সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখুন তো বহুবার দেখা নিজের মুখটাকে।
গালটা কি একটু তোবড়ানো মনে হচ্ছে, ঈষৎ হাড় বের করা? ধূসর কালচে একটা ছোপ ধরেছে নাকি মুখে? বলিরেখাগুলিও কি লক্ষ্য করেছেন আগে? সংখ্যায় বাড়ছে? বয়সের তুলনায় একটু বেশিই কি বুড়ো লাগছে নিজেকে?
যদি বলি ধূমপান থেকে হতে পারে সূক্ষ্ম অথচ অমোঘ পরিবর্তনগুলো! চমকে যাবেন না। বলিরেখা লাঞ্ছিত, অকালবার্ধক্যের ছোঁয়া লাগা এই ধরনের মুখকে তো ধূমপায়ীর মুখ (Smoker’s Face) বলে ছাপ মেরেই দিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।
চিকিৎসাশাস্ত্রের হালফিলের পুঁথিপত্রগুলোর পাতা উল্টোলে পাওয়া যাচ্ছে এমনই কিছু আশ্চর্য অজানা তথ্য। যা শুধু অজানাই নয়, অভাবনীয়ও।
হ্যাঁ, ধূমপান থেকে হতে পারে মারাত্বক কিছু ত্বকের অসুখ। যেমন ধরুন ঠোঁটে। মনে পড়ে, সোনার কেল্লার দুষ্টু লোক কামু মুখার্জির ট্রেনের মধ্যে মুকুলকে দেখানো সিগারেটের সেই খেলাটা? এই আছে এই নেই। আগুনশুদ্ধ সিগারেট মুখের মধ্যে ভ্যানিশ। একে বলে রিভার্স স্মোকিং আর এই রিভার্স স্যুইংয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারেন আপনি। হতেই পারে ঠোঁটের ক্যানসার। এছাড়া জিভ অথবা তালুর ক্যানসারও হতে পারে এভাবে। রিভার্স স্মোকিং ছেড়েই দিন। সিধে সাধারণভাবে সিগারেট খেলেও হতে পারে এই সমস্ত সাংঘাতিক অসুখ।
আপনার হাত দেখে যদি কেউ নির্ভুলভাবে বলে দেন যে আপনি বেশ পুরনো ধূমপায়ী তাঁকে হস্তরেখাবিদ বলে ভাবার কিন্তু কোনও কারণ নেই। দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করলে হাতের আঙুল, বিশেষ করে, তর্জনী আর মধ্যমায়, একটা হলদেটে বাদামি ছাপ পড়তে দেখা যায়। একে বলে নিকোটিন সাইন (Nicotine Sign)। কারও কারও নখে আবার সুস্থ আর ছোপ লাগা অংশের মাঝামাঝি একটা রেখা দেখা যায়। এই ধরনের নখের ডাক্তারি নাম হার্লেকুইন নেল (Harlequin Nail) বা কুইটার্স নেল (Quitters Nail)। হাতে পায়ে পূজভরা ফোস্কা নিয়ে ওঠা বিশ্রী অসুখ পামোপ্ল্যান্টার পাসচুলোসিসের (Palmoplanter Pustulosis) রোগীদের শতকরা আশিজনই ধূমপায়ী। ঠিক এভাবেই কিছু প্রদাহমূলক (Inflammatory) চর্মরোগ, যেমন হাইড্রাডিনাইটিস সাপুরেটিভা (Hidradenitis Suppurativa) বা ইনফেকশাস একজিমাটয়েড ডার্মাটোসিস এসবের কারণ খুঁজতে গিয়েও ধূমপানের সঙ্গে তাদের অশুভ আঁতাত আবিষ্কার করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।
সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নিকোটিন যে আমবাতের (Urticaria ) কারণ হতে পারে সেটা জানা ছিল না, এই সেদিন পর্যন্ত।
নারীবাদীরা কি খুব রেগে যাবেন, যদি বলি, মহিলা ধূমপায়ীদের সোরাইসিস (Psoriasis ) হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ী মহিলাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি!
ঘা শুকোতে দেরি হয় নাকি আপনার? ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ভাবছেন? আগে বরং সিগারেটটা ছাড়ুন। হ্যাঁ, ওটাও কারণ হতে পারে। আর ঘা শুকলেও থীকে যেতে পারে বিশ্রী দাগ। সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নিকোটিন রক্তবাহী নালীর সংকোচন (vaso-constriction ) ঘটায়। অর্থাৎ, কোষে কম রক্ত, তথা কম অক্সিজেন পৌছায়। হিসাব করে দেখা গেছে একটি সিগারেট খেলে, কোষে অক্সিজেন টেনশন প্রায় ঘন্টাখানেকের জন্য কমে যায়। আর যাঁরা দিনে একটা কুড়ির প্যাকেট ফুঁকে দেন, বুঝতেই পারছেন, চব্বিশ ঘন্টার বেশিটাই তাঁদের কাটাতে হয় কম–অক্সিজেন–সম্পৃক্ত (Hypoxic) অবস্থায়। কারগিল বা এভারেস্টে না গিয়েই!
অসুখের কথা অনেক হল। এবার একটু সুখের কথায় আসি। ধূমপানের সুফল? হ্যাঁ, তাও আছে। প্রদাহমূলক কিছু আন্ত্রিক অসুখ (Inflammatory Bowel Diseases) যেমন আলসারেটিভ কোলাইটিস (Ulcerative Colitis) যে ধূমপায়ীদের হয় না এখন চিকিৎসাশাস্ত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। এটা নিকোটিনের সুফল। এই সুফলটা কাজে লাগিয়ে ইদানিং নিকোটিন চিকিৎসার কথা ভবা হচ্ছে কিছু প্রদাহমূলক চর্মরোগে। নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার করে এক প্রাক্তন ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে তো সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলা গেছে অন্ত্রের প্রদাহের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ত্বকের মারাত্মক পায়োডার্মা গ্যাংগ্রিনোসামও। তবু বলব, সুখটানের সুখটা তাৎক্ষণিক। আর যেসব অসুখ সে টেনে আনে সেগুলো শুধু দীর্ঘস্থায়ীই নয়, বড্ড ক্ষতিকরও।
তাই বন্ধ করুন ধূমপান!
আজই এবং এক্ষুনি।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলুন, ভাল আছি আর আমার অসুখ সেরে গেছে।