কথারম্ভ
করোনা ভাইরাসের কার্যকরী ওষুধ যেদিন বেরোবে, সেদিন আমাদের আতঙ্ক কমবে ঠিকই, কিন্তু রোগ ছড়ানো কমবে না। রোগ হওয়া আটকাতে চাই করোনা-র টিকা। টিকার ইতিহাস থেকে মনে হয়, প্রথমেই খুব ভাল টিকা আবিষ্কার হবার সম্ভাবনা কম। প্রথম ধাপে যে টিকা আবিষ্কার হল, তা দিয়ে কিছু কাজ হল, পরে আরেকটি উন্নত টিকা এল, তাতে আরও ভাল কাজ হল, এমনটাই সম্ভব। ভাইরাসঘটিত একটি রোগ পোলিও এখন নির্মূলের মুখে—সেখানে প্রথমে ইঞ্জেকশন দেওয়া টিকা ছিল, পরে মুখে খাবার টিকা দিয়ে রোগ নির্মূলের কাজ প্রায় পুরোটা হয়েছে। এখন আবার নির্মূলীকরণের শেষ পর্যায়ে ইঞ্জেকশন টিকা দিতে হচ্ছে। আর আমরা তো জানি, গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে জেনারের ভ্যাক্সিনে, কিন্তু তার সলতে পাকানোর কাজ করেছে ভারত-চীনের আবিষ্কার ভ্যারিওলেশন।
ইউরোপে প্রায় এক’শ বছরের ভ্যারিওলেশনের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও তা সমস্ত জনসাধারণকে দেবার কথা ভাবা হয়নি। ভারতেও সবাই পাননি, আর সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ভারতে কতজন মানুষ ভ্যারিওলেশন পেয়েছিল? কে তাদের এই টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছিল? ভ্যাক্সিন আসার আগে ও পরে বৃটিশ সরকার এ নিয়ে কেমন মনোভাব দেখিয়েছিল?
সেই প্রসঙ্গেই পর্ব ৯ এর মূল আলোচনা।
সেন্সাস বা জনগণনা। যিশুর জন্মের সময় নাকি সেখানকার রাজা জনগণনার জন্য সমস্ত লোককে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাই নাকি আস্তাবলে যিশুর জন্ম হয় (সাধু লুকের সুসমাচার)। জনগণনা খুব প্রাচীন পদ্ধতি হলেও, নিয়মিত সেন্সাসের চল সভ্যতার নিরিখে নেহাতই অল্পদিনের, আর তাতে রোগ ব্যাধি বা টিকাকরণের সংখ্যা গুনে রাখা একেবারেই হাল আমলের ব্যাপার। তাই বাংলায় ১৭৫৭ সালের পর থেকে কার্যত বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সে-সময় কতজন দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছিল, সেটা জানা একান্ত অসম্ভব। অবশ্য ইউরোপের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এদেশে একশ’ বছর সাম্রাজ্য চালানোর পরে, বিশেষ করে সিপাহী যুদ্ধের পরে, বৃটিশরা বুঝল সেন্সাস জাতীয় কিছু তথ্য উপনিবেশ চালানোর জন্য একান্তই জরুরি। যেমন সিপাইদের তথ্য। যেমন স্কুলের তথ্য। শ্রমিকদের তথ্য। জেলখানার তথ্য।
প্রথমে জেলখানার তথ্যেই আসি। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জেলবন্দীদের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যে শতকরা ষাটভাগেরও বেশি বন্দী দেশীয় পদ্ধতির টিকা নিয়েছেন। জেলে যারা যায় তাদের সামাজিক অবস্থা গড়পড়তা মানুষের চাইতে খারাপ হয়। তাই জেলবন্দীদের মধ্যে শতকরা ষাট জন ভ্যারিওলেশন করে থাকলে জনসাধারণের মধ্যে এই সংখ্যাটা আরও বেশি হবার কথা।
১৮৭২-৭৩ সালে সরকার বাহাদুর সতের হাজারের কিছু বেশি মানুষের ওপর একটা সমীক্ষা করেন। তার মধ্যে ছিল জেলবন্দী, স্কুলছাত্র, সরকারি ডিসপেন্সারিতে আসা নানা রোগী, আর কিছু শ্রমিক। দেখা গেল তাদের মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা নিয়েছে আর মাত্র ৫ ভাগ জেনারের সরকারি টিকা নিয়েছেন। খেয়াল রাখতে হবে ততদিনে এদেশে জেনারের পদ্ধতি সত্তর বছর ধরে চালু আছে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। বাকিদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগের গুটিবসন্ত হয়ে গেছে, অর্থাৎ তাদের কোনো টিকার দরকার নেই। বাকি মাত্র ১১ ভাগ কোনোরকম সুরক্ষা পায়নি।
