২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ডা. ফ্রেডরিক গ্রান্ট বান্টিঙ। বান্টিঙ মারা গেলে জনশূন্য প্রান্তরে উদ্ধারের আশায় একাকী অপেক্ষা করতে থাকেন পাইলট ম্যাকি। সারাটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু কোনও উদ্ধারকারী দল চোখে পড়ল না তাঁর। সন্ধ্যা নেমে এলো ধীরে ধীরে। ম্যাকি বুঝলেন, রাতের এই ঠান্ডার মধ্যে ভাঙ্গা বিমানের ভিতরে আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয়, বিমান ছেড়ে বেড়ানো বিপজ্জনক। সারা রাত তিনটে মৃতদেহ আগলে উদ্ধারের আশায় বসে রইলেন ম্যাকি। সূর্যোদয় পর্যন্ত রাতটা বিমানেই কাটালেন তিনি। নতুন ভোর যেন নতুন করে বাঁচার আলো নিয়ে এলো তাঁর কাছে। বাঁচবেন তিনি, বাঁচতে চান তিনি। উদ্ধারকারী দল নিশ্চয় আসবে তাঁকে উদ্ধার করতে। আশায় বুক বেঁধে, ভাঙ্গা বিমানের পাশে ঠায় বসে রইলেন তিনি, একা। কিন্তু না, কোনও উদ্ধারকারী দল এলো না তাঁকে উদ্ধার করতে।
অরেঞ্জ হল, মাসগ্রেভ হারবার। এখানেই রাখা হয়েছিল বান্টিঙ, বার্ড ও স্নেলহামের মৃতদেহ। |
বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা, ধৈর্য্য আর সাহসে ভর করে একাকী জনহীন প্রান্তরে তিন তিনটে দিন কাটিয়ে দিলেন ম্যাকি। গায়ে আর শক্তি যেন নেই তাঁর। বেশ বুঝতে পারছেন, তিলে তিলে তিনিও এগোচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। তিন দিন পর, ২৪শে ফেব্রুয়ারি সকালে, তল্লাশি বিমানের দেখা পান ম্যাকি। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে, অশক্ত শরীরটাকে টানতে টানতে, বরফের উপর পা ঘষটে ঘষটে বার্তা লিখলেন তিনি। দেখতে পেয়েছে, তাঁকে দেখতে পেয়েছে তল্লাসি দল! নীচে নেমে এসে ত্রাণ ফেলে গেল বিমানটা। আশেপাশে অবতরণের জায়গা না পেয়ে, উত্তর দিকে উড়ে গেল তল্লাশি বিমানটা। এবার ম্যাকি নিশ্চিত যে তাঁকে উদ্ধার করতে লোকজন আসবে। বেশ কয়েক ঘন্টা পর মাসগ্রেভ হারবার থেকে লোকজন আসেন দুর্ঘটনা স্থলের দিকে। দুর্ঘটনা স্থলের কাছে ম্যাকিকে দেখতে পান তাঁরা। দ্রুত সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে মাসগ্রেভ হারবারে নিয়ে আসেন উদ্ধারকারীরা। স্থানীয় এক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় ম্যাকিকে। বিকেলের দিকে আরও লোকজন ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম জোগার করে, দুর্ঘটনাস্থল থেকে বান্টিঙ, বার্ড এবং স্নেলহামের মৃতদেহ মাসগ্রেভ হারবারে নিয়ে আসেন উদ্ধারকারীরা। স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার ‘অরেঞ্জ হল’এ রাখা হলো শবদেহ তিনটে।
২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, আকাশ পরিষ্কার হলে গ্যান্ডার থেকে বিশেষ স্কি-প্লেনে ‘এয়ার ফোর্স মেডিক্যাল অফিসার’ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইরউইন আসেন মাসগ্রেভ হারবারে। ম্যাকিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করেন তিনি। সামরিক সুরক্ষার প্রশ্নে এক সশস্ত্র পুলিশকে মোতায়ন করা হয় বান্টিঙের দুর্ঘটনা গ্রস্ত বিমানের কাছে। বিমানের সমস্ত অংশ যাতে যথাস্থানে