– ইনডিড! নাও ক্যান আই প্লিজ একজামিন ইওর টামি ইফ ইট ইস অলরাইট? অ্যান্ড দেন আই হ্যাভ টু একজামিন ইওর বটম অ্যাজ ওয়েল।
-ঘোষ ক্যান আই টক টু ইউ ফর আ মিনিট প্লিজ?
এই সময়তেই আমার সাথে থাকা জুনিয়র ডাক্তারটি আমাকে ইশারা করে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। এরকম কন্সটিপেশন নিয়ে রুগী এলেই তাদের পেট আর পায়ুদ্বার পরীক্ষা করে দেখতেই হয়। যদি সেখানে একটা টিউমার থাকে! যার জন্যই হয়ত মল বের হতে পারছে না। ম্যাথিউ আগেই সেই পরীক্ষা করে রেখেছিল। ডাক্তারিতে শিক্ষা এভাবেই হয়। জুনিয়ররা প্রথমে ক্লিনিকালি রুগীকে ভাল করে দেখে রাখে। তারপরে সিনিয়রদের সাথে মেলায়।
জেমসকে পরীক্ষা করে দেখার সময় ম্যাথিউর নাকি একটা জায়গাতে খটকা লেগেছে। সেটাই মাথা চুলকোতে চুলকোতে আমাকে বলল।
আমি আবার উইলিয়ামের ঘরে ঢুকলাম, পেটটা টিপে টুপে দেখলাম। নাহ, তেমন কিছু তো নেই। এবারে পায়ুদ্বারটা দেখতে হবে।
সেখানে গ্লাভস পড়া হাতের একটা আঙুল ঢোকাতেই কাঁটার মতো কিছু একটা এসে বিঁধল! বেশ শক্ত। ম্যাথিউ তাহলে এটার কথাই বলছিল। মনে মনে একটা আন্দাজ করলাম কি পেতে চলেছি। এমন রুগী আমি দেশে থাকাকালীন ও দেখেছি।
– আপনি কিছু লুকোচ্ছেন মিস্টার স্টুয়ার্ট।
– আমি? কই না তো?
– একটু ভেবে বলুন। আখেরে আপনারই কিন্তু ক্ষতি।
– আমি..আমি..
– আপনি বলুন, আমরা শুনছি।
ম্যাথিউকে বললাম ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে।
জেমস সমকামী, বলা ভাল উভকামী। তাই নিজেকে তৃপ্তি দিতে ও মাঝে মাঝে লম্বা কিছু জিনিস পায়ুদ্বারে প্রবেশ করাতো। জেমসের এই স্বমেহনের গোটা প্রক্রিয়াটাই ঘটত বাথরুমে। দিন দুয়েক আগে এক সন্ধ্যেবেলায় ওই কাজটিই করছিল ও। একটা ডিওডোর্যান্টের বোতল ঢোকায় নিজের পায়ুদ্বারে। ওই বস্তুটা নাকি আগেও অনেকবার ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেদিন কোন এক অদ্ভুত কারণে বোতলটা বার করার সময় ঢাকনাটা রেকটামের মধ্যেই আটকে রয়ে যায়। নিজে আঙুল দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও বার করতে পারেনি। এবারে বাধ্য হয়ে মল নরম হওয়ার সিরাপ খেয়ে নেয় অনেকটা। ভেবেছিল মলের সাথেই বেরিয়ে আসবে ঢাকনা। কিন্তু এর ফল হল উলটো। ঢাকনাটা চেপে বসে থাকায় মল তো বেরোলই না, উলটে পেট গেল ফুলে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে জেমসের পেটের এক্সরে করা হল। দেখা গেল ঢাকনাটা বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গেছে।
– এভাবে বেডসাইডে তো এটা বার করা যাবে না মিস্টার স্টুয়ার্ট। আপনাকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে আপনার ব্যাক প্যাসেজ দিয়েই বার করব। কিন্তু..
– আপনি প্লিজ যা করার আজকেই করে দিন ডক্টর। মার্গারেট ফিরে আসার আগেই। ও যেন কিছু জানতে না পারে। না হলে আমার ফ্যামিলিটা শেষ হয়ে যাবে।
রুগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা ডাক্তারের একটা বড় কর্তব্য। রুগী না চাইলে বাবা,মা, স্ত্রী যেই হোক না কেন, রোগের ব্যাপারে আলোচনা করা যায় না।
– না, আমরা কাউকে কিছু বলব না। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার আছে যেটা আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম।
– সেটা কি?
– এক্সরে তে দেখছি লিডটা অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। নিচ দিয়ে না বার করতে পারলে আপনার পেট কেটে ভিতর থেকে বার করে নিয়ে আসতে হবে ওটাকে।
আমার আশঙ্কাটাই সত্যি হল। সেদিন সন্ধ্যেবেলা থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করলেও ঢাকনাটাকে টেনে পায়ুদ্বার দিয়ে বার করতে পারলাম না। খুব বেশি টানাটানি করলে ওখানেই ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই পেট কাটতেই হল। উইলিয়ামের কোলন কেটে বার করে আনতে হল কমলা রঙের ঢাকনাটা।
এত বড় অপারেশনের পরে জেমস আর বাড়ি যেতে পারে নি। অন্তত দিন তিনেকের জন্য ওকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতেই হত। একদিন পরে মার্গারেট এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছিল। আমি জানি না জেমস ওকে কি বলেছিল, কতটা বলেছিল। কিন্তু যখন ওকে সন্ধ্যেবেলাতে দেখতে গেলাম তখন সেই ঘরে মার্গারেটও বসেছিল। দুজনের চোখের ভাষা ছিল অন্য। মনে হচ্ছিল যেন গত দু’দিনের মধ্যে দু’জনে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে।
||
জেমস উভকামী, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা কোন রোগও নয়। কিন্তু সংসারকে টিকিয়ে রাখতে হলে এটা ওকে স্ত্রীয়ের হাত থেকে লোকাতেই হত। সেই সংসার, যেটা নাকি মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখার জন্য তৈরি হয়। আর সেই সংসারকে বাঁচাতেই একজন মানুষ আরেকজনের থেকে আড়াল করে নিজেকে।
আপাত দৃষ্টিতে একদলা মাছের ডিমকে দেখলে মনে হয় একটা গোটা বস্তু বুঝি। আরেকটু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় ছোট ছোট প্রায় বৃত্তাকার অনেকগুলো ডিম। একে ওপরের সাথে এমন ভাবে লেগে আছে যে মনে হবে যেন ওদের মধ্যে কোন ফাঁকই নেই। কিন্তু মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেললে দেখা যাবে না তো, একটা সূক্ষ্ণ দেওয়াল আলাদা করে রেখেছে একটার থেকে আরেকটা ডিমকে।
আমরা মানুষগুলো আসলে ওই ডিমের মতো। এক একটা মানুষ এক একটা বৃত্ত। নিজের জীবনে সে আরো অনেক বৃত্তের কাছে আসে। কখনো কখনো খুব কাছে আসে। যেমন বাবা,মা,ভাই, স্ত্রী,সন্তান। কিন্তু কখনওই দুটো বৃত্ত মেলে না। সমাপতন হয় না ওদের। দুজনের মাঝে বরাবর একটা অদৃশ্য পর্দা রয়েই যায়। যতই কাছের মানুষ হোক না কেন, একজনের সবটুকুর ছোঁয়া আরেকজন পায় না।
প্রত্যেকটা মানুষই আসলে একা। খুব একা।