সমস্ত তথ্য মিলে আমরা এখন জানি, দেশীয় এই টিকা তখন বাংলা প্রেসিডেন্সিতে খুবই চালু ছিল। এই অঞ্চলের তখনকার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ছিল ‘অন্ত্যজ অস্পৃশ্য’। তারা বাদে বাংলা, ঊড়িষ্যা, বিহার ও আসাম-এর প্রায় প্রত্যেকেই টিকা নিতেন। সারা ভারতের চিত্র অবশ্য এরকম ছিল না। সারা ভারতে্র মধ্যে সুবে বাংলাতে প্রথম ইংরেজ শাসন স্থাপিত হয়, সেখানে দেশীয় টিকা খুব চালু ছিল। সুবে বাংলা বলতে বর্তমান দুই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। বাকি ভারতের মধ্যে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের উপকূল এলাকা, পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে সিন্ধ অঞ্চলে, রাজস্থানের কোথাও কোথাও, কুমায়ুন, তামিলনাড়ুর উত্তরদিক—এসব জায়গায় দেশী টিকা কমবেশি চালু ছিল। এছাড়া বাকি ভারতে দেশীয় টিকা চালু ছিল বলে জানা যায় নি।
বাংলায় টিকাকারের কাজ করতেন ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ, মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বাংলার বাইরে আবার এসব জাতের মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জাতের লোকেরা টিকাকার ছিলেন, যেমন কুনবি, সিন্দুরিয়া, আর রোজা। রোজা বা ওঝাদের সাধারণ কাজ ছিল ঝাড়ফুঁক। তাই টিকাকরণ একদিকে লোকধর্মের অনুসঙ্গ হিসাবে ছিল, অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষের অপদেবতায় বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে ঠাঁই করে নিয়েছিল বলে মনে হয়।
ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় বিধান বা আয়ুর্বেদ থেকে উৎপন্ন হয়ে টিকার প্রথাটি লোকধর্মে মিশেছিল, নাকি লোকধর্ম থেকে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিল, নাকি উভয় দিক থেকেই একত্রে এসেছিল, তার বিচার করা এখন কার্যত অসম্ভব। আরও উল্লেখ্য হল, বাংলার বাইরে অন্তত টিকাকারদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন, আবার গোয়ার মতো জায়গায় ক্যাথলিক পাদ্রিরাও ছিলেন। এরা শীতলা মন্ত্র জপ করতেন কিনা তা অবশ্য জানতে পারিনি।
কিন্তু এ-সত্ত্বেও ভ্যারিওলেশন সর্বভারতীয় প্রথা হয়ে উঠতে পারেনি। বারাণসীর পশ্চিমদিকে দিল্লি পর্যন্ত গোটা উত্তরভারত, নেপাল, তখনকার হায়দারাবাদ, মাইশোর ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (অর্থাৎ গোটা দক্ষিণ ভারত) ও নেপালে এই টিকা চালু থাকার কোনো প্রমাণ নেই। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চল ছাড়া টিকার প্রমাণ মেলেনি।
তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে কলকাতা বা বাংলায় ইংরেজদের মধ্যে দেশী টিকার প্রচলন হয়েছিল। ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এখানকার ইংরেজরা দেশীয় টিকা নিতেন, কিন্তু সেটা এ-দেশের সংস্কার হিসেবে নয়। আগেই আমরা দেখেছি, সেই সময় ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন প্রচলিত হয়েছে। এদেশে বসবাসকারী ইংরেজ তারপরে বুঝতে পারেন ভারতে দেশী টিকা নেওয়া দরকার।
