সিকিম ও পার্বত্য উত্তরবঙ্গের তিস্তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা ও ধ্বসের প্রায় দশ দিন অতিক্রান্ত। কিন্তু শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মেডিকেল টিম হিসেবে আমরা যখন পৌঁছলাম গ্রাউন্ড জিরোতে ধ্বংসলীলার ক্ষত তখনো রীতিমতো দগদগে। তিস্তার এ রূপ আগে কখনো দেখিনি। পুজোর এই সময়টায় আস্তে আস্তে নীলচে সবুজ হয়ে আসে তিস্তা, গতি হয়ে আসে শান্ত। কিন্তু এখন অন্য রূপ। ঘোলাটে জল, উদ্দাম গতি। মানুষের বেঁধে দেওয়া গতিপথ এই মুহূর্তে নেই, চুংথাং বাঁধ সম্পূর্ণ ধ্বংস, বাকি বাঁধগুলোও খোলা রয়েছে এখন বন্যা পরবর্তী সময়ে। ফলত সে বইছে নিজের ‘স্বাভাবিক’ গতিতে।
এই অঞ্চলে মেডিকেল ক্যাম্প বা রিলিফ ওয়ার্ক-এর মূল সমস্যা এখন হল যাতায়াতের সমস্যা। বহু জায়গা এখনো সড়কপথে বিচ্ছিন্ন।
প্রথম দিন গেইলখোলা আর ২৯মাইল-এ হল মেডিকেল ক্যাম্প। দুটি জায়গা মিলিয়ে প্রায় আশি জন রোগীকে দেখা হল। পুরোটা পথ গাড়ি চলে না। শেষ খানিকটা পথ ওষুধ, ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে পায়ে হেঁটেই যেতে হল মেডিকেল টিম ও সহযোগী ‘লালী গুরাস’ এর সাথীদের। ২৯ মাইলে নদীর গার্ড ওয়াল ভেঙ্গে বিপদের মুখে ফেলেছে অঞ্চলবাসীকে। গেইলখোলাতে নদীর ধারের দোতলা বাড়িরও একটা তলা বা তার বেশী বালির তলায় এখন। গোটা দশেক পরিবার আছে আশ্রয়শিবিরে। পরের দিন রংপো যাওয়ার থাকলেও গেইলখোলা থেকে স্বাস্থ্য শিবির শেষ করে সেদিন ফেরা হল আবার শিলিগুড়ি। কেননা গেইলখোলা আর তিস্তাবাজারের মাঝে লিখেভিরে রাস্তা পাহাড়ের গা ঘেঁষেই নদীতে পড়ে গেছে। পরদিন সকালে রওনা রংপোর উদ্দেশ্যে, ঘুরপথে। প্রায় ছয় ঘণ্টা গাড়ির রাস্তা পেরিয়ে যখন পৌঁছনো গেল, তখন ফ্লাড শেল্টার-এর কমিউনিটি কিচেন-এ রান্না শুরু হয়েছে। সাধারণ গাড়ির প্রবেশ নিষেধ সে এলাকায়। ত্রাণের জন্য / মেডিকেল ক্যাম্প-এর জন্য এসেছি শুনলে অবশ্য হাসিমুখে রাস্তা ছাড়ছে পুলিশ।
দুর্গতদের মধ্যে স্থানীয়রা যেমন আছেন, তেমনই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওখানে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরাও রয়েছেন। আমাদের পৌঁছতে দেরি হওয়ায় তড়িঘড়ি ক্যাম্প শুরু করা হল, এবং ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক বলে শুনলেও ক্যাম্প করতে রাত হয়ে যাওয়ায় এলাকার পরিস্থিতি দেখার তেমন সুযোগ হল না। ফ্লাড শেল্টার এর ভিতরেই চলল মেডিকেল ক্যাম্প। ডাক্তার হিসেবে রাহুল দেব বর্মন, দেবাশিস হালদার ও স্নিগ্ধা হাজরা, MCDSA এর সদস্য মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন অনিকেত কর ছাড়াও রোগীদের নাম নথিভুক্তকরণ, প্রাথমিক ভাবে ব্লাড প্রেসার মাপা ও ওষুধ বিতরণ-এর ক্ষেত্রে অলোকেশ মন্ডল এবং লালী গুরাস-এর সাথীরা ছিলেন। প্রায় একশোর কাছাকাছি রোগীকে দেখা হল রংপোর স্বাস্থ্য শিবিরে। বিভিন্ন ক্রনিক অসুখের রোগী যারা আগে থেকেই ওষুধ খান কিন্তু বন্যা/ ধ্বসের কারণে হাসপাতাল যেতে পারছেন না বা ঘর ভেসে যাওয়ার কারণে প্রেসক্রিশন/ ওষুধ হারিয়ে ফেলেছেন এইরকম রোগীর সংখ্যাই মূলত বেশি। বন্যায়/ ধ্বসে সরাসরি আঘাত পেয়েছেন এমন রোগীরাও ছিলেন। ত্রাণ শিবিরে থাকা বহু বাচ্চা যারা সর্দি কাশি জ্বরে ভুগছে তাদেরও মেডিকেল ক্যাম্পে দেখা হল। ক্যাম্প এর মাঝেই খবর এলো পরদিন পরিকল্পনামাফিক তিস্তাবাজারে (আরেকটি ভয়াবহ ভাবে বিধ্বস্ত অঞ্চল) ক্যাম্প বাদেও আরেকটি জায়গায় ক্যাম্প-এর খুব প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সেটা একদম অন্যদিকে। ডুয়ার্সের দিকে তিস্তাপাড়ের টোটগাঁও এলাকায়।
