খালপাড়ে বাঁশঝাড়ে ঝুপসি আঁধারে একটা লোক বসে ছিলো। তখন সবে শ্রাবণসন্ধ্যার শহুরে ধোঁয়াশা ঘনিয়ে আসছে। দূরাগত গাড়ির হর্নের শব্দ আর গ্রাম্য শঙ্খধ্বনি মিলে যাচ্ছিল। আমাদের দশতলা বাবুদের বাড়িতে শঙ্খ বাজে না, সান্ধ্য উল্লাস আর টুংটাং বাজে। সঙ্গে মৃদু ললিত রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই হাতুড়ের নিবাস এখন এ শহরপ্রান্তে, বাঁশ জারুলের বনে। তাই দুচাকার ঘটঘট থামিয়ে টেকো হাতুড়ে ছায়াঢাকা ছায়াশরীরের পাশে গিয়ে বসলেন। হ্যাঁ বাঁশবনে খালপাড়ে সাপখোপের উপদ্রব আছে। তবু….
মানুষটা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। গোটা শরীরে কাঁপুনি। কাঁচাপাকা চুল, অশৌচকালের মতো দাড়ি, ময়লা ঘেমো জামা-এ তো চেনা মানুষ। মিশ্রভাই। মিশ্রজী। পাশের ভটচাজ পাড়ায় ভাড়ায় থাকেন। হাতুড়ে অপরের কান্না সইতে পারেননা, দুচোখে জল আসে-বয়সের সঙ্গে বাড়ছে এই রোগ।
“মিশ্রজী?” হাতুড়ে নিজেও বসে বুড়োর পিঠে একটা হাত রাখেন।
মিশ্রজীদের ছোট, মধ্যবিত্ত, সুখী সংসার-ভাবী আর অদিতিকে নিয়ে।
মিশ্রজী ফিরেও দেখেন না কে এসেছে, কাঁধে মুখ গুঁজে ডুকরে কাঁদতে থাকেন। ওনার এখন পাশে একটা পুরুষ মানুষ দরকার ছিলো। পুরুষ কাঁদলে বড়ো অসহায় হয়ে কাঁদে।
ওনার কান্নায় বারবার অদিতি নামটা আসছিলো। অদিতি মিশ্রজীর কন্যা। এক বছরও হয়নি বিয়ে হয়েছে। অদিতির কী হলো?
কান্না থামলে চায়ের দোকানে দুজনে বসলেন। মিশ্রজী ভাঁড়ে মুখও ঠেকালেন না। উদাস বলতে থাকেন “অদিতির বাচ্চা হবে খবর এসেছিলো। তারপর কী যেন মেয়েলী অসুখে রক্তপাত হয়ে মারা গেছে। বাচ্চা হবে বলে আপনার ভাবী জামা বানাচ্ছিলো। ছোট খাট কেনা হয়েছিলো”….
হাতুড়ে ওনার হাত থেকে ভাঁড়টা নিয়ে পাশে রাখেন।মিশ্রজীর হাত স্থির থাকছে না, চা চলকে যাচ্ছে। উনি মিশ্রজীর হাত ধরে গলির ভেতরে ওনার বাড়ি নিয়ে গেলেন।
ভাবী বসে আছেন। একটাই তো সন্তান ছিলো।
হাতুড়ে বললেন “কেন? কী হয়েছিলো? কী অসুখ….আমি তো কোনদিন…” গ্রাম্য হাতুড়ে বেশীরভাগ পরিবারকেই নামে, গোত্রে চেনেন।
ভাবী মুখ খোলেন “নসীব দাদা…পেটে মেয়ে এসেছিলো …..সবটা আমাদের নসীব। ললাটের লেখা কে বদলাবে?”
হাতুড়ে স্তব্ধ হয়ে যান। হাত বাড়িয়ে দেন “রিপোর্ট? আল্ট্রাসোনোগ্রাম রিপোর্ট কোথায়?”
মিশ্রজী ফোনটা খুলে ছবি এগিয়ে দেন।
“কই ছেলে মেয়ে কিছুই তো লেখা নেই… কে বললো মেয়ে এসেছিলো?”