থাকে সেই দিকে নজর রাখতেই নিয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি, স্কি-প্লেনে গ্যান্ডারে আনা হয় ম্যাকিকে। ওই বিমানেই একই সাথে তিনটে মৃতদেহও আনা হয় গ্যান্ডারে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, রয়েল কানাডিয়ন এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমানে বান্টিঙ, বার্ড, স্নেলহামের মৃতদেহ এবং ম্যাকিকে আনা হয় মন্ট্রিয়লে। মন্ট্রিয়লের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ম্যাকিকে। হ্যালিফ্যাক্স শহরে নিয়ে যাওয়া হয় বার্ড এবং স্নেলহামের মরদেহ। সেখানে সমাহিত করা হয় তাঁদের। বান্টিঙের মরদেহ আনা হয় টরন্টোয়। ৩রা মার্চ ১৯৪১, পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে, বান্টিঙের আজীবনের শুভাকাঙ্খী ও পথপ্রদর্শক রেভারেন্ড পিটার এডিসনের পৌরহিত্যে বান্টিঙের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এরপর তাঁর মরদেহ আনা হয় টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। জনসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য সেখানে শায়িত রাখা হয় তাঁকে। বান্টিঙের সুহৃদ, ‘আর্টস অ্যান্ড লেটারস্’ ক্লাবের হিলি উইলিয়ান, অর্গান বাজিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বান্টিঙকে। পরদিন, ৪ঠা মার্চ ১৯৪১, দু’শো মিলিটারি ব্যারিকেডের মাঝে শববাহী গাড়িতে টরন্টোর প্রধান রাস্তা দিয়ে বান্টিঙের শবযাত্রা নির্গত হয়। রয়েল কানাডিয়ন এয়ার ফোর্সের তরফে বিদায় গীতের ধুন পরিবেশন করা হয়। টরন্টোর ‘মাউন্ট প্লিসেন্ট সেমেটারি’তে সামরিক মর্যাদায় ‘গান স্যালুট’ দিয়ে সমাহিত করা হয় ডা. ফ্রেডরিক গ্রান্ট বান্টিঙকে।
বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয় টরন্টো স্টার পত্রিকায়। এই প্রতিবেদনের লেখক ছিলেন স্বয়ং পাইলট যোসেফ সি. ম্যাকি। মোটা অর্থের বিনিময় তিনি সম্পূর্ণ বিবরণ হস্তান্তর করেন টরন্টো স্টারকে। রেডিও অপারেটর উইলিয়ম স্নেলহামের বিধবা পত্নি ও তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে সেই অর্থ দান করেন ম্যাকি। বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্ত শুরু হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ম্যালকম হালেটের নেতৃত্বে শুরু হয় সিভিল পর্যায়ের তদন্ত। এয়ার কমান্ডার জর্জ ওয়ালসের নেতৃত্বে শুরু হয় মিলিটারি পর্যায়ের তদন্ত। একে একে জমা পড়ে প্রচুর রিপোর্ট। গ্যান্ডারে নাৎসি বাহিনীর নাশকতার আশঙ্কা জানিয়ে ইতিপূর্বেই বেশ কয়েকটা রিপোর্ট জমা পড়েছিল গোয়েন্দা দপ্তরে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসায়, বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনার সাথে নাৎসি বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। গুঞ্জন উঠে, বান্টিঙের ইংলন্ড যাত্রা আটকাতে ষড়যন্ত্র করে বান্টিঙের বিমান ধ্বংস করেছে নাৎসি বাহিনী। এই দাবির স্বপক্ষে অনেকগুলো বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, গ্যান্ডারে অবতরণ করার পর বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমান কোনও হ্যাঙারে ঠাঁই পায় নি। বিশেষ প্রহরা ছাড়া খোলা আকাশের নীচে ৩ দিন (মতান্তরে ১ দিন) পড়ে থাকে বিমানটা। অত্যন্ত গোপন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত, ‘হাইসিকিউরটি’ তকমা দেওয়া বিমানকে হ্যাঙ্গারে রাখা হয় নি কেন? কেন ব্যবস্থা করা হয় নি বিশেষ প্রহরার? এই প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়, বান্টিঙের বিমান অবতরণের আগে থেকেই, যুদ্ধের জন্য প্রচুর বিমান মজুদ ছিল বন্দরের হ্যাঙারে। তাই বান্টিঙের বিমানকে হ্যাঙ্গারে ঢোকানোর জায়গা পান নি তাঁরা।
বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনার পিছনে নাৎসি নাশকতার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আরও একটা বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ, গ্যান্ডার ছাড়ার পূর্বে বান্টিঙের বিমানের যন্ত্রপাতি সঠিক ভাবে পরীক্ষা করা হয় নি। বন্দর সূত্রে পাওয়া ‘চেক লিস্ট’ অসম্পূর্ণ ছিল। সেই তালিকার নীচে কারোর সইও ছিল না। হাইসিকিউরটির তকমা দেওয়া কোন বিমান পরীক্ষায় এত বড় গাফিলতি ছিল কেন? এটা গাফিলতি না ষড়যন্ত্র? পাইলট ম্যাকির পত্নি পরে বলেছিলেন, বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমানের তেলের ট্যাঙ্কে সেদিন বালি মেশানো হয়েছিল যাতে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। দু’জন ব্যক্তি জড়িত ছিলেন এই কাজে। সম্ভবত সাক্ষী প্রমাণ লোপাটের জন্য তাঁদের মেরে ফেলা হয় এবং নিউফাউনল্যান্ডের কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে কবর দেওয়া তাঁদের।
সমস্ত তদন্ত শেষে সরকারের তরফে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “সরকার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে [তদন্ত] রিপোর্ট সাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা হবে না। কোর্টের অনুসন্ধান [মোতাবেক দুর্ঘটনা] সম্পূর্ণ যান্ত্রিক বিষয়ক, যা দুর্ঘটনার আশু ও অন্তর্নিহিত কারণ বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে”। সর্বসাধারণের জন্য কেন প্রকাশ করা হলো না বান্টিঙের দুর্ঘটনার কারণ? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর আজও পাওয়া যায় নি। সরকারি সেই গুপ্ত রিপোর্টের চারটে প্রতিলিপি প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই প্রতিলিপিগুলো যথাক্রমে ওটাওয়া, লন্ডন, নিউফাউনল্যান্ড এবং মন্ট্রিয়লের সরকারি অফিসে জমা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যায়, চারটে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রক্ষিত এই রিপোর্টগুলোর একটারও হদিশ নেই। আজও নেই। চারটে ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে সরকারি হেপাজতে থাকা সেই রিপোর্টগুলো বেপাত্তা হয়ে যাওয়া সন্দেহজনক নয় কি? সেই রিপোর্টের একটা কপিও পাওয়া গেল না আজ পর্যন্ত? কেন? কে সরালো সেই রিপোর্ট? কেন তাঁকে সরাতে হলো সেই রিপোর্ট? কার নির্দেশে সরানো হলো সেই রিপোর্ট? কি লেখা ছিল সেই রিপোর্টে?