ইউরোপে ভারিওলেশন-কে সরিয়ে জেনারের টিকা চালু হবার পরে, এদেশেও দেশীয় পদ্ধতি সম্পর্কে বৃটিশ মনোভাবের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপে চালু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১৮০২ সালে ভারতে জেনারের ভ্যাক্সিনের আগমন ঘটে। অবশ্য ভারতে বসবাসকারী ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা তার প্রথম লক্ষ্য ছিল। জেনারের ভ্যাক্সিন এদেশের ইংরেজদের এই প্রথম একটা নিরাপদ ও ইউরোপীয় বাঁচার পথ দেখাল। গুটিবসন্তের ভয় থেকে তারা নিজেদের পুরো মুক্ত করতে পারবে, আর তার জন্য কোনো বিজাতীয় (অর্থাৎ ভারতীয়) প্রথার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে না, এমন আশ্বাস পেয়ে এদেশের ইংরেজরা কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বে থেকে ১৮০৬ সালে মোট প্রায় আট হাজার পাউন্ড পাঠাল। জেনারের কাছে সে টাকার মূল্য বড় কম নয়। আমরা আগে দেখেছি বৃটিশ পার্লামেন্ট স্বয়ং জেনারকে সর্বসাকূল্যে ত্রিশহাজার পাউন্ড দিয়েছিল।
জেনারের টিকার প্রথম লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয়রা। কিন্তু করোনা-র সময় আমরা যেমন দেখছি, ছোঁয়াচে রোগের জন্য একা নিরাপদ থাকা যায় না, আশেপাশের সবাই নিরাপদ থাকলে তবেই আপনি নিরাপদ, জেনারের টিকা নিয়েও বৃটিশ সরকার সেরকম ভেবেছিল। ইউরোপীয়দের পরে তাদের টিকা দেবার লক্ষ্য হল ইউরোপীয়দের কাছে থাকা মানুষজন। বাড়ির চাকরবাকর, সিপাহী, সে সময় ইউরোপীয়দের হাতে গড়া অর্থকরী ফসল নীল ও আফিম ক্ষেতের শ্রমিক। এদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হল। আর যেহেতু ভ্যারিওলেশন থেকে গুটিবসন্ত ছড়ানোর সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে, এদের ভারতীয় টিকা নিষিদ্ধ হল।
এরপর ইউরোপীয়দের দাবি উঠবে, তাদের উপনিবেশে অর্থাৎ গোটা ভারতে ভ্যারিওলেশন বন্ধ করে ভ্যাক্সিনেশন চালু করতে হবে, নইলে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা থাকে না যে! কিন্তু ভারতে সে কাজটি করা কি তেমন সহজ ছিল? কীভাবে ভ্যাক্সিনেশন চালু হয়েছিল? প্রাচীন দেশীয় পদ্ধতি ভ্যারিওলেশন আবার ভারতবাসীর ধর্মীয় আচরণের সঙ্গেও যুক্ত, তার বিলোপে কি কোনো বাধা আসেনি? আর, কেবলমাত্র ভারতে থাকা ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো বোধ, কোনো সিভিলাইজিং মিশন কি বৃটিশকে এদেশে ভ্যারিওলেশন তুলে ভ্যাক্সিনেশন চালু করাতে অনুপ্রাণিত করেনি?
এসব আমরা দেখব পরের পর্বে।
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
১) শীতলা দেবী—দেশীয় টিকা ছিল গুটিবসন্তের কাছে নত হয়ে দেহের ওপর তার অধিকার স্বীকার করা।
২) ইউরোপীয় মনন—জেনারের ভ্যাক্সিন হল গুটিবসন্তকে পরাজিত করে তাকে দূর করা।
তথ্যসূত্র
১) Colonizing the Body – State Medicine and Epidemic disease in Nineteenth-Century India, David Arnold. University of California Press, 1993, Page 116-158