হাতুড়ে বুড়ো ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে ওনার মাধবীদুয়ার বাড়িতে দুইখানা কুকুর নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলেন। একটা ওনার নখ পুলিশ মাখা সুন্দরী আর অন্যটা রাস্তার লোম ওঠা একটা রং চটা কুকুর। এমন সময় পুরোনো জং পড়া গেট খুলে আঙিনায় দুজন মানুষ ঢুকলেন। একজন অতি মোটা থলথলে গাল ফোলা, অন্য জনা সুন্দরী তণ্বী।
হাতুড়ে ঈঙ্গিত করে ভেতরে আসতে বললেন। উনি তখন রং চটা কুকুরটাকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে ওর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন আর মিহি গলায় বিনবিন করে গাইছিলেন “ওরে বাবা রে, একি হলো রে? কুকুরছানাটা কামড়ে দিলো রে।”
তণ্বী ঢুকে বললেন “ আমার নাম চিত্রাঙ্গদা– আপনি গানটা একটু থামিয়ে আমার কথাগুলো শুনবেন কি?”
হাতুড়ে নমস্কার করে বললেন “বসুন বসুন বসতে আজ্ঞা হোক- অবশ্যই শুনবো গদাদেবী …বলুন আপনার অসুবিধে….”
গদাদেবী বারান্দায় বসে মোটা লোকটাকে দেখিয়ে বললেন “আমার হাজব্যান্ড – লম্বোদর পাল।”
হাতুড়ে বক্র দৃষ্টিতে দেখে পরে বললেন “বেশ ওজনদার হাজব্যান্ড – বলুন কি অসুবিধে?”
ভদ্রলোক ঢুলু ঢুলু চোখে বললেন “না না পব্লেম সেরকম কিছু না স্যর। বেকার আপনাকে ঝামেলা করছে। শুধু একটু ঘুম..”
গদাদেবী ঝনঝনিয়ে উঠলেন “একটু ঘুম? এই তোমার একটু ঘুম? গতকাল অফিস থেকে রিপোর্ট দিয়েছে সারাদিন অফিসে ঘুমোও – বাসের লোকজন আমায় ডেকে ডেকে বলে প্রতিদিন ঘুমের চোটে নিজের স্টপেজ ছেড়ে চলে যায়… বাড়ি ফিরে আবার ঘুম … উফফফফফফফফফফফফফফ আমি পাগল হয়ে যাবো” গদাদেবী পুরো ঝঞ্ঝাবাত বইয়ে দ্যান।
রং চটা কুকুরটাকে ছেড়ে ভদ্রলোক উদাস হয়ে বলেন “ ঘুম? তাহলে প্রথমে জানতে হবে ঘুম কাকে বলে?”
গদাদেবী বলেন “সেটা তো বটেই – তাহলে এবার সেটা আমাকে জানিয়ে দিন।”
“ঘুম হলো একটা অতি দরকারি শারীরবৃত্তীয় কাজ যেটা চব্বিশ ঘন্টায় একেকবারে সাত থেকে ন ঘন্টা ধরে ঘটে। এটা মূলতঃ রাতে হয়। এই সময়ে মানুষ অচৈতন্য থাকে অর্থাৎ চারপাশের ঘটনাবলী সম্বন্ধে অচেতন থাকে। এই সময় সাধারণতঃ হার্ট রেট, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এবং নার্ভের কাজকর্ম সবই কমে আসে। কিন্তু এটা থেকে বিনা ওষুধেই মানুষকে চৈতন্যে আনা যায় সুতরাং এটা অসুখ নয় – একটা প্রয়োজন। কিছু কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে টানা দশ দিন ও দশ রাত কাউকে না ঘুমোতে দিলে সে মরেও যেতে পারে (হাতুড়ে চোখ বন্ধ করে বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকেন) আর নিয়মিত ঘুম কম হলে স্মৃতি শক্তি কমে যায়, হার্টের রোগ হয়, রক্তচাপ বাড়তে থাকে, হতাশা আসে, এমনকি শরীরে অকাল বার্ধক্যের চিহ্নও ফুটে ওঠে। ইংল্যান্ডের রাতজাগা শ্রমিকদের মধ্যে একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যারা নিয়মিত রাতে ডিউটি করে তাদের গড় আয়ু অন্যান্যদের থেকে কম হয়।”
গদাদেবী অবাক। “না ঘুমোলে মরে যাবে? এক্কেবারে মরে যাবে? কেন মরে যাবে?”
