যখন ঘটনার বাহুল্যবিহীন একঘেয়ে দিনগুলো ক্লান্তিকর পৌনপুনিকতার মধ্যে দিয়ে অসম্ভব দ্রুততায় পেরিয়ে যায়, তখন একটা দিনের থেকে অন্য দিনের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা আর মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতির দিনগুলোও সেইরকম ঝড়ের মুখে ধুলোবালির মতোই উড়ে গেল।
ফিজিক্সে একশোর মধ্যে উনপঞ্চাশ নম্বর, কেমিস্ট্রিতে পঁচাত্তর, আর বায়োলজিতে দুশোর মধ্যে দেড়শো নম্বরের উত্তর লিখতে পেরেছিলাম জয়েন্টে — মানে প্রশ্নগুলোর জবাবের অ্যাটেম্পট নিয়েছিলাম আমি। এর পরেও, আমার যে আদৌ কোনো র্যাঙ্ক হবে, সেটা আমার মায়ের মতো অতিবড় শুভাকাঙ্ক্ষীও আশা করেনি।
আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল ইংরেজি। তখনো জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ইংরেজি পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়নি। ১০০ নম্বরের ইংরেজি পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল নিশ্চয়ই, নচেৎ আমার জীবননদীর খাতটাই পরিবর্তিত হয়ে যেত।
ইংরেজির বদান্যতায়, ১৯৮৬ সালের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ঝোলানো উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের নামের তালিকায়, নিজের নামটা খুঁজে পেলাম আমি। পাশে আত্মহারা মায়ের সংযত উল্লাস একটুও স্পর্শ করতে পারছিল না আমাকে।
আমার মনে হচ্ছিল যে, অতি পরিচিত আপনজন যেন আমার হাতটি ধরে, দুর্ভেদ্য দুর্গম রাস্তা পার করে দেবার পরে, আমাকে আমার অভীষ্ট রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো বিদায় নিল — একটু কৃতজ্ঞতা জানানোর অবকাশও দিল না।
ফেরার পথে ট্রেনে, গুম হয়ে বসে রয়েছি আমি। পাশে বসা মায়ের মুখটা ঝলমল করছে, দেখছি চেয়ে চেয়ে। আমার স্বভাবতই অপ্রগলভ মা হেসে হেসে গল্প করছে অচেনা সহযাত্রিণীদের সঙ্গে —“এই ব্যাগটা — কি সুন্দর কাজ করা, কোত্থেকে কিনলেন ভাই?”
“এ তো ট্রেনেই কেনা —”
“ওমা, তাই!”
“হ্যাঁ দিদি, দমদম থেকে একটা হকার ওঠে, ওদিকে ব্যারাকপুর অবধি যায়, ওর কাছেই পাবেন। আপনি নামবেন কোথায়?”
“এই তো, শ্যামনগর —”
“আপনাকে তো দেখে ডেলি প্যাসেঞ্জার মনে হচ্ছে না দিদি। সার্ভিস করেন কোথাও?”
“না না, চাকরি বাকরি করি না —” আশ্চর্য, এই কথাগুলো বলার সময়ও মায়ের গলায় কোনো হীনমন্যতা লক্ষ্য করলাম না।
“তাহলে তো মুশকিল — সেই হকার ছেলেটা তো রোজ ওঠে না ট্রেনে —”
“আমার মেয়ে অবিশ্যি রোজ কলকাতা আসে পড়তে — অ্যাই খুকু, এইরকম ডিজাইনের ব্যাগ দেখলে কিনিস তো একটা—”
“কিসে পড়ে দিদি, আপনার মেয়ে?”
“এই তো কলকাতার স্কুল থেকে বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিয়েছে এবারে —”
“ও! তা, পাশ করলে কলকাতার কলেজেই পড়াবেন?”
ব্যস! যে প্রশ্নটা আসার জন্য মায়ের অযাচিত বিশ্রম্ভালাপ শুরু, সেটা এসে গেল!
আমি লোকাল ট্রেনের ক্রিসক্রস মেঝের উপর কুন্ঠিত দৃষ্টি মেলে শুনতে লাগলাম —“বারো ক্লাসে মেয়ের সায়েন্স ছিল তো। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়াবে মেয়েকে। এই তো আজই বেরোলো রেজাল্ট। মেয়ে আমার চান্স পেয়েছে। র্যাঙ্ক মোটামুটি খারাপ হয়নি — কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোর মধ্যেই যে কোনো একটাতে হয়ে যাবে আশা করছি–”
আমি অবাক হচ্ছিলাম না, ভীষণ ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম মায়ের এই অস্বাভাবিক বাগবিস্তারে। কোন লোভের বশবর্তী হয়ে, কোন মানসিক সংকীর্ণতার শিকার হয়ে, আমার স্বল্পবাক, প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী মা, এই হাক্লান্ত, খেটে খাওয়া নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষগুলোর কাছে, নিজের হঠাৎ পাওয়া সৌভাগ্যের গল্প করতে বসেছে?
