নিজের বিয়ের দিনে, ঠিক যখন কুশন্ডিকা হবে, তখন মার্লন ব্র্যান্ডোকে দেখার তাড়নায় টুক করে স্মার্টফোন খুলে গডফাদার দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল আপনাদের কারোর?
কিংবা উচ্চমাধ্যমিক কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন সকালে প্রবল উৎসাহে হিউমান ডাইজেস্টিভ সিস্টেম পড়তে ইচ্ছে করেছিল কি?
বা আমফানের দানবীয় তাণ্ডবের মুহূর্তগুলিতে এক বাক্স তাস নিয়ে পেশেন্স খেলবার অদম্য ইচ্ছে জেগেছিল কিনা একটু বলবেন কেউ?
যদি উপরের কোনোটাই না হয়ে থাকে, তাহলে, এখন, মানবসভ্যতার এই অদৃষ্টপূর্ব সঙ্কটকালে, চিন্তিত, শঙ্কিত, সাবধানী না হয়ে কিছু মানুষজনের ‘দুচ্ছাই, যো হোগা সো দেখা যায়েগা’, এই মনোভাব, আমরা, ফ্রন্টলাইনাররা আর নিতে পারছি না।
হরর জঁরের ফিল্ম আর থ্রিলার দেড়েমুশে ‘এনজয়’ করা লোকজনকে বলছি, ‘ভয়’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুভব — আনন্দ, রোমহর্ষণ, কারুণ্য, ঈর্ষা, এই সবকিছু যখন বাস্তবে অনুভব করতে কার্পণ্য করি না, তখন কখনো কখনো বিভীষিকাকেও যাপন করতে হয় বৈকি! নয়ত জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায় যে!
রূঢ় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত কয়েকটি প্রশ্ন নিজের দেওয়ালে রাখলাম। হয়ত বা নিজের কাছেই।
১) কলকাতা শহরে, অন্তত দুটি বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট রয়েছে। বিগত এক বছর ধরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ স্বীকৃত কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষিত হয়ে কাজ করে চলার পরেও, সেখানে অক্সিজেন প্লান্ট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট কর্তাকর্ত্রীদের মাথায় এলো না কেন?
২) যেখানে ব্যাঙ্কিং সেক্টর থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য সমস্ত সরকারী দফতরে ৫০% কর্মী নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে সরকারী নির্দেশনামায়, সেখানে হেলথ সেক্টরে সকল কর্মচারীর প্রতিদিন (রবিবার ও ছুটির দিন সহ) ১০০% উপস্থিতির ফরমান কি জন্য?
এক সঙ্গে বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়লে, সামলাবার জন্য রিজার্ভ বেঞ্চ কোথায়?
ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা,অনাক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা, কোভিড পজিটিভ অল্প উপসর্গের সহকর্মীর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি। দায়িত্ব কার?
৩) আয়ুষ্মান ভারত না স্বাস্থ্যসাথী, কোনটা ভাল, কোভিড যোদ্ধাদের জন্য পঞ্চাশ লক্ষ বীমা দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকার, না দশ লক্ষ বীমা ঘোষণা করা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কে বেশি চিকিৎসাকর্মীপ্রেমী, এই নিয়ে মাথা খুঁড়ে ফেলছি সবাই— কিন্তু ক’জন রব তুলছি প্রাথমিক স্বাস্থ্যের (তার মধ্যে সার্বিক টিকাকরণও পড়ে) ভিত দেশের তৃণমূলস্তর পর্যন্ত আরো শক্ত করে গড়া উচিৎ, এই বলে?
বীমা নিশ্চয় প্রয়োজন, কিন্তু তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি প্রয়োজন, দেশের প্রান্তিকতম মানুষটি তার রোগে যেন একজন বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসকের পরামর্শ পায়! সেই দাবী গণতন্ত্রের মারণযজ্ঞ চলাকালীন ভুক্তভোগী নাগরিকদের মধ্য থেকে উঠেছে কি?
খাদ্য, শিক্ষা চাকরি, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, এইগুলির মত সুস্বাস্থ্যের দাবীও কি জরুরি নয় দেশের মানুষের কাছে?
৪) সমস্ত দেশ এবং এই রাজ্যেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়ানোর হুকুম হয়েছে। তার তামিলও হচ্ছে যথাসাধ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বেড তো নিজে নিজে রোগীর চিকিৎসা করবে না। কোথায় সেই অতিরিক্ত প্রশিক্ষিত ‘ম্যানপাওয়ার’?
ক্যাডার, লিডার, বাহুবলী তৈরি করার কথা মাথায় ছিল শাসকদের, কিন্তু মারীর অবশ্যম্ভাবী দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পরে, যথেষ্ট সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী কোথায় পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্নটা কারোর মাথায় কেন আসেনি?
৫) প্রশাসন আর রাজনীতিজ্ঞরা না হয় সভা, মিছিল, রোড শো, ব্রিগেড জমায়েত এইসব কর্মকান্ড উৎসাহিত করেছেন, সাধারণ মানুষ হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার পিছনে অনুসরণকারী ইঁদুরের মতো ছুটেছেন কেন?
৬) যেখানে স্কুল, কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, সমস্ত রকম পরীক্ষা স্থগিত, সেখানে শুধু নির্বাচন আর ধর্মীয় সমাবেশে ছাড়পত্র কেন?
ভারতবর্ষের মানুষ কি বিশ্বনাগরিকদের তুলনায় বেশি পাপী? তাই এত পুণ্যস্নানে পাপস্খালনের হিড়িক?
জানি না, জানতে চাইও না। শুধু জানি, প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ দৈনিক সংক্রমণ আর বাইশশোর কাছাকাছি দৈনিক মৃত্যুর পরেও এই অকৃতজ্ঞ দেশে কারো মনে পড়েনি, আজ বিশ্ব ল্যাবরেটরি দিবস।
আমার সদা কর্মব্যস্ত মেডিক্যাল ল্যাব টেকনিশিয়ান ভাইবোনদের আজকের দিনের শুভেচ্ছা রইল।