ভাবী ফের চোখের জল মুছতে থাকেন। মিশ্রজী নিশ্চল টিভিটার দিকে তাকিয়ে বলেন “ডক্টরসাব বলেছেন ….আপনি জ্ঞানী মানুষ আপনিই বলুন এটা অতো বড়ো ডক্টর.. অতো বড়ো শহরের ডক্টর এটা কী করলেন? এটা কি উনার ঠিক কাজ হলো?”
“আমি জ্ঞানী নই মিশ্রজী, আমি জ্ঞানসমুদ্রের কাছেও পৌঁছোতে পারি নি, আমি খুব সামান্য একজন হাতুড়ে।মিশ্রজী, অদিতি তো শুধু আপনাদের মেয়ে নয়, আমি কতো ছোটো থেকে… মনে আছে একবার রাতে মাথা ফেটেছিলো… আমি মাঙ্কি টুপি বলেছিলাম… ও বলেছিল”
ভাবী খেই ধরেন “মাঙ্কি টুপি নহি আঙ্কল মাঙ্কিক্যাপ বলো”
এবার হাতুড়ের চোখে জল আসে। কতো ছোটো সেই মেয়েটা… আজ জাস্ট নেই। “ভাবী আজকে রাতে আমি এখানেই খাবো”
“আজ রাত আপনি থেকে যান দাদা”
খেয়ে তিনজনেই ছাতে এসে বসেন। হাতুড়ে একটা সিগারেট ধরান।
“দাদা কিছু করা যায় না?” হাতুড়ে জিজ্ঞাষু চোখে ভাবীর দিকে তাকান। “যাতে করে এয়সা অর না হয়, কিসি মাতাপিতাকি গোদ খালি না হয়? দাদা?” সহস্র কন্যাহারার প্রশ্নটা রাতের আকাশকে বিদ্ধ করে।
হাতুড়ে বলেন “সেটাই তো ভাবছিলাম ভাবী”
“কুছ আন্দাজা আয়া?”
“বলুন দাদা, যা করতে হবে আমি করবো। যতদূর যেতে হয় যাবো….” মিশ্রজীর কন্ঠ উদগ্রীব।
“আমাদের দেশে প্রেগন্যান্সির কোনও হিসেব থাকে না। ভ্রূণহত্যারও না। যেখানে যত প্রেগন্যান্সি হবে, আল্ট্রাসাউন্ড করলে আধার কার্ড দিয়ে করতে হবে”
মিশ্রজী, ভাবী আর শ্রাবণের আকাশ স্তব্ধ হয়ে শোনে।
“প্রেগন্যান্সি পেলেই সেটা রেজিস্টারে উঠবে। সেখানকার আশা কর্মীরা, আঙনওয়াড়ি ওই মেয়েটার খোঁজ রাখবে।”
“আগে বোলিয়ে দাদা” উৎসাহে সন্তানহারা দম্পতির মুখে আলো জ্বলে ওঠে।
“এরপর দ্বিতীয় ছবিতে যখন ছেলে না মেয়ে বোঝা যাবে, তখন…..মানে যখনই ছেলে না মেয়ে বোঝা যাবে” হাতুড়ের গলা কাঁপে “তখনই, ঠিক তখনই, সেই দিনই, মেয়ে হলে থানায় জানাতে হবে। থানা থেকে প্রতি মাসে মেয়েটার বাড়িতে লোক যাবে। মা আর বাচ্চা ভালো আছে কিনা?”
সবাই শুনতে থাকে।
“জানি পয়সাওয়ালা লোক সব আইনের ঊর্ধ্বে, জানি দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দশদিক, জানি…তবু কিছু প্রাণ তো বাঁচবে। এভাবে নয়, মারতে গেলে ঝুঁকি নিতে হবে। কাজটা ওদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।”
“কি করতে হবে বলুন”
“আমি তো পঙ্গু, আপনিও তাই। আমরা লিখবো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, খবরের কাগজ, ফেসবুক। আমরা লিখতেই থাকবো, বার বার শেয়ার করবো। আজ না হলে কাল, কাল নাহলে পরশু, কোনও না কোনও দিন কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ হবে। হবেই।”