সল্ট ওয়াটার পন্ডের পাশে রাখা বান্টিঙ ব্যবহৃত লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩-এর রেপ্লিকা। |
বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনার জন্য, হাডসন ৩ বিমানের গঠনগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। সমস্ত তদন্ত ও বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্রিত করে জানা গেল, যান্ত্রিক ত্রুটি ও খারাপ আবহাওয়াই বান্টিঙের বিমান দুর্ঘটনা মূল কারণ। বিশেষজ্ঞরা যাই বলুন না কেন, বান্টিঙ অনুরক্ত হিসেবে আমরা মনে করি, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নয়, গাফিলতি ও নিরাপত্তার যথাযথ অভাবেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে কানাডার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বান্টিঙের লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩ বিমানটা সেভেন মাইল পন্ডের পাশে পড়ে থাকতে দেখে যায় বহু বছর। প্রাথমিক অনুসন্ধানের স্বার্থে বিমান থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু বাকি অংশ একই স্থানে, একই রকম ভাবে পড়েছিল, দীর্ঘ দীর্ঘ বছর। যেহেতু সেভেন মাইল পন্ডটা বেশ দুর্গম স্থানে অবস্থিত এবং জনহীন, তাই একই ভাবে বহু বছর পড়ে থাকতে দেখা যায় বিমানটাকে। ১৯৯০ সালে, বান্টিঙ স্মরণে, জনসাধারণের জন্য একটা সংগ্রহশালা খোলার কথা ভাবেন মাসগ্রেভ হারবার পুরসভা। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, সেভেন মাইল পন্ডের পাশে পড়ে থাকা ভাঙা বিমানের বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ করা হয়। সেভেন মাইল পন্ডের মতো দুর্গম রুক্ষ স্থানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব নয় বিবেচনা করে, সমুদ্র তীরবর্তী ‘সল্ট ওয়াটার পন্ড’এর পাশে রাখা হয় সংগৃহীত বিমান ধ্বংসাবশেষের নমুনা। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের আদলে তৈরি করা হয় একটা নকল (রেপ্লিকা) ভাঙ্গা বিমান।
সে রেপ্লিকাটাও রাখা হয় সল্ট ওয়াটার পন্ডের পাশে। ১৯৯১ সালে মাসগ্রেভ হারবারে গঠিত করা হয় ‘বান্টিঙ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার’। বান্টিঙের ব্যবহৃত সামগ্রী, জীবনের নানান তথ্য দিয়ে সাজানো হয় এই সেন্টারকে। ‘সল্ট ওয়াটার পন্ড’ সংলগ্ন জায়গাটার নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বান্টিঙ মেমোরিয়ল মিউনিসিপাল পার্ক’। মাসগ্রেভ হারবার থেকে বান্টিঙ পার্কের দুরত্ব ৭ কিমি। ১৯৯৭ সালে, মাসগ্রেভ হারবার থেকে বান্টিঙ পার্ক পর্যন্ত সুসজ্জিত এক পথ নির্মাণ করা হয়। এই পথের নাম দেওয়া হয় বান্টিঙ ট্রেইল। ২৩শে জুন ২০০১, বান্টিঙ ব্যবহৃত লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩ বিমানের একটা পূর্ণাঙ্গ রেপ্লিকা স্থাপন করা হয় এই পার্কে।
এক বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন ফ্রেডরিক গ্রান্ট বান্টিঙ। সদালাপী, মিতভাষী এই মানুষটাই রেগে গেলে নিমেষেই যেন এক অচেনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতেন। কাউকে পরোয়া করতেন না তখন তিনি। কোনও দিনও মেপে কথা বলতেন না তিনি। তাঁর প্রাণ যা চায় সেটাই বলতেন তিনি, সেটাই করতেন তিনি। বৈচিত্র্য আর বৈপরীত্যের এক আশ্চর্য সহাবস্থান দেখা যায় তাঁর চরিত্রের মধ্যে। জীবনের একটা পর্যায়ে ডায়াবিটিস নিয়ে নিতান্তই নিরুৎসাহী