মাঝারি সাইজের হাসপাতাল বিল্ডিং। পনেরোটা বেড আছে এখানে। পাশেই অফিস, আলাদা বাড়িতে। সঙ্গে একটা গ্যারেজ। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স আর একটা জীপ গাড়ী থাকে সেখানে। একটু নীচে ঝোরার দিকে নেমে গেলে কয়েকটা ছোটো বড় বাড়ি। এগুলো কোয়ার্টার। ডাক্তার, নার্স, ষ্টাফদের। ডাক্তারদের কোয়ার্টার খালি নেই। একটা ষ্টাফ কোয়ার্টার খালি পড়ে আছে। ওটাই পাওয়া গেল। অফিসে সই সাবুদ করে, ব্যাগপত্তর রেখে আউটডোরে বসলাম। কয়েকটা মাত্র রুগী।দুপুর দুটো বাজতেই আউটডোর শেষ।
ক্যান্টিন থেকে চা-বিস্কুট এল। ক্যান্টিনটা উপরে। প্রবেশ পথের কাছে, ডানদিকে। সকলের সাথে আলাপ-পরিচয় হল। বিএমও এইচ আমারই সমবয়সী। তার পরিবার আছে এখানে। আরো দুজন এমবিবিএস ডাক্তার। তারা সেদিন ছুটিতে। বিশেষ কথা হল অবশ্য ডাঃ সুদীপ ঘোষের সাথে। সুদীপদা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল অফিসার। শিলিগুড়ি থেকে যাতায়াত করে। ওকে শুধু আউটডোর করতে হয়।
রাস্তা খুলে গেছে। সুদীপ-দার সঙ্গে দেবাশীষ-দা চলে গেল শিলিগুড়ি। আমি অরুণ প্রধান আর দীপক ভুজেল – হাসপাতালের দুই নেপালী ষ্টাফের সাথে চললাম কোয়ার্টার দেখতে।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পিছন দিকে একটা সমতল জমি পেরিয়ে গেলাম। আয়তাকার জমি। যেন, ব্যাডমিন্টন কোর্টের আভাস। ছেঁড়া একটা নেট লাগানো আছে।
‘এখানে খেলা হয়?’
‘হ্যাঁ স্যার, শীতকালে। বিএমওএইচ স্যার খুব খেলেন।’
পরে সারা শীতকাল ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সময় কেটে যেত।
কোয়ার্টারের নোনা ধরা দেওয়াল। অনেকদিনের অব্যবহৃত ঘর-দুয়ার। ভ্যাপসা গন্ধ। একটা শোবার ঘর,বারান্দা, রান্নাঘর। ঝোরার জল পাইপে করে আসে বাথরুমে। মন্দ না।
খাট আছে। এখানে কাঠ সস্তা। ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে খাটের নীচে থেকে বেরোলো লম্বা এক সাপের খোলস। আতঙ্কে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এখানে থাকতে হবে!
‘ও কিছু না। আসে মাঝেসাঝে। কিছু করে না।’ অরুণ এমন করে বলল যেন টিকটিকি দেখা গেছে। ঘর পরিষ্কার করে দিল দুজনে । কিন্তু অনেক জিনিসপত্র লাগবে। কিনতে শিলিগুড়ি যেতে হবে কাল বা পরশু। এখানে তো একটা পাইস হোটেল আর দুটো ছোটো মুদির দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই।
‘খাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে এখানে?’ রান্নার ব্যবস্থা করতে তো সময় লাগবে!’
‘উপরে একটা হোটেল আছে রাস্তার ধারে। আমার দাদার। বাঙালী খানা বানিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা হবে না স্যার।’ অরুণ বলল।
আমার অবশ্য খুব অসুবিধা হয় নি কখনো। খাওয়া নিয়ে আমার অত বাছ-বিচার নেই। আমি সব খাই।
বিকেলে আলাপ হল জয়ন্ত দাসের সঙ্গে। লম্বা দোহারা চেহারা। চোখে চশমা। মিশুকে লোক। প্রথম দর্শনে কলেজের প্রফেসর বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু আদতে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। হাসপাতালের গেটের পাশেই রিয়াং পুলিশ ফাঁড়ি। উনি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত।
‘কিছু অসুবিধা হলে বলবেন, ডাক্তারবাবু। অবশ্য এখানে পঞ্চাশ ঘর লোক বাস করে কিনা সন্দেহ। সময় কাটানোটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
‘হ্যাঁ, খুব ফাঁকা ফাঁকা।’
‘আর লোকজন খুব সহজ-সরল। অবশ্য আজকাল সমতলের লোকদের প্রতি পাহাড়ে একটা চাপা বিদ্বেষ তৈরী হয়েছে।’
‘চলুন, চা খাওয়া যাক।’
জয়ন্ত-বাবুর ঘরে গেলাম। রংলি-রংলিয়ট বাগানের প্রিমিয়াম কোয়ালিটি-র চায়ে চুমুক দিতে দিতে উনি বললেন, ‘এত নির্জনে কোনোদিন থাকিনি তো। খুব কষ্ট হত প্রথম প্রথম।’
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘মেটিয়াবুরুজ। বুঝতেই পারছেন! আপনার ?’
‘বারাসাত।’
‘অশোকনগরে আমার শ্বশুরবাড়ি। বারাসাতের উপর দিয়ে যেতে হয়।’
একটা ফর্সা, ছোটখাটো চেহারা উঁকি দিল পাশের দরজা থেকে।
‘কার সঙ্গে আলাপ করছেন দাসবাবু?’
