“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও”- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতার লাইনটা প্রথম পড়েছিলাম বিজনের ঘরে, মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের সাদা চুনকাম করা হলদেটে দেওয়ালে। কয়লা দিয়ে আঁক কাটা। নানা কবিতার লাইন লিখে ও দেওয়াল সাজাতো। সেই বয়সে চোখে যখন অনেক স্বপ্ন ছিল, বুকে অনেক সাহস ছিল, তখন এটা পড়ে মনে হয়েছিল এ লাইনটা তো ডাক্তারদের নিয়েই লেখা- নিজের অজান্তেই এটা যেন জীবনদর্শন হয়ে গেল-মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও। বিজন আজ নেই, সঙ্গে নেই আরো অনেকেই যাঁদের আজ আমার আশেপাশেই থাকার কথা ছিল-কারণ আমরা ঠিক সময় তাদের পাশে থাকতে পারিনি। জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি, “তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো আমি তোর পাশে আছি”। হাত ধরে এক সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে বলিনি, “তোকে কেউ ভুল বুঝছে না, আমরা সবাই তোর কথা ভাবি। রুমালে চোখ মোছ, মুখে জল দিয়ে আয়, আমি চা-টা বানিয়ে আনছি।”
যখন ডাক্তারি করি লোকে রোগ নিয়ে আসে, সমস্যা নিয়ে আসে আর আসে একরাশ দুঃখ নিয়ে। চারদিকে এত লোকের মাঝে সে যেন একা। জানি, তার শারীরিক অসুখে ইন্ধন জুগিয়েছে অনেক পারিপার্শ্বিক অবস্থা। মনে হয় বলি, “তোর কোনো ওষুধই লাগবে না রে”। আমরা আকাশ দেখতে দেখতে, কথা বলতে বলতে এক সঙ্গে দুঃখটাকে ভোগ করি, ভাগ করে নিই।
আমরা তো সবাই চিকিৎসক। সমাজের ক্ষত সারানোই আমাদের কাজ। শিক্ষক, কেরানি, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, নেতা সবাই যদি নিজের কাজটা দায়িত্ব নিয়ে করি, ভালোবেসে করি, সৎভাবে করি তাহলেই তো সমাজের অনেক ঘুন ধরা জায়গা সারিয়ে তুলতে পারবো। যদি একে অপরের সঙ্গে একটু হেসে কথা বলি, একটু ধৈর্য নিয়ে অন্যের কথা শুনি একবার মনে করিয়ে দিই, “তুমি ডাকলেই আমি আছি, তাহলেই তো সবাই মন ভালো করে নিতে পারি”।
ছোটোবেলায় শেখা যোগবিয়োগের অঙ্কটা শুধু জমা খরচের হিসেবে না লাগিয়ে যদি সম্পর্কে, বোঝাপড়ার কাজে লাগাই তাহলেই অনেক কুয়াশা কেটে যাবে, অনেক যন্ত্রণা, বিচ্ছেদ, শোক সহনীয় হয়ে উঠবে। আর তা না হলে ডাক্তারি ভাষায় মাল্টি অর্গান ফেলিওর হলে আর করার কিচ্ছু থাকবে না।