এই সিরিজটা দু’বছরের পুরোনো লেখা। করোনাকালে স্টেরয়েড নতুনভাবে বহুচর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে। আশঙ্কাজনক কোভিড রোগীর চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার হচ্ছে। স্বভাবতই স্টেরয়েড নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই কারণেই পুরোনো লেখাগুলো সামান্য পরিমার্জন করে নতুন করে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
প্রথমে বিশেষ কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করি। তাতে বিষয়টার গভীরতা ও গুরুত্ব বুঝতে সুবিধে হবে। প্রত্যেকটি ঘটনাই আমার নিজের চোখে দেখা। এবং ঘটনাগুলির প্রতিটিই ঘটে চলা এরকম আরো অসংখ্য ‘কেস’-এর সামান্য হিমশৈলের চূড়া।
১.
৪০ বছরের পুরুষ। গলার চারদিকে অনেকগুলো উঁচু উঁচু ডিমের মত দেখতে জিনিস লক্ষ্য করছেন মাস তিনেক ধরে। মাঝে মাঝে ঘুসঘুসে জ্বর, দুর্বলতা। ফোলা অংশগুলোয় ব্যথা সেরকম নেই। পাড়ার কোয়াক, এ ডাক্তার সে ডাক্তার ঘুরে শেষমেশ ডায়াগনোসিস হ’ল টিউবারকুলার অ্যাবসেস। সোজা ভাষায় বললে টিবির ফোঁড়া। ভদ্রলোকের মোটেই বিশ্বাস হ’ল না তাঁর শরীরে টিবি আসতে পারে। তিনি বেশ অবস্থাসম্পন্ন, স্বচ্ছল পরিবারের। তিনি জানেন, টিবি-ফিবি ওসব গরীব লোকের রোগ। তাঁর এই চিকিৎসা পছন্দ হ’ল না। শহরের নামকরা হোমিওপ্যাথের কাছে গেলেন। তিনি প্রথমেই ‘বিষাক্ত ও অপ্রয়োজনীয়’ অ্যালোপ্যাথি ওষুধ বন্ধ করার নিদান দিলেন। তারপর অর্থলোলুপ মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারকে বাক্যবাণে সংহার করলেন। তারপর তাঁর হোমিও দাওয়াই শুরু হ’ল। বলে দিলেন ওগুলো আসলে টিউমার। ওষুধ চলাকালীন পেঁয়াজ বন্ধ করতে হ’ল। তারপর দীর্ঘদিন বিশ্বাস রেখে ওষুধ খেয়ে যেতে বললেন। প্রায় তিনমাস কাটার পরেও রোগ সারার নাম নেই বরং বেড়ে চললো। এদিকে একদিন পাড়ার দোকানের ছেলেটা ফিসফিস করে বলে গেল হোমিও পুরিয়ার মধ্যে একটা ট্যাবলেট গুঁড়ো করে মেশানো হয়। সেটাই তাঁকে তিনমাস ধরে খাওয়ানো হচ্ছে। ট্যাবলেটের স্ট্রিপের গায়ে লেখা- প্রেডনিসোলোন!! যাইহোক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগে তিনি সরকারি হাসপাতালে আসেন। ততদিনে টিবি ছড়িয়ে গেছে অনেকটা। যে সরকারি হাসপাতালকে চিরকাল গালাগালি দিয়ে এসেছেন সেখানেই প্রায় মাস দুয়েক ভর্তি থেকে তারপর নিয়মিত আউটডোরে চিকিৎসার পর সুস্থ হন।
২.
আমাদের হোস্টেলের মেসে যে রোগা লিকলিকে ছেলেটা কাজ করতো সে একদিন বাড়ি গিয়ে চটজলদি মোটা করে দেওয়ার আয়ুর্বেদ ডাক্তারের খোঁজ পায়। চেম্বারের সামনে বড় বড় বিজ্ঞাপন- “আপনার হাড় জিরজিরে চেহারা নিয়ে চিন্তিত? ছ’মাস ওষুধ সেবন করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোন” অতঃপর ছেলেটা কিছু কালো কালো শিকড়-বাকড় আর রোজ একটা করে ট্যাবলেট নিয়মিত খেয়ে গেল। মাস চারেক বাদে তার এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) টিবি ধরা পড়লো। এই টিবি মারাত্মক রকমের প্রাণঘাতী আর সাধারন টিবির ওষুধ দিয়ে এর চিকিৎসা করা যায় না।
ট্যাবলেটটা ছিল ডেক্সামেথাজোন!!!
৩.
পাঁচ বছরের বাচ্চা। কাশি আর ধূম জ্বর। হাসপাতাল প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে। গ্রামে পাশ করা ডাক্তার নেই। পাড়ার কোয়াক ভরসা। দু’দিনে জ্বর কমছে না দেখে কোয়াক বাচ্চার বাবার হাতে ধরিয়ে দিল ওমনাকর্টিলের বোতল। কোয়াক শুধু জানে, আর কিছুতে কাজ না হ’লে ওমনাকর্টিল দিলেই সব রোগ সেরে যায়। একদিন যায়,দু’দিন যায়… জ্বর কমে না। দশদিনের মাথায় প্রায় ধুঁকতে থাকা বাচ্চা হাসপাতালে এসে পড়লো। অবস্থা অভিজ্ঞ ডাক্তারের চোখ এড়ালো না। শহরে রেফার করা হ’ল। বুকের খোলে পুঁজ থিকথিক করছে। নিউমোনিয়া বাড়তে বাড়তে এই অবস্থা!! আইসিইউ-তে হপ্তা তিনেক,তারপর অপারেশন টেবিল ঘুরে টুরে প্রায় মাস দুয়েক বাদে বাড়ি ফিরেছিল ছেলেটা।
৪.
এবার পাশ করা মডার্ন মেডিসিনেরই ডাক্তার। সাত বছরের মেয়েটার দাদ। প্রেস্ক্রিপশনে বাজার চলতি দাদের ওষুধ লিখে দিলেন। তার কম্পোজিশনে লেখা ছিল, নিওমাইসিন-মাইকোনাজোল-ক্লোবিটাসল। প্রথম পাঁচ-ছ’দিনে ম্যাজিক! অনেকটা কমে গেল! চুলকুনিও ভ্যানিশ! কিন্তু তারপর… দুদিন ওষুধ বন্ধ হলেই দাদ আবার ঘুরে ঘুরে আসে। চাকার মত দেখতে দাদের আকার-আকৃতিও কেমন বদলে যায়। এদিকে দীর্ঘদিন ওই মলম লাগিয়ে আশেপাশের চামড়াটা কেমন পাতলা আর লাল হয়ে এসেছে…
৫.
প্রায় একইরকম ঘটনা হয়েছিল চটজলদি ফর্সা করার ক্রিম মেখে।
………
ওপরের ঘটনাগুলোর কোনটাই বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা মিল আছে, যাকে আমরা স্টেরয়েড বলি। স্টেরয়েড নামটা শুনেই অনেক শিক্ষিত মানুষ চমকে ওঠেন। সত্যিই কি স্টেরয়েড এরকম ক্ষতিকর জিনিস? চোখ রাখুন পরবর্তী পর্বগুলোতে।