হঠাৎ করে কিছু মানুষ সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে চলে যায়। আবার সবকিছু নতুন করে গুছিয়ে নিতে হয়। কিন্তু সব কিছু কী ঠিক আগের মতো হয়?
দশমীর সকালে রোগী দেখছিলাম। খুপরিতে ভিড় কম। বেশ কম। দুপুর একটার মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়া উচিৎ। তারপর পুরো দিনটাই ছুটি।
বেশিরভাগই এমারজেন্সি রোগী। কারো পেটে ব্যথা, কারো ভয়ানক জ্বর। একজন তো আমার টেবিলেই বমি করে দিলেন। সেসব পরিষ্কার করে আবার রোগী দেখা শুরু হলো। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ঢুকলেন। তিনি রংচটা ব্যাগ থেকে আমারই একটা পুরনো প্রেসক্রিপশন বের করলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে?’
মহিলা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, সুগারটা বেড়ে গেছে।’
প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে মাথা গরম হয়ে গেল। সেটা এক বছর আগেকার। বললাম, ‘এর পরে আর আসেন নি?’
‘না, এটাই শেষ দেখিয়েছি। তবে ওষুধ কিন্তু টানা খেয়ে গেছি।’
রেগে মেগে বললাম, ‘ওষুধ খেয়ে গেলেই হলো? এক বছরের মধ্যে একবারও আসবেন না? একবারও রক্ত পরীক্ষা করবেন না? আর এলেন তো এলেন একেবারে দশমীর দিন। সুগার তো বাড়বেই।’
মহিলা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, রাগ করবেন না। কিন্তু আমার উপায় ছিল না।’
মাথা গরমই ছিল। এবার গরমের বর্গ হয়ে গেল। শীতল স্বরে বললাম, ‘আমি রাগ করবো কেন? রাগ করার কী আছে? আপনার শরীর- আপনি কী ভাবে নষ্ট করবেন, কী ভাবে মারা যাবেন সেটা স্থির করার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে। শুধু তার মধ্যে আমাকে না জড়ালে খুশি হবো।’
মহিলা কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন, ‘আপনি খুব রেগে গেছেন। আগে আমার কথাটা শুনুন। আমি দিল্লীতে থাকি। বছরে এই একবার পুজোর সময় দিন দশেকের জন্য বাড়ি ফিরি। তখন আপনাকে দেখাতে আসি।’
‘পুরো বছরটা দিল্লীতে থাকেন যখন তখন ওখানেই ডাক্তার দেখান না কেন?’
মহিলা মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমি দিল্লীতে একটি বড়লোক পরিবারে বাচ্চাদের দেখাশুনোর কাজ করি। কিন্তু সেখানে আমার ফ্ল্যাটের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই।’
‘মানে? আপনি গোটা বছর একটা ফ্লাটের ভেতর কাটিয়ে দেন?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘হ্যাঁ, তাই কাটাই। ছোটোখাটো ফ্ল্যাট নয়। বিশাল ফ্ল্যাট। যে কমপ্লেক্সে থাকি সেখানে দোকান, ফাঁকা মাঠ, সুইমিং পুল সব আছে। কখনো সখনো বিকালের দিকে ম্যাডাম অনুমতি দিলে কমপ্লেক্সের মধ্যে ঘোরাঘুরি করি। তবে কমপ্লেক্সের বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি ওনারা বাইরে কোথাও গেলে আমাকে ফ্ল্যাটের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যান।’
‘সেকি? এরকম জেলখাটার চাকরি করছেন কেন?’
‘না করে উপায় নেই বলে। আমার দুই ছেলে মেয়ে। স্বামী ছেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা আমার বোনের কাছে থাকে। আমার পাঠানো টাকায় ওদের সংসার চলে। এখানে আয়ার কাজ করে যা মাইনে পেতাম তাতে এতো খরচ টানা সম্ভব হচ্ছিল না।’
‘কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন, একটা ফ্ল্যাটের মধ্যে থাকতে আপনার ভালো লাগে?’
মহিলা বিষণ্ণ ভাবে হাসলেন। বললেন, ‘আমাদের আর ভালো লাগা, খারাপ লাগা। শুধু পুজোর সময় দু সপ্তাহের ছুটি পাই। মহালয়া থেকে লক্ষ্মী পুজো অব্ধি। সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি কবে দুর্গাপুজো আসবে। কবে ছেলে মেয়ের মুখ দেখব। কবে স্বাধীন ভাবে রাস্তায় হেঁটে বেড়াবো। পুজোর একেকটা দিন কেটে যায়, আর বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। আবার একবছর বন্দী জীবন। ছেলেমেয়েরা ভালো করে সংকোচ কাটিয়ে ওঠার আগেই ছুটি শেষ হয়ে যায়।’
চুপ করে থেকে বললাম, ‘এভাবে আর কতদিন থাকবেন?’
মহিলা চোখের জল আড়াল করে হাসলেন, ‘সেটা মা দুর্গাই জানেন।’
পুজোর কদিন বিকালে আর চেম্বার নেই। পুজোর সময় ভিড় ভাট্টা এড়িয়ে চলতেই ভালো লাগে। আজ সন্ধ্যায় বেরলাম। দুর্গাপ্রতিমা ভাসানে যেতে শুরু করেছে। রাস্তায় কত মানুষ। ক্ষয়াটে চেহারার বাবা মায়ের হাত ধরে খোকাখুকুরা হাঁটছে। তাদের হাতে বেলুন, ঝুমঝুমি, হাওয়াই মিঠাই। মুখে স্বর্গের দীপ্তি। এদেরও অনেক গল্প আছে, যে সব গল্প এ জীবনে আমার জানা হবে না।