গত সপ্তাহে রবিবার মালদায় যেদিন পৌঁছুলাম ট্রেন থেকে নেমেই দেখি কোমরে অসহ্য ব্যথা। কোমরে ব্যথার সমস্যা আমার একটু আছে। মাঝে মাঝে চাড়া দেয়। তাই তেমন গা করলাম না। কয়েকটা কোমরের ব্যায়াম করলেই অনেকটা কমে যায়। সেসব চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু দেখলাম তাতে তো কমছে না উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
বিকেল থেকে গলা খুসখুস শুরু হল সঙ্গে শুকনো কাশি। দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাশির ওষুধ কিনে খাওয়া শুরু করে দিলাম। গায়ে হালকা জ্বর। নিরানব্বইয়ের মত। আমাদের কোয়ার্টারে অনেকে একসাথে থাকি। তাই নিজের ঘর থেকে বাইরে বেশি বের হলাম না। পরের দিন থেকে শরীর যথেষ্ট দুর্বল হতে শুরু করল। রাতে ট্রেনের টিকিট কাটা। ভোরবেলাতেই বাড়ি ফিরে এলাম।
বাড়ির সবাইকে বললাম আমার মনে হচ্ছে কোভিড। দোতলার ঘরে নিজেকে অন্তরীণ করলাম। কোমরে ব্যথাটা প্রচন্ড বেড়ে গেল। প্রায় বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েই গেলাম। জ্বর খুব বেশি না হলেও ৯৯ থেকে ১০০ এর মধ্যে আসতে লাগল। প্যারাসিটামল না খেলে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছিল। কাশিটাও মাঝে মাঝে আসছিল। তার সাথে নাক দিয়ে জল পড়ছিল অবিরত। একদম টিপিক্যাল ফ্লু-এর সিম্পটম। কোভিড কি? সেদিন নানা জায়গায় খোঁজ নিয়ে কোথাও টেস্ট করাতে পারলাম না। একটি ল্যাব বলল, তারা পরের দিন করে দেবে তবে রিপোর্ট আসতে ৫ কি ৬ দিন সময় লাগবে। পরিস্থিতি অনুসারে বেশি সময়ও লাগতে পারে। তারা আরও বলল, বিল দেবে ৯৩৫ টাকার আর আমাকে দিতে হবে ১৮০০ টাকা। তবে ডাক্তার বলে ১০০ টাকা কম নেবে।
আমি খুব উৎসাহ দেখালাম না। আরেক জায়গায় ফোন করায় তারা বলল দুদিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে, ১৩০০ টাকা নেবে। ডাক্তার বলে কিছুটা কম। আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরের দিন টেস্ট হবে। এদিকে সন্ধ্যে থেকেই নাকের গন্ধ একদম চলে গেল। কোমরে ব্যথার জন্য যে ভোলিনি মলম লাগাচ্ছি নাকের খুব কাছে এনেও তার কোনো গন্ধ পাচ্ছি না। ডেটল, ফিনাইল, টুথপেস্ট, কেরোসিন তেল কোনোকিছুর ছিটেফোঁটাও গন্ধ মালুম হচ্ছে না। সুতরাং আমার আর কোনো সন্দেহই রইল না যে আমার কোভিড হয়েছে।