ফলত দুটো টিম আলাদা করে ফেলতে হল। এক টিমে ডাক্তার রাহুলদেব বর্মন ও স্নিগ্ধা হাজরা এবং লালী গুরাস-এর সাথী ছেওয়াং আর উজ্জ্বল পরদিন ভোরবেলা রওনা হল টোটগাঁও এর উদ্দেশ্যে। অন্য টিমটা গেল পূর্বনির্ধারিত তিস্তা বাজারের বিপর্যস্ত এলাকায়।
তিস্তাবাজারে পৌঁছে দেখলাম কিছুই চেনা যাচ্ছে না। একটা বসতির বিভিন্ন অংশ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। তিস্তার জল তল স্বাভাবিক-এর থেকে এখনো অনেক উপরে। একটা স্টেডিয়াম ছিল যেখানে এর আগে স্বাস্থ্য শিবিরও করেছিলাম আমরা, কয়েক বছর আগে, সেসব এখন নদীগর্ভে। রাস্তা এখনো সম্পূর্ণ সারানো যায়নি। কাজ চলছে পুরোদমে। সেসব পেরিয়ে ফ্লাড শেল্টার-এ পৌঁছনো হল। বড় সরকারি কমিউনিটি হল। সেখানে মেক শিফট ত্রাণ শিবির বানানো হয়েছে। মেডিকেল ক্যাম্পে প্রায় আশির কাছাকাছি রোগীকে দেখা হল। মেডিকেল ক্যাম্প শেষে যে বসতিটি ক্ষতিগ্রস্ত সেই অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখালেন স্থানীয় বাসিন্দা সাগর সহ লালী গুরাস-এর সাথীরা। নেপালি ভাষায় একটা চারপাতার ট্যাবলয়েড ‘তিস্তা টেনশন’ ছাপিয়েছেন তারা। মূলত এই যে পাহাড়ের ক্রমবর্ধমান ধ্বস, বন্যা তার সাথে তথাকথিত ‘ উন্নয়ন’ এর সম্পর্ক, বড় বড় নদীবাঁধ বানিয়ে প্রাকৃতিক গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা, পাহাড় কেটে, পাহাড়ের জঙ্গল কেটে, পাহাড়ের স্বাভাবিক ভূগোলকে পাল্টে দিয়ে চার লেন/ ছয় লেন-এর রাস্তা বানানো– এসব কীভাবে প্রভাবিত করছে হিমালয়কে, তিস্তাকে– সে নিয়েই লেখা। স্থানীয়রা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সেই নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। ভাষার দূরত্ব মেটানোর কাজ করছিলেন ভলান্টিয়াররা।
অন্যদিকে টোটগাঁও এর ক্যাম্প হল স্থানীয় একটি স্কুলের ভিতর। সেখানে প্রায় নব্বই জন রোগীকে দেখা হল।
অস্থায়ী ত্রাণ শিবির গুলোতে কিছু অসুস্থ বাচ্চা, গর্ভবতী মা, স্ট্রোকের রোগী রয়েছেন যাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মেডিকেল টিম প্রাথমিক ভাবে এই পাঁচটি জায়গায় স্বাস্থ্য শিবির করল। পরবর্তী দফায় আবার মেডিকেল টিম পাঠানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্য শিবির আরও প্রয়োজন। তার থেকেও বেশি প্রয়োজন যত দ্রুত সম্ভব যে মানুষেরা ঘর বাড়ি হারিয়েছেন তাদের যথাযথ রিহ্যাবিলটেশন-এর মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরানো।
আর সহ নাগরিকদের কাছে আবেদন রইল, যে পাহাড়ের কাছে ছুটে যান বারেবারে ভ্রমনের নেশায়, ‘ডিপ্রেশন’ কাটানোর ওষুধ হিসেবে বেছে নেন পাহাড় বেড়াতে আসাকে, সেই পাহাড়-এর মানুষদের আরও কাছ থেকে একটু জানুন। তিস্তাপাড়ের মানুষ দের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান এবং সরকারের কাছে দাবি জানান যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে যাতে কোনো ঢিলেমি না করা হয়।
Salute dada🫡