অনেকক্ষণ থেকেই আমি একটা কথা বলতে চাইছি। অন্ততঃ যদি কেউ একটা কাগজ কলম দিতো। আমার মুখ নাক সব একটা মুখোশে ঢাকা। গলার ভেতরে কষ্ট- কী একটা ভেতরে আটকে আছে।
সেদিন তখন সকাল। আমি বেরিয়েছি খাবার এনে আমি আর বুজুবুজু (বুজুবুজু আমার কুকুর) খেয়ে তারপর ওকে আদর টাদর করে কাজে বেরোবো। শ্রাবণী আকাশ। আধো অন্ধকার। দুটো একটা একলা বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। আমার ট্র্যাক প্যান্টের পকেট থেকে পিয়ানো বেজে উঠল। ফোন আসছে। সবে মুদির দোকানটা পেরিয়েছি। এখন স্কুটার থামিয়ে ফোন ধরলেই ভিজে যাবো। দোকানে গিয়ে ফোন করে নেবো। আবার ফোন বাজছে। উফফ মানুষ যে কী পরিমাণ অধৈর্য হয়! পিয়ানো থামলো। থেমেই আবার শুরু হলো একঘেয়ে টিং টং। তাহলে কি কোনও এমার্জেন্সি? ধরেই নি ফোনটা। বড় রাস্তা এসে গেছে। “হ্যালো হ্যালো…”
হঠাৎ একটা বাজ পড়ার মতো শব্দ, বিদ্যুতের ফলা এসে বুকের ডান দিকটা ছিঁড়ে দিলো, মাথায় একটা ভোঁতা ব্যথা… হেলমেট… আমার হেলমেট কৈ? তারপর থেকে অন্ধকার। এখন আলো দেখতে পাচ্ছি। বুজুবুজু কী খেলো কে জানে? ও নিশ্চয় গেটের সামনে থাবায় মুখ গুঁজে বসে আছে- ভাবছে এ্যাত্তো দেরী কেন হচ্ছে? একটা গাড়িতে শুয়ে শুয়ে কোথাও যাচ্ছি। আমার পিঠে লাগছে। কী ঠান্ডা আর শক্ত আমার পিঠের কাছটা।
“কনশাশ হয়েছে… ভালো… গত দুদিন তো আনকনশাশ পড়ে ছিল”
গাড়ি দাঁড়ালো। একটা কম আলোর ঘরে ঢুকলাম। হঠাৎ মাথার ওপরে জোরালো আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। সবুজ ঘাসের জামা পরে কয়েকজন ঘুরে ঘুরে মুখের ওপর নেমে এলো। হাতে মানুষের স্পর্শ। মনে হচ্ছে কতোদিন পরে মানুষের ছোঁয়া… একটু যদি বলতে পারতাম… বুজুবুজু খায়নি, আমার বড্ড লাগছে… মাগো। পুরো পিঠ বুক জুড়ে ঠান্ডা একটা নরম কিছু ঘসা হচ্ছে… হাত তুলে লেখার ভঙ্গি করলাম।বুজুবুজু…।
“পেশেন্ট রেসপন্স করছে… বেরা তুই তাড়াতাড়ি আন্ডার কর্… হাতে আর বেশী ব্লাড নেই”
“পেশেন্টের বাড়ির কেউ এসেছে?”
“ন্নাহ। বুড়োর বোধহয় কেউ নেই… ন্নে চল একটা জুয়ো খেলি। পাঁজর ভেঙে চুরে লাঙ্গস ফুটো করে দিয়েছে.. বোধহয় অ্যান্টিপ্লেটলেট কিছু খায়… অ্যাবসোলিউটলি নো ক্ল্যু…. মোবাইল ফোনটাও অ্যাক্সিডেন্টের সময় কেউ ঝেড়ে দিয়েছে….”
“যদি মালটা বেঁচে যায় তাহলে তোকে একটা ….ন্নে চল জ্জ্যয় মা বলে ভাসা তরী…”
বাঁ হাতে একটা কিসের খোঁচা লাগলো। বুজুবুজু ঘরে একা…. বুজুবুজু……
সব অন্ধকার হয়ে গেলো। অফিস লীগে টাকার জন্য খেপ ফুটবল…..। উল্টো দিক থেকে ওদের ডিভিশন খেলা স্ট্রাইকার আসছে…. এগিয়ে গিয়ে পায়ের ওপর থেকে বলটা বুকে তুলে নিলাম। স্ট্রাইকার ওর হাঁটু দিয়ে… পুরো ওজন দিয়ে আমার বুকের ওপরে পড়লো। ব্যথা… অসহ্য ব্যথায় বুকের ডান দিকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আআআহ সব ব্যথা চলে গেল। একবার খুব ছোটবেলায় …. উত্তরবঙ্গে জানালা দিয়ে দেখছিলাম একটা বড়ো গরু একটা ছোট্ট গরুকে চেটে দিচ্ছে। “মা ওরা কী করছে রে?”
“বড়ো গরুটা মা আর ছোটোটা ওর বাচ্চা… তপ্পি যেমন আমার বাচ্চা…. বড়ো গরুটা বাচ্চাটাকে আদর করছে”
“কই তুই তো আমায় চাটিস না?”
বুজুবুজু আমার মাথা চেটে দিচ্ছে। বুকের ব্যথার জায়গায় চেটে দিচ্ছে।
একবার খেলতে যাওয়ার সময় এক ঝড়বৃষ্টির বিকেলে ছাতা আর সাইকেল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়েছিলাম। একটা আধবুড়ো লোক কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো “কি হে ছোকরা, এই বয়সে পড়ে গেলে?”
“পড়ার কি আর বয়স আছে কাকু?” একটা দমকা হাসি পেট থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
চেতনার আরেকটা স্তর পেরিয়ে গেলাম। এখানে শুধু ঝাপসা আলো। দূরে দূরে একটা দুটো উজ্জ্বল আলো কাছে এগিয়ে এসে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার রাস্তায় পেরেক ছড়ানো। একটা একটা করে বাসের চারটে টায়ারই পাঙ্কচার হয়ে গেল। ইলামবাজারের জঙ্গল। দুপাশে ঘন কালো। এখানে ডাকাতরা এভাবে গাড়ি থামায়। গাড়ির রীম থেকে আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে। বাস থামিও না ড্রাইভার। জ্বলন্ত হাউইয়ের মতো বাসটা ছুটে চললো। সবুজ ঘাসের জামা পরে ড্রাইভার আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসেছে। সব অন্ধকার। ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিও না।
“সুরজিত সার্জিক্যাল প্লেইনে এসে গেছে। ন্নেহ এবার স্টার্ট কররে। আমি ইতিমধ্যে একটা ইন্টার্নকে ভারস্ট্যান্ডোমিটারের রিডিংটার কপি বার করতে বলি”
“হ্যাঁ দ্যাখা যাক জার্মানদের কারিগরি”
“তবে এর গ্র্যাফিক্যাল লাইনগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি… মালটা সার্জিক্যাল প্লেইনে ঢুকে গেছে… এনি হাও ইটস হেল্পফুল”
(কৃস্টোফার ডানকানের “সাবকনশাশ মাইন্ড রিডিং”এর ওপরে লেখা একটি বই এবং অজ্ঞানবিদ্যার অল্পবিদ্যা এই কল্পবিজ্ঞান গল্পটার ভিত্তি)