মা- মাটি- মানুষ
ভোর সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে উঠে পড়াশোনা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এক সম্পাদিকা দিদি একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের জন্য করোনা নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ লেখা দিতে বলেছেন। এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় কী করা উচিত; কোনটা হচ্ছে, কোনটা হচ্ছে না; কী করলে নিরাপদে থাকা যাবে।
যত না পড়ছিলাম, তার চেয়ে বেশি হাই তুলছিলাম। বিছানা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তবু নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছিলাম- আমার এই গুরুগম্ভীর লেখা বহু মানুষ পড়বেন, তাঁদের কাজে লাগবে। তাছাড়া আমি যা লিখি সবই আজে বাজে, সে বদনামও ঘুচবে।
হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। অত্যন্ত বিরক্তিকর। এমনিতেই সারাদিন ধরে রোগী দেখি। ভোর বেলার ঘুমকে কম্প্রোমাইজ করে পাওয়া ১ ঘন্টার উপর কেউ যদি হামলা শুরু করে- অত্যন্ত হতাশ লাগে।
গতকালই বড় মেয়ে মোবাইলে রিংটোন করে দিয়েছে- “আমাকে আমার মত থাকতে দাও।“ এজন্মে আর নিজের মত থাকা হলো না। গালি দেব ঠিক করে বারান্দা থেকে মাথা বাড়ালাম।
বয়স্ক একজন ভদ্রলোক। ভালোমতোই চিনি। মাঝে মাঝেই দেখাতে আসেন। তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, মা মাঝরাতে মারা গেছেন। আপনারই রোগী ছিলেন। রাতে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি।’
এক্ষেত্রে কাটানোর উপায় নেই। বললাম, ‘কোথায় বাড়ি?’
‘এই তো পাশেই, দেশবন্ধু রোডে।’
বললাম, ‘একটু পরে গেলে আপত্তি নেই তো। সাতটায় চেম্বার আছে। তার আগে আপনার বাড়ি ঘুরে যাব।’
‘না না, কোনো অসুবিধা নেই। আমি আরও দেরিতে আসতাম। কিন্তু ভাবলাম আপনি যদি বেরিয়ে যান।’
ফোন নাম্বার নিয়ে ভদ্রলোককে বিদায় করলাম। পড়াশুনো করে তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লেখার প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। চায়ের জল চাপিয়ে মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলাম।
এই যে স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে পরব, ছাড়া পেতে পেতে রাত দশটা। তখনও আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়া হবে না। ফোন খোলার সাথে সাথে একগাদা ফোন আসবে– কার করোনা ধরা পড়েছে, কার স্যাচুরেশন কমছে, কার খুক খুকে কাশি হচ্ছে। সারাদিন বকবক, বাড়ি ফিরেও বকবক। বাড়ির লোকজন যে এখনও আমাকে সহ্য করছে এই যথেষ্ট।
সাড়ে ছটায় স্কুটার নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতে হাজির হলাম। কেউ মারা গেলে পাড়া-প্রতিবেশীরা, আত্মীয়রা আসে। কিন্তু এই বাড়ি বেশ ফাঁকা। ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই।
হয়তো এত সকাল বলে কেউ আসেনি। খবর পায়নি। বেলা বাড়লে আসবে। তাছাড়া ইদানীং লোকজন নতুন করে করোনার ভয় পেতে শুরু করেছে।
বুড়িকে দেখলাম। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই চিরমুক্তি ঘটেছে। তবু ভালো করে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছিল?’
‘আজ্ঞে, দু-তিন দিন ধরে হালকা জ্বর। খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাল রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট।’
ভাবলাম করোনাও তো হতে পারে। ইদানীং হঠাৎ করেই বুড়ো- বুড়িদের মধ্যে মড়ক লেগেছে। রোজই একাধিক ডেথ সার্টিফিকেট লিখছি। যাকগে, অতো চিন্তা ভাবনা করে লাভ নেই। আমায় সাতটার মধ্যে ঘোলা পৌঁছাতে হবে। ভদ্রলোককে বললাম, ‘আমার শেষ প্রেসক্রিপশনটা দিন, আর আধার কার্ড।’
ভদ্রলোক প্রেসক্রিপশন দিলেন। তারপর বললেন, ‘আধার কার্ড তো নেই ডাক্তার বাবু।’
এই অঞ্চলে অনেক বুড়ো বুড়ির আধার কার্ড নেই। তাই ঘাবড়ালাম না। বললাম, ‘ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড কিছু একটা দিন।’
আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখছি। হাতে সময় কম। ভদ্রলোক খুঁজেই যাচ্ছেন, পাচ্ছেন না। এতো বেশ জ্বালা। বললাম, ‘আপনি আগে থেকে সব জোগাড় করে রাখবেন তো।’
ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, ‘খাটের নিচে মায়ের তোরঙ্গের মধ্যে দেখ না।’
ভদ্রলোক তক্তপোশের তলা থেকে একটা পুরোনো লোহার তোরঙ্গ টেনে বার করলেন। বেশ শক্তপোক্ত। তালা দেওয়া। চাবি বুড়ির আঁচলেই বাধা ছিল।
তিনি তালা খুললেন। বললেন, ‘এসব মায়ের সম্পত্তি। ওদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন। যক্ষের মতো আগলে রাখতেন।’
একটি নকশিকাঁথা বেরোলো। কয়েকটি ভাজে ভাজে ফেঁসে যাওয়া রঙিন শাড়ি। তারপর দুটি বিবর্ণ পাঞ্জাবি ও ধুতি৷ ভদ্রলোক ফ্যাকাসে হাসলেন, ‘দেখেছেন মায়ের কাণ্ড। ২২ বছর আগে বাবা মারা গেছেন। এখনো…’
ভোটার কার্ড পাওয়া গেছে। তোরঙ্গ বন্ধ করলেই হয়। ভদ্রলোক তবুও ভেতরের জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে দেখছেন। যেন কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন না।
একটা টিনের ছোটো বাক্স বেরোলো। যেরকম বাক্স নিয়ে আমরা প্রাইমারি স্কুলে যেতাম। পরে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ওই বাক্সের মধ্যে লোকাল ট্রেনের টিকিট জমাতাম।
আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে আড় চোখে চাইছি। ভদ্রলোক টিনের বাক্সটা খুললেন। তিন-চারটি সাদা কালো ছবি বেরোলো। একজন শার্ট-প্যান্ট পরা তরুণের পাশে ঘোমটা মাথায় এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক লজ্জিত ভাবে হাসলেন। বললেন, ‘ভালোই হলো, আমার কাছে ওনাদের দুজনের কোনো ছবি নেই।’
উনি এবার একটা কৌটো বার করলেন। ঢাকনা খুলে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী আছে ওতে?’
‘মাটি, আমার জন্মভূমির মাটি। খুলনার মাটি।’ এই প্রথম দেখলাম ওনার চোখ জলে টলমল করছে। নিষ্প্রাণ মাটির স্পর্শে তাঁর মায়ের স্মৃতি জেগে উঠেছে।
কিন্তু আমার আর মা- মাটি- মানুষ নিয়ে চর্চা করার সময় নেই। ভদ্রলোককে স্মৃতির মধ্যে একা রেখে স্কুটারে ঘোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।