আমার রাগ হতে লাগল। ভয়ঙ্কর রাগ। কান মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। বিদ্রোহ করে উঠল মন। ধ্যাত্তেরিকা! আমি পড়ব না ডাক্তারি, যা! আমার ভাল্লাগে না, আমি পারব না — ওটা আমার cup of tea নয়! মা বাবার কি অধিকার আছে আমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার? পড়ে পাশ তো আমাকেই করতে হবে, ওরা তো আর আমার হয়ে পরীক্ষা দেবে না — শুধু কন্যাগর্বে গর্বিত হয়েই খালাস! হুঁহ্, সব জানা আছে — ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নেবে না— যত্তসব ফালতু নাটক!
“ওঠ, খুকু, শ্যামনগর আসছে তো, নামতে হবে এবার!”
নির্মম দৃষ্টি ফেরালাম মায়ের দিকে। রুক্ষ চুলে কয়েকটি রুপোলি রেখা। জীবনযুদ্ধ অসংখ্য অকাল বলিরেখার ছাপ এঁকে দিয়েছে মুখে। ঘামে গলে গেছে ভোরের সূর্যের মতো সিঁদুরের টিপটা। জন্ম থেকে দেখা বিষণ্ণকঠিন চোখদুটো কি এক অমূল্য প্রাপ্তির আনন্দে ঝকঝক করছে যেন। পরনে সস্তার মোটা খোলের তাঁতের শাড়িটা গুটিয়ে গেছে গোড়ালির কাছে — ফলসটুকুও বসায়নি মা কাপড়টায়।
আমার মনে পড়ল, গত কয়েকটা পুজোয় মা নিজের জন্য খানদুয়েক করে কমদামি তাঁতের শাড়ি ছাড়া আর কিচ্ছু কিনতে দেয়নি বাবাকে। গত তিন বছর আমরা বেড়াতে যাইনি কোথাও। অথচ, বাবাকে দিয়ে ছুটির দরখাস্ত করিয়ে, মা ঠিক তুলিয়ে নিয়েছে কোম্পানির দেওয়া এলটিএ-র টাকা!
“ডাক্তারিতে অনেক খরচ, বুঝলে! সব জমাও ব্যাঙ্কে, নয়ত খুকু চান্স পেলে সামাল দিতে পারবে না!”
আমার মামাতো দিদির বিয়েতে, সমালোচনা হবে জেনেও এককুচি সোনা আশীর্বাদী হিসেবে দেয়নি মা, বাবা দিতে চাইলেও —“সামনে অনেক খরচ, এখন কি করে দিই বলো তো? খুকুটা মানুষ হোক আগে—”
“একটু মিষ্টি কিনে নিই বল্? কি নিবি? তোর বাবা ভাজা মিষ্টি ভালবাসে—” মায়েরই কথায় সম্বিত ফিরল আমার।
“আচ্ছা। তাই নেব। দাও, টাকা দাও।”
মিষ্টি কিনে পায়ে পায়ে রিকশায় উঠে বসি আমি, মায়ের পাশে।
না, আমি মাকে বলতে পারব না, যে আমি পড়ব না ডাক্তারি। আমার সাহস নেই। ইচ্ছেও নেই আর। তবে হেরেও যাব না আমি। কিছুতেই অভিমন্যু হবো না। লড়াকু মা বাবার মেয়ে আমি, আমাকে পারতেই হবে। ঠিক ডাক্তারি পাশ করব একদিন। খারাপ লাগবে পড়তে? লাগুক। আমার ভিতরে আর একটা আমি, এই স্বার্থপর ‘আমি’টাকে মনে করিয়ে দিল — শুধু নিজের ভাল লাগা দিয়ে মায়ের কৃচ্ছ্রসাধনকে কিনে নিবি, এত বড়লোক হ’সনি তুই খুকু, এত বড়লোক হ’সনি এখনো।
মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের বেড়া ডিঙোনোর পরে হলো কাউন্সেলিং। সেইদিন ফর্ম ফিল আপ করে জানাতে হলো, কে কোন কলেজে ভর্তি হতে চায়।
র্যাঙ্ক অনুযায়ী, প্রথমে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, তারপর এনআরএস, তারপর আরজিকর, তারপরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল — এইরকম ক্রমানুসারে সাজানো ছিল কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোর নামের তালিকা। এরও পরে আসত বাঁকুড়া সম্মিলনী, বর্ধমান মেডিক্যাল ও নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের নাম।