হাতুড়ের হাঁটুচাপা রং চটা কুকুর এখন ঘুমন্ত এবং ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে হাত পা ছুঁড়ছে।
“আমরা বহুকোষী প্রাণীদের ক্ষেত্রে ধরতে পারি কোষের মধ্যে দিয়ে অবিরত প্রবাহিত বিদ্যুৎতরঙ্গের নামই হলো জীবন। এই বিদ্যুৎতরঙ্গ বিশেষতঃ নার্ভের মধ্যে দিয়েই যায়। তাই মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে নার্ভ বিশ্রাম পায়। না হলে একটানা কাজ করে করে ক্লান্ত ঘিলু টিলু সবাই কাজ করা বন্ধ করে দেবে। বুঝলেন্নি?”
গদাদেবী বিষণ্ণ মুখে বলেন “পুরোটা নয়, তবে এটুকু বুঝলাম ঘুমোলে ব্রেন বিশ্রাম পায়।”
ইতিমধ্যে লম্বোদরবাবু দেওয়ালে হ্যালান দিয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওনার সজোরে নাক ডাকার শব্দে দুটো কুকুরই কান খাড়া করে উঠে বসেছে। ফুরুস গাছ থেকে একটা হলুদ রঙের গুবরে পোকা হাতুড়ের কপালে এসে বসেছিলো। হাতুড়ে ওটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলতে থাকেন “ঘুমোলে শরীরের মধ্যে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বেরোয় এবং বহু উপকারী হর্মোন এবং গ্রোথ হর্মোনও বেরোয়।”
গদাদেবী কিন্তু এ্যাকেবারেই সন্তুষ্ট নন “কিন্তু ও’তো সারা দিন সারা রাত ঘুমোতেই থাকে। তাকিয়ে দেখুন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।”
হাতুড়ে ফিচেল হাসি হাসেন “আসিতেছে শীঘ্রই আসিতেছে। আপনার প্রশ্নের উত্তর আসিতেছে। তার আগে ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় অর্থাৎ স্টেজ সম্পর্কে জানুন– ঘুমের কোয়ালিটি সম্পর্কে জানুন। তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর পাবেন। বুঝলেন শ্রীমতি গদাদেবী?”
“আমার নাম চিত্রাঙ্গদা– শুধু গদা নয়– আগে চিত্রাং আছে। পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে (চিত্রাঙ্গদা মুখব্যাদান করেন), সুতরাং আপনার বকবকানি শুনতেই হবে- আরম্ভ করে ফেলুন।”
হাতুড়ে দু আঙ্গুলে ঘসে ঘসে নিজের গলার ময়লা তুলতে তুলতে বলতে থাকেন “ঘুমের মূলতঃ দুটো ভাগ ‘নন- রেম’ আর ‘রেম স্লিপ’।”
চিত্রাঙ্গদা শিহরিত হন “ঘুমের মধ্যেও ভাগাভাগি?”
নখ পুলিশ মাখা সুন্দরী উঠে ঘুমন্ত লম্বোদরবাবুর মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া লালাঝোলা চেটে দিলো। লম্বোদরবাবুর নাক ডাকা একটু কমে আবার পুরো চৌতালে বাজতে লাগলো। হঠাৎ খাবি খেয়ে ওজনদার ভদ্রলোক নাক ডাকা থামিয়ে লাজুকলতা মুখ করে চারপাশ দেখলেন। তারপর লজ্জা লজ্জা মুখেই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
“নন রেম স্লিপের আবার অনেকগুলো ভাগ আছে। প্রথম ভাগে মানুষ একটা ভাসমান পর্যায়ে থাকে। তখনও চারপাশ সম্বন্ধে বোধ থাকে। অনেকেই ধুপ করে পড়ে যাওয়ার মতো বোধ করেন। আস্তে আস্তে ঘুম গভীর থেকে গভীরতর হয়। এই সময় ইইজি, ইএমজি, ইসিজি, নিশ্বাসের হার মাপার যন্ত্রে বা চোখের পরীক্ষায় দেখা যায়– চোখ স্থির, পেশীরা শিথিল, মস্তিষ্ক শিথিল, হার্ট রেট কম, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হার কমে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে নব্বই মিনিট কাটার পর একটা ‘রেম স্লিপ’ আসে।”
“আরে কচুপোড়া খেলে যা– সমানে ‘রেম স্লিপ’ ‘রেম স্লিপ’ করছেন …এই ‘রেম স্লিপ’ ব্যাপারটা কী সেটা সোজা ভাষায় একটু তো বলুন?”