সুতরাং আমি নিজেকে ঘরে আরও সতর্কতার সঙ্গে অন্তরীণ করলাম। এদিকে শরীরের দুর্বলতা এতই বেড়ে গেল যে বিছানা থেকে প্রায় নামতেই ইচ্ছে করছে না। সারাদিন শুয়ে থাকতে পারলেই ভালো। বাড়িতে কারোর কোভিড হলে সবাই খুব ভয়ে থাকে। আমার বাড়ির লোকেরাও তার ব্যতিক্রম নয়। আমার মা আর মেয়ে কথা না শুনে মাঝে মাঝেই আমার ঘরে চলে আসে। পালস অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন আর মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখে যায়। কিছুতেই না করলে শোনে না। শেষে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে ঘরে ছিটিকিনি লাগিয়ে রেখেছি।
আমার বউ সবে কোভিড থেকে উঠল। তাই সে মাস্ক পরে কিছুটা সাহস নিয়ে আমার কাছে আসছিল। গন্ধের পর দেখলাম স্বাদটাও একদম চলে গেল। যা খাচ্ছি কিছুতেই কোনো স্বাদ পাচ্ছি না। না ঝাল না টক। সব কিছুই নোনতা আর পানসা লাগছে। বুঝলাম এ তো একশ শতাংশ কোভিড। আজ পর্যন্ত নাকে গন্ধ চলে গেছে এমন যতজনের কোভিড টেস্ট করতে দিয়েছি সক্কলের পজিটিভ এসেছে। একদম একশোয় একশ। সুতরাং এ যে কোভিড এ নিয়ে আমার আর কোনো সংশয় নেই।
মাথা দপদপ করছে। ধরে আছে। কিছু পড়তেও ভালো লাগছে না। বেশিরভাগ ইংরিজি বইগুলো কিন্ডল-এই পড়ি। মুরাকামির ‘দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল’ পড়ছিলাম। অনেকটা এগিয়েছে। যে কোনো বই পড়তেই আমার খুব সময় লাগে। পড়তে পড়তে উল্টোপাল্টা ভাবনা ঘিরে ধরে। তবে মুরাকামি তো জাদুকর। তার উপন্যাসের তিন চারটে চ্যাপ্টারের ধাক্কা সামলে দিলেই আপনি তাকে আর ছাড়তে পারবেন না। আমিও তেমন এক জায়গায় গিয়েই আটকে ছিলাম। তবে এবার ভুল করে কিন্ডলটা মালদায় ফেলে এসেছি। তাই ঘরে শুয়ে হাপিত্যেশ করছিলাম।
মুরাকামির এই উপন্যাসটার সাথে কোভিডের এক মর্মান্তিক অনুষঙ্গ আছে। মুরাকামির ‘কাফকা অন দ্য শোর’ পড়ে আমি ফেবুর ‘বইপোকা’ বলে একটা গ্রুপে এক রিভিউ লিখেছিলাম। রিভিউ টিভিউ আমার মত লোকের লেখা খুব উচিত না। তার জন্য অন্যরা আছেন। তবু একান্ত প্রেম থেকে লেখা। বন্ধু যুবক কবি অভিষেক তখন চিনে কোভিডের জন্য কোয়ারিন্টিনে। ও কমেন্টে লিখেছিল, হৃষিদা মুরাকামির ‘দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল’ পড়। মুগ্ধ হয়ে যাবে।
আজ যখন সেই উপন্যাস পড়া শুরু করেছি তখন অভিষেক কোভিডের কাছে পরাজিত হয়ে গত নভেম্বরে মেডিকেল কলেজে অন্য ভুবনে চলে গেছে। পড়তে যখন শুরু করেছি তখন আমার কোভিড লক্ষণ দেখা দিয়েছে শরীরে। পৃথিবীতে কিছু আশ্চর্য সমাপতন ঘটে যায় কখনও কখনও। কদিন আগেও চন্দ্রালোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, সত্যিই কি পূর্ণিমায় সারা পৃথিবীতে অনেক ঘোড়া মারা যায়? নারীর ঋতুচক্রের সাথে চন্দ্রকলার যেমন যোগ আগে তো সেভাবে কখনও ভেবে দেখে নি।