ছিলেন তিনি। অথচ তিনিই হয়ে উঠলেন কোটি কোটি ডায়াবিটিস রোগীর ত্রাতা। কঠিন এক প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে ভাবলেশহীন মুখে কেটে নিয়েছেন কুকুরের প্যানক্রিয়াস, আবার সেই কুকুরের মৃত্যুতেই সবার চোখের আড়ালে ফেলেছেন চোখের জল। কোনও ছকেই তিনি বাঁধতে চান নি তাঁর জীবনটাকে। তাই ইনসুলিনোত্তর গবেষণায় মন বসে নি তাঁর। হেলায় সে পথ ত্যাগ করে ক্যানভাসে বেঁধেছেন প্রকৃতিকে। শহরের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে অবলীলায় চলে গেছেন দুর্গম কোনও স্থানে। আবার, মানবতার বিপদ বুঝে সে প্রান্তর ছেড়ে নির্দ্বিধায় চলে গেছেন রণক্ষেত্রে। আর সেই রণক্ষেত্রেই হাসিমুখে দিয়ে গেছেন তাঁর অমূল্য জীবন।
ইনসুলিন আর বান্টিঙ আজ সমার্থক। ডায়াবিটিসের বিরুদ্ধে যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, সে লড়াই আজও অব্যাহত রয়েছে। আর এই লড়াইয়ে তিনিই আমাদের সেনানায়ক। তাঁর প্রস্তুত করা ইনসুলিনই আজও আমাদের একমাত্র হাতিয়ার। শতবর্ষ পরে, পৃথিবীর প্রথম ৫টা জীবনদায়ী ওষুধের [৬৩] তালিকায় তাই ইনসুলিনের অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি। তবে একদিকে তিনি যেমন ইনসুলিন তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে, অন্যদিকে তেমনই সতর্ক করে আমাদের বলেছেন, ‘ইনসুলিন ইজ নট আ কিওর; ইট’জ আ ট্রিটমেন্ট’। ডায়াবিটিসের ‘ট্রিটমেন্ট’ তিনি শুরু করলেও, ডায়াবিটিস কিন্তু এখনও ‘কিওরেবল’ নয়। ‘ট্রিটমেন্ট’ নয়, বান্টিঙ চাইতেন ‘কিওর’। আর সেই কিওরের আশা বুকে নিয়েই তাঁর বাড়ির সামনে সদা জাজ্বল্যমান ‘ফ্লেম অব হোপ’। কোটি কোটি মানুষের আশা বুকে নিয়ে ফ্লেম অব হোপ জ্বলছে আরেক বান্টিঙের অপেক্ষায়, যিনি বলবেন ‘হিয়ার ইজ দ্য কিওর’।
বান্টিঙ এর বাড়ির সামনে রাত্রে জ্বলছে ফ্লেম অফ হোপ।
সমাপ্ত
[৬৩] অদ্যাবধি বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে প্রথম ৫ জীবনদায়ী ওষুধের তালিকায় পেনিসিলিনের পরই স্থান করে নিয়েছে ইনসুলিন।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জী
- Banting A Biography : Michael Bliss. McClelland and Stewart Limited, Toronto, 1984
- Frederick Banting : Hero, Healer, Artist. Stephen Eaton Hume. Dundurn, 2000.
- Margaret and Charley: The Personal Story of Dr. Charles Best, the Co-Discoverer of Insulin : Henry B.M. Best. Dundurn 2003.
- J.B. Collip and the Development of Medical Research in Canada : Alison Li. McGill-Queen’s Press, 2003.
- Behind Insulin : The Life and Legacy of Doctor Peter Joseph Moloney : Mary V. Moloney. Lulu.com 2016.
- Various articles from National Center for Biotechnology Information (NCBI)
- Breakthrough: Elizabeth Hughes, the Discovery of Insulin, and the Making of a Medical Miracle : Thea Cooper, Arthur Ainsberg. St. Matrin’s Publishing Group, 2010.
- Nobel Prize that Changed Medicine : Gilbert Thompson. World Scientific 2012.
- American Journal of Physiology. Various volumes.
- The Quest : film by Stanley Jackson.
- Glory Enough For All : Telefilm by Eric Till
- Various clippings of ‘The Toronto Daily Star’.
- Nobelprize.org and many more websites.