ষষ্ঠীর সকালে এক মনে রোগী দেখছি, দরজার ফাঁক দিয়ে এক বয়স্ক মহিলা মাথা বাড়ালেন, ‘ডাক্তারবাবু, একটু কাগজ হবে?’
একটা বাতিল প্রেশক্রিপশনের অর্ধেকটা দিয়ে রোগী দেখছি, একটু পরেই আবার কাঁচুমাচু মুখটা দেখতে পেলাম,
‘ডাক্তারবাবু, যদি একটা পেন পাওয়া যায়?’
হেসে বললাম, ‘কী ব্যাপার, ডাক্তারের চেম্বারে এসে অংক করবেন নাকি?’
মহিলা বয়স্ক হলেও বেশ রসিক। একগাল হেসে বললেন, ‘নানা, প্রেমপত্র লিখব।’
অন্যদিন হলে এমন রসিকতায় মেজাজটা খিঁচড়ে যেতো। আজ দিনটা অন্যরকম হওয়ার জন্য খিঁচড়ালো না। দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে। কাল রাতে মণ্ডবে ঠাকুর চলে এসেছে। এবারের ষষ্ঠী পুজো সকালেই হচ্ছে। মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে। এই সময়ে রাগারাগি করা বেশ মুশকিল।
বললাম, ‘কাকে লিখবেন?’
উনি দাঁতহীন গালে টোল ফেলে হাসলেন। বললেন, ‘কাকে আবার, আমার বুড়োকেই লিখব। এই বয়সে আর কে পাত্তা দেবে। তবে দেখবেন, তাতে আপনার সুবিধাই হবে। হাতে যখন সময় আছে, তাড়াতাড়ি লিখে ফেলি।’
রোগী দেখতে দেখতে বয়স্ক মহিলার কথা ভুলেই গেছিলাম। আধঘন্টা বাদে তিনি আরো বয়স্ক এক ভদ্রলোককে ধরে খুপরিতে ঢোকালেন। সাবধানে তাঁকে বসিয়ে একটা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন প্রেমপত্র। পড়ে হাসবেন না যেন। ক্লাস এইটের বিদ্যা। অনেক বানান ভুল আছে।’
বয়স্ক ভদ্রলোক বেশ নড়বড়ে হলেও তেজ কম নয়। বললেন, ‘এতো কিছু লেখার কী দরকার ছিল? আমার কী স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে? আমি কী গুছিয়ে সবকিছু ডাক্তারবাবুকে বলতে পারতাম না?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ওরে আমার স্মৃতিধর পণ্ডিত। বলতো আজ সকালে রুটির সাথে কী তরকারি খেয়েছো?’
ভদ্রলোক গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। ওনার স্ত্রী হেসে বললেন, ‘সকালে কী খেয়েছো সেটাই বলতে পারছ না, আর তুমি ডাক্তারবাবুকে সমস্যার কথা গুছিয়ে বলবে?’
বয়স্ক ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘তুমি আজকাল যা একঘেঁয়ে রান্না করো, রোজই একই তরকারি। একদিন লুচি মাংস করলে ঠিকই মনে থাকতো।’
‘আহা… সখ কত। কাঁচকলার তরকারি খেয়েও চৌদ্দ বার বাথরুমে ছোটো। লুচি মাংস খেলে আর দেখতে হবে না।’
আমি দুজনের খুনসুটি শুনতে শুনতে হাসিহাসি মুখে কাগজটা পড়ছিলাম। উনি বেশ গুছিয়েই স্বামীর সমস্যার কথা লিখেছেন। ভদ্রমহিলা বললেন, :যত দিন যাচ্ছে বুড়োটা একেবারে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ শুধু বায়না- এই চাই ওই চাই। আমিও তো বুড়ী হচ্ছি। একা কীভাবে এই ধেড়ে খোকাকে সামলাবো? আমাদের ছেলে মেয়েও নেই যে তারা একটু সাপোর্ট দেবে। দেখুন না, আধঘন্টা পেচ্ছাপ চাপতে পারে না, বায়না ধরেছে এখান থেকে বেরিয়ে ঠাকুর দেখতে যাবে। তার জন্য হাগিস পরিয়ে এনেছি।’
বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখের এক কোণে লালা গড়িয়ে পড়ছিল। মহিলার কাপড়ের আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে দিলেন। দৃশ্যটা এতো সুন্দর লাগলো অনেকদিন আগে হারিয়ে ফেলা মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
মহিলা যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘যাই যেটুকু পারি ঘুরে নি। পরের বছর আর দুজনে একসাথে ঘোরা হবে বলে মনে হয় না। ওনাকে তো টোটো থেকে নামানো মুশকিল। টোটোতে বসে বসেই প্যাণ্ডেল দেখবে। আপনিও ঠাকুর- টাকুর দেখবেন। দেখবেন মন ভালো হয়ে যাবে। আপনার পুজোও খুব ভালো কাটুক।’
বেশ সুন্দর, ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলো গুছিয়ে লেখার মধ্যে অনেক মুন্সীয়ানার প্রয়োজন, যেটা আপনার লেখায় পেলাম। ভাল লাগলো।