যা হোক এই মুহূর্তে মুরাকামি নেই তো কী হয়েছে অরিন্দম চক্রবর্তীর ‘ভাত কাপড়ের দ্বন্দ্ব ও কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস’ এনে মাথার কাছে রাখলাম। ঠিক করলাম গুরুদেবের ‘চতুরঙ্গ’ আরেকবার পড়তে হবে। আগামি সতের দিন যখন এই একই ঘরে নিভৃতাবাসে থাকতে হবে তখন বই ছাড়া আর কিই বা পাব? নেটফ্লিক্সে দু-চারটে সিনেমা দেখা যেতে পারে। সে না হয় পরে ঠিক করা যাবে। এমন নানান পরিকল্পনা চলছে কিন্তু নড়তে গেলেই তীব্র কোমরে ব্যথা আর দুর্বলতা। কিছুক্ষণ ঘরে হাঁটলেই হাঁপ আসছে।
এর মধ্যে রুগিদের ফোন তো অবিরত আছে। আছে হোয়াতে মেসেজের বন্যা। যাকে কোভিড বলে চিকিৎসা করেছি তাদের বাড়ির সবাই এমনকি তাকে যারা দেখতে এসেছে তারাও কোভিডে আক্রান্ত। তাদের সবাইকে চিকিৎসা করতে হচ্ছে অ্যাডভাইজ দিতে হচ্ছে। ৪০০ টাকা পকেটে পুরে চার হাজার টাকা লস করছি! যা হোক দোষ তাদের নয়। অনেকেই ভদ্রতায় গুগল পে-র নম্বর চাইছে। আমার এভাবে টাকা নিতে লজ্জা লাগে। তাই তাদের দাবিতে সাড়া দিচ্ছি না। এরই মধ্যে অনেককে জানিয়েও দিয়েছি আমার কোভিড হয়েছে। চেম্বার কিছুদিন বন্ধ থাকবে।
মেডিকেল কলেজের বন্ধুদের গ্রুপ আর আমাদের ছোট ট্রেকিং-এর হোয়ার গ্রুপ-এই দুটো গ্রুপেই আমি একটু সরব থাকি। বালিশে মাথা রেখে সেলফি তুলে জানিয়ে দিলাম ‘আমি কোভিড আক্রান্ত’। সবাই ডাক্তার। সবাই উৎসাহ দিল। অভয় দিল। বাড়ির লোকের খোঁজ নিল। কেউ বলল, নিজের চিকিৎসা না করতে। কারোর সাথে অন-লাইন কনসালটেন্সি করতে। কেউ লিখল, বাগচিদা রূপিনে ট্রেক করতে যাবার আগে আমরা কিন্তু কেউ মরছি না।
মনের মধ্যে বেশ একটা রোমান্স আসতে শুরু হল। মৃত্যুকে আমি সবসময় খুব উপভোগ করি। অবশ্যই মৃত্যুযন্ত্রণা ছাড়া। সেই মৃত্যুটা এই সময় বেশ রোমান্সের রসে আর্দ্র হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। রোমান্সটা টইটুম্বুর হল রাতের বেলায়। দরজা বন্ধ করে একা দোতলার ঘরে শুয়ে আছি। পায়ের কাছে খোলা জানালা। জ্বরের ঘোরে বিচ্ছিন্ন ঘুম আসে। ঘুম এলেই স্বপ্ন। আর তাতে শুধুই মারকাটারি হিন্দি আর হলিউডি ছবির সিকোয়েন্স। আমার এক হাতে তামিল মাশাতে ‘আরুভিল’ অন্য হাতে ‘এ কে ৪৭’। এক হাতে দুশমনের কচুকাটা করছি অন্যহাতে ঢিশকাঁও ঢিঁশকাও। এসব যখন চলছে হুঁশ নেই আমি সলমন নাকি কিনু রীভস। অ্যাকশন সিকোয়েন্স যখন শেষ তখন দেখি আমার হাতের মধ্যে দিয়ে কোন মৃণালভুজা তার বাহু প্রবেশ করিয়ে বসে আছেন। কোভিডের জন্য আমার নিজের গায়ে ঘামের গন্ধ পাচ্ছি না কিন্তু তার দেহের সুবাস যেন নাকে এল। পরনে স্লিভলেস কিন্তু মুখটা কিছুতেই দেখতে পেলাম না। এই হিরোইনটি কে? কিসেরই বা যুদ্ধ? ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে এই সেক্সুয়াল ড্রিমের কিছু একটা ব্যাখ্যা উনি অবশ্যই দিতে পারতেন। এখন আর কাকেই বা জিজ্ঞাসা করি?