‘হাসপাতালের নতুন ডাক্তারবাবু, ডাঃ নাথ। আর ইনি মুখার্জীবাবু,সেকেন্ড অফিসার।’
‘নমস্কার ডাক্তারবাবু। পান্ডব বর্জিত জঙ্গলে স্বাগত।’
মুখার্জীবাবু বাঙাল। এখন রায়গঞ্জে বাড়ি। খুব মজার লোক।
অন্ধকার হয়ে এল। শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক আর রাম্ভী ঝোরার জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। টিমটিম করে আলো জ্বলছে থানা, হাসপাতাল আর উপরে রাস্তার পাশের হোটেলে। এছাড়া সমস্ত চরাচর ঘুটঘুটে অন্ধকার।
‘একটা বড় টর্চ রাখবেন কাছে। রাতের দিকে তেনারা হিলহিল করে পায়ের উপর দিয়ে চলে যেতে পারে।’ মুখার্জীবাবু ভয় দেখায়।
‘শিলিগুড়ি থেকে কিনতে হবে। পরশুদিন যাব।’
‘রাতে খাবেন কোথায়?’ জয়ন্তবাবু বলে।
‘ওই উপরে, অরুণের দাদার হোটেলে।’
‘আমরাও ওখানেই খাই। এই পাহাড়-জঙ্গলে রোজ রোজ রান্না করতে ভাল্লাগে না।’
‘তাছাড়া কাজকর্মও তো আছে।’
‘খুব কম। শুধু জঙ্গলে পোচার আর কাঠকাটা-র দল। আর এই দিনকয়েক হল পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটি একটু-আধটু শুরু হয়েছে।’
‘হ্যাঁ। হাসপাতালেও তো রোগী বেশ কম দেখলাম।’
‘বর্ষা শেষ হোক। চলুন, একদিন আমাদের সাথে রাতের অভিযানে।’
অক্টোবরের এক রাতে সত্যিই গিয়েছিলাম ওদের সাথে জঙ্গলে। পুলিশের গাড়ীতে হেডলাইট নিভিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকা। অদ্ভুত সব জঙ্গুলে আওয়াজ। মুখার্জীবাবুর হঠাৎ জ্বালানো হেডলাইটের আলোয় হরিণ, ভাল্লুক দর্শন।
‘চলুন, খেতে যাওয়া যাক।’ জয়ন্তবাবু বলে।
‘এত তাড়াতাড়ি?’
‘এখানে রাত আটটা বাজলেই সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন হাজার মাথা খুঁড়লেও আর খাবার পাবেন না।’
‘চলুন তাহলে।’
রাস্তায় কোনো আলো নেই। হাইওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। তিনটে টেবিল। আমরা একটা দখল করে বসতেই পাশের টেবিলের লোকগুলো খাদ্য পানীয় নিয়ে উঠে বাইরে চলে গেল। পুলিশের বড়বাবু বলে কথা। তার সামনে কি করে আর মদ খায়!
পাশের ঘরে রান্না হচ্ছে। তদারক করছে জয়ন্তদা। ততক্ষণে দাদা পাতিয়ে ফেলেছি মানুষটার সাথে। গরম গরম তড়কা রুটি, পাহাড়ী ষ্টাইলে। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা।
‘আচ্ছা, সামতাহার কিভাবে যেতে হয়?’ ফেরার পথে জয়ন্তদা কে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘কালিম্পং, আলগড়া, কাফের হয়ে। কিন্তু কেন?’
‘আমার আসল পোষ্টিং তো ওখানেই। কোয়ার্টার নেই বলে এখানে অস্থায়ী ডিটেলমেন্ট পোষ্টিং দিয়েছে। কোয়ার্টার তৈরী হয়ে গেলেই যেতে হবে।’
‘কোয়ার্টার কেন, কিচ্ছু নেই ওখানে। বিশ্বাস না হলে একদিন দেখে আসুন গিয়ে হাসপাতালের গাড়ী নিয়ে। চাকরি ছেড়ে দেবেন, তবু ভুলেও ওখানে যাবেন না যেন।’
‘কেন?’
‘মুভমেন্ট-এর সময় জিএনএলএফ ওই হেল্থ সেন্টার দখল করে স্লটার হাউস বানিয়েছিল। রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিল তখন।’
‘অ্যাঁ’ ভয়ে, বিস্ময়ে আমার মুখ হাঁ হয়ে যায়।
‘কোয়ার্টার-টা তখনই পুড়িয়ে দেয়।’
মনে পড়ল থানা পুড়িয়ে প্রশ্নপত্র লুঠ করে আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করে দিয়েছিল এই জিএনএলএফ। এখন দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল এর নামে ওরাই ক্ষমতায়। আর স্বাস্থ্য হচ্ছে যৌথ, তবে মূলতঃ ডিজিএইচসি-র দায়িত্বে।
টর্চের আলোয় পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত এসে জোনাকির আলোয় অন্ধকার হাতড়ে ঘরে ফিরলাম। মাটি কেমন ভিজে ভিজে। সোঁদা গন্ধ ছাড়ছে। বারান্দায় উঠে গিয়ে আলো জ্বালালাম। মাত্র ন’টা বাজে!
রাতে একটুও ঘুম এল না। নতুন ঘর বাড়ি। তাছাড়া ঘরের পিছন দিয়ে প্রবল শব্দে বয়ে চলেছে রাম্ভী ঝোরা। ঘুমোয় কার সাধ্য! একটা পেঁচা ডেকে উঠল মাঝরাতে। চল্লিশ ওয়াটের একটা হলদে বাল্ব জ্বলে রইল সারা রাত।
( ক্রমশঃ)
খুব ভালো লাগল অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের জন্য…ভালো থাকবেন স্যার।