আমি প্রথম এবং দ্বিতীয় পছন্দ যথাক্রমে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং এনআরএস দিলেও জানতাম, আমার র্যাংকে দুটো জায়গার একটাতেও হবে না। তবে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে আমার নির্বাচিত হবার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমি থার্ড চয়েস হিসেবে ফর্মে লিখলাম ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের নাম। মা একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল শুনে। বাবাও।
এইখানে কিছু পূর্বকথা আছে। কলেজে অধ্যাপনা করারও আগে, আমার বাবা একটা স্কুলে জীবনবিজ্ঞান পড়াতো। তখনো আমার মায়ের পা পড়েনি বুড়োদাদুর পুরোনো ভিটেতে। সেই সেপিয়া রঙের দিনগুলোয় আমার বাবা এক ছাত্রীকে টিউশন করাতে যেত। নিজেদেরই পাড়ায়।
মেয়েটি মেধাবী। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করার পরে চান্স পেলো প্রি মেডিক্যালে। এইজন্য সে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল বাবাকে — মাস্টারমশাইয়ের সাহায্য ছাড়া নাকি সে অত নম্বর পেতই না লাইফ সায়েন্সে। তারপর সে ভর্তি হলো ডাক্তারিতে। ওই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে।
ডাক্তারির ফাইন্যাল পরীক্ষায়ও ভাল ভাবে উত্তীর্ণ হলো মেয়েটি। তারপর ভাল ঘর বর দেখে তার বিয়ে হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে, আমার মা আর বাবার বিয়ে হয়েছে। আমি জন্মেছি মায়ের কোলে।
সেই মেয়েটি — তখন সে বিবাহিতা, দেখা করতে এসেছে পুরোনো মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। “বৌদি, কি সুন্দর বাচ্চা — ছেলে না মেয়ে?”
“তুমি বলো দেখি ভাই, ছেলে না মেয়ে?”
“আচ্ছা, দাঁড়ান, চেষ্টা করি। উমমম, মেয়ে — কি, ঠিক বলেছি না?”
“কি করে বুঝলে?”
“ট্রেড সিক্রেট! আমরা ডাক্তাররা ঠিক বুঝতে পারি! খুব সুন্দর মেয়ে হয়েছে বৌদি। আর সবচেয়ে সুন্দর ওর চোখদুটো, একদম মাস্টারমশাইয়ের মতো, না?”
“এই মেয়ে, তুমি পড়তে, নাকি শুধু মাস্টারমশাইয়ের চোখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে?”
“এ মা, বৌদি যে কি বলেন না! হিহিহি—”
এর বছর কয়েকের মধ্যেই দুরারোগ্য ক্যানসারে মেয়েটি মারা যায়। সে খবর শুনে আমার মা বাবা দুজনেই চোখের জল ফেলেছিল, শুনেছি।
কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি আমার তৃতীয় পছন্দ হিসেবে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের নাম লিখেছিলাম তখন, তা এত বছর পরেও আমার নিজের কাছে পরিষ্কার নয়।
হয়ত, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আমার ভবিতব্য ছিল! আমার নিয়তি — আমার নেমেসিসও কি? জানা নেই।
শুধু জানি, বত্রিশ নম্বর গোরাচাঁদ রোড, কলকাতা চোদ্দ, আমার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে — প্রতিটি কোষকলায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ে, গ্রন্থি-পেশিতে এই নাম জড়িয়ে গেছে। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বছরগুলি কেটেছে ওই ইটকাঠমানুষের ঠিকানায়। চিরন্তন অমলিন দিনগুলো তার সাক্ষী।
আজও যখন গ্রে-র অ্যানাটমির মলাট উল্টে দেখি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা —
Sukanya Banerjee,
Roll no 1,
Calcutta National Medical College
1st year MBBS, 1986
— তখন অবরুদ্ধ আবেগে বারবার কেঁপে ওঠে ঠোঁট, জনগণমন-র চেয়ে কোনো অংশে কম জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে না ওই কয়েকটি অক্ষর— CNMC….CNMC—CNMC.
(ক্রমশ)