তবে এই স্বপ্ন কিন্তু মনে অনেক পাপবোধ নিয়ে এল। যে বউ সারাদিন আমার এত সেবা করছে ও আর এস বানিয়ে দিচ্ছে, ফল কেটে দিচ্ছে, কিছুক্ষণ পরপর স্যাচুরেশন চেক করছে, হ্যাঁ গো কেমন আছো, কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? এসব করছে- তার স্মৃতি স্বপ্নে একবারও এল না। এত পাপ আমার মনে? এই পাপ নিয়ে কোভিডে আমার মরাই উচিত।
আপনারা বলতে পারেন, দেখুন হিরোইনের মুখ আপনি দেখেন নি সেটা তো শুভ্রার মুখও হতে পারে? হ্যাঁ, হতে পারে অবিশ্যি। তবে এই এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বউকে আমি কখনও স্লিভলেস পরতে দেখি নি। তবে তিনি কে?
এসব যখন ভাবছি তখনই হোয়াতে মেসেজ এলঃ আর টি পি সি আর অফ ডক্টর হৃষীকেশ বাগচী ইজ নেগেটিভ। বুঝুন ঠ্যালা! সবে রোমান্স দানা বাঁধছিল,এর মধ্যেই রসভঙ্গ!
সে যাই হোক রসিকতা অনেক হোল। কাজের কথায় আসি। কাল রাতে আমার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আজও আমার নাকে কোনো গন্ধ নেই। মুখে স্বাদ নেই। জ্বর নিরানব্বই। মাঝে মাঝে হালকা কাশি। শরীর যথেষ্ট দূর্বল। এই যে সকালে বসে এই প্রতিবেদন লিখছি কোমর টনটন করছে মাথা ঘোরাচ্ছে। বিছানা আবার ডাকছে। এ অবস্থায় আমার যে কোভিড এই নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। আর টি পি সি আর ৩০% ক্ষেত্রে নেগেটিভ আসতে পারে। আমি হয়ত তার দলে পড়ে গেছি। কিংবা এবার প্রচুর কোভিড পাচ্ছি যাদের প্রায় হাসপাতালে ভর্তির মত অবস্থা অথচ কোভিড নেগেটিভ। এইচ আর সিটি চেস্ট করালে দেখা যাচ্ছে সারা চেস্টে ভর্তি ‘গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি’।
আমার পক্ষে একটা এইচ আর সি টি করা যায়। কিন্তু আমার কাশি খুব কম থাকায় এইচ আর সি টি করে খুব সুবিধে হবে কি? রবিবার আবার মালদার টিকিট কাটা। এ অবস্থায় কী করা যায় সহকর্মীদের সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণ ওষুধপত্র সবই শুরু করেছি। চালিয়েও যাব। স্টেরয়েড এখনও শুরু করার প্রয়োজন বোধ করি নি।
চেম্বার আপাতত বন্ধই রেখেছি। শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে চেম্বারে বসা উচিত হবে না। জানি অনেকের অনেক অসুবিধে হচ্ছে। সবাই আমাকে নিরন্তর ফোন করে চলেছেন। আপনারা অনুগ্রহ করে আর কয়েক দিন অপেক্ষা করুন। এক ঘন্টা চেয়ারে বসে লিখছি তাতেই আমার মাথা ঘোরাচ্ছে। তিন ঘন্টা একটানা রুগি দেখতে আমার আরো কিছুটা সময় দরকার।
তবে এই দোলাচলের মধ্যে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার যেটা হয়েছে তা হল কাল রাত থেকে স্লিভলেস লাপাতা! আমি যত বলছি আমি কোভিড নেগেটিভ প্লিজ কাম।
তাহার দেখা নাই।