“তাইলে বলেই ফেলি, কি বলেন?” বুড়ো গলার ময়লা পাশের ঘেসো জমিতে ফেলে আরম্ভ করলেন “রেম [rapid eye movement] মানে র্যাপিড আই মুভমেন্ট। নন রেম হলো যখন চোখ বা অন্য কোনও মাসলের কোনও মুভমেন্ট হয় না। রেম পর্যায়ের ঘুমে মানুষ হাত পা ছোঁড়ে, স্বপ্ন দ্যাখে, চোখে অতি দ্রুত নড়াচড়া হয়, প্রেসার বাড়ে, হার্ট রেট বাড়ে এবং অনিয়মিত হয়ে পড়ে।”
চিত্রাংদেবী আঁৎকে ওঠেন। বলেন “কি ভয়ানক! কি বিপজ্জনক!”
হাতুড়ে হাসেন “হা হা হা। কিন্তু এটাই আমাদের সব থেকে প্রয়োজনীয় ঘুম। তাই এটাকে প্যারাডক্সিক্যাল স্লিপ বা ইয়ে কি য্যানো বলে? স্বতঃবিরোধী ঘুম বলা যেতে পারে। বাজার চলতি সাধারণ ঘুমের ওষুধে এই প্যারাডক্সিক্যাল ঘুমটা হয় না।”
“কিন্তু লম্বোদরের বেশী ঘুম? সেটা ক্যানো?”
সুন্দরী এসে বুড়োর গা ঘেঁসে শুয়ে নিজের কান চুলকোতে থাকে।
“হতে পারে নার্কোলেপ্সি আছে অথবা হাইপোথাইরয়েডিজম, অথবা কোনও ব্রেইনের গন্ডগোল, কিম্বা অ্যাফ্রিকার সেটসি মাছির কামড় থেকে স্লিপিং সিকনেস ….” চিন্তিত বুড়ো সুন্দরীর কান চুলকে দেন।
“হুশ যত বাজে কথা। সিটি স্ক্যান, থাইরয়েড, সবই তো টেস্ট করানো হয়েছে। তবে ঐ নার্কো …. কী যেন বললেন ওটা করা হয়নি। ”
বুড়ো বলেন “বাদ দিন। ওসব বাদ দিন। আসলে ওনার রেম স্লিপটা হচ্ছে না। যার ফলে ঐ ভয়াবহ নাক ডাকা আর দিনমানে ঘুম পাওয়া। বুইলেন কিছু?”
গদাদেবী বলেন “অবশ্যই বুঝি নি। নাক ডাকা তো গভীর ঘুমের লক্ষণ আর ওর নাক ডাকার চোটে একবার পাড়ার লোকজন পর্যন্ত ছুটে এসেছিলো …” গদাদেবী চিন্তাণ্বিত হয়ে পড়েন।
“এই রোগটার নাম স্লিপ অ্যাপ্নিয়া সিন্ড্রোম। ভালো করে খেয়াল করবেন। ওনার নাক ডাকতে ডাকতে হঠাৎ একটু সময়ের জন্য ওনার শ্বাস বন্ধ থাকে তারপর ওনার ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঘুমিয়ে পড়েন। শ্বাস প্রশ্বাসের পথে বাধা পড়ার জন্য ঐ ভয়ঙ্কর শব্দটা উৎপন্ন হয়। আস্তে আস্তে রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসে এটা সাধারণতঃ নন রেম ঘুমের মধ্যেই হয়। অবশেষে নিঃশ্বাস একটুস সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। ফলে ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দটা নষ্ট হয়ে যায়– রেম স্লিপটা আর আসে না। এটা মোটাসোটা লোকেদের বেশী হয়। এবং দিনের পর দিন এই ঘটনা চলতে থাকায় শরীর সারাক্ষণ ঘুম ঘুম করে। হাঁটতে চলতে কাজ করতে, রাস্তায় যে কোন সময়ে আক্রান্ত মানুষটা ঘুমিয়ে পড়তে পারে। যান, গিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিন। এবং চিকিৎসা জেনে নিন। সব কিছু লেখা পড়ে হয় না।”
গদাদেবী ঘুমন্ত লম্বোদরকে টেনে তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা দেন। ধাড়ি ধাড়ি কুকুরদুটো আড়মোড়া ভেঙে ওনাদের বিদায় সম্বর্ধনা জানায়।