“…দেহি…দেহি…দেহি…দ্বিষো জহি…”
লোভী ইংরেজদের তখন বিশ্বজুড়ে একটাই বুলি, “দেহি, দেহি, দেহি!” অন্যদিকে চাইনিজরা শুধু বলে চলেছে “রূপোং দেহি, রূপোং দেহি।” কারণ, বাণিজ্য চুক্তি তো তাই ছিল। চিন দেবে Tea. বিনিময়ে ইংল্যান্ড দেবে Silver. কিন্তু চুক্তি ভাঙতে আর কতক্ষণ! সাহেবরা তখন চায়ের নেশায় মত্ত। নিজেদের দেশে চাহিদা তুঙ্গে। অথচ চা কিনতে কিনতে রাজকোষে রূপোর ভাঁড়ার তলানিতে। অতএব বিকল্প রাস্তা খুঁজতেই হবে। স্থল-গোলার্ধের এক চতুর্থাংশ তখন ব্রিটিশদের দখলে। রাজমুকুটে উজ্জ্বলতম পালক (দুধেলা গাইও বলা যেতে পারে) ইন্ডিয়া। সে আবার চিনেরই প্রতিবেশী। প্রাকৃতিক মিল তো কিছু থাকবেই। এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে।
স্কটল্যান্ডের রাজা (1306-29) তথা জাতীয় আইকন রবার্ট ব্রুসের গল্প কে না জানে! তবে আমার গল্পের রবার্ট ব্রুস সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। ইনিও ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। ভারতে এসেছিলেন 1832 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য রূপে। ঘটনাচক্রে পোস্টিং পেলেন উত্তর আসামে। পরিচয় হল এলাকার হোমড়াচোমড়া এবং ভালো মানুষ বলে পরিচিত মনিরাম দত্ত বড়ুয়া ওরফে মনিরাম দেওয়ানের সাথে। মনিরামের কাছে ব্রুস জানতে পারলেন স্থানীয় সিংফো আদিবাসীরা ফলপ বা খলপ নামের এক রকমের জংলী গাছের পাতা জলে ভিজিয়ে খায়। দেখে শুনে রবার্ট এবং তার ভাই চার্লস ব্রুসের মনে হল এই পাতা নিশ্চয় চা। তবে পাতাগুলো একটু বড় এবং গাছগুলোও বেশ লম্বা। যাইহোক তাঁরা সেই গাছের নমুনা পাঠালেন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনস সহ আরও বিভিন্ন জায়গায়। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রমাণিত হল সিংফো আদিবাসীদের ফলপ আসলে Camellia sinensis (Assamica variety) বা চা। প্রতিষ্ঠিত হল আসাম টী কোম্পানি। নিয়ে যাওয়া হল ইংল্যান্ডে। কিন্তু সে চা সাহেবদের মুখে রচলো না। অতএব চলতে লাগলো সেই বিশেষ চায়ের যা চিনদেশ থেকে আসে।
শুধু গাছ পেলেই তো হবে না। সবুজ সবুজ পাতাগুলো জলে ভিজিয়ে দিলেই তো আর চা তৈরি হয়ে যায় না। মাঝে থাকে অনেক জটিল প্রক্রিয়াকরণ। খোঁজ চলতে থাকল চিনের উন্নত সুস্বাদু চায়ের এবং তার প্রস্তুত প্রণালীর। কিন্তু চিনেরা তা দেবে কেন? কোকো কোলা কোম্পানি কি তার ফর্মুলা বলবে? RTI করলেও কি জানা যাবে? আর গোপনীয়তা রক্ষাই যে দেশের জাতীয় নীতি তাদের পেট থেকে কথা বের করা কি চাট্টিখানি কথা! কোভিড নিয়ে চিনের রাখঢাক না হয় আমাদের হাল আমলের স্মৃতি কিন্তু তাদের চায়ের গল্প চেপে রাখা যে কিংবদন্তি। চার হাজার বছর ধরে সযত্নে রক্ষিত চাইনিজ গোপনীয়তা ভঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে পড়লো ব্রিটিশরা।
এবার নজর সরাসরি চিনে। অস্ত্র হল গাছের বদলে গাছ। নেশার বদলে নেশা। চায়ের বদলে আফিম। তাও আবার সে আফিম ছিল “মেড ইন ইন্ডিয়া!” শুরু হল সরকারি মদতে আফিমের চোরা চালান। নেপথ্যে অবশ্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চিন ততদিনে আফিমের লেনদেন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ নাছোড়বান্দা ব্রিটিশরা ক্যানটন (Canton) বন্দর দিয়ে নেশাদ্রব্য চালান করেই যাচ্ছে। প্রতিবাদে একদিন চিনেরা বিশ হাজার বাক্স (1400 Tons) আফিম নষ্ট করে দিল। শুরু হয়ে গেল First Opium War! চলল তিন বছর (1839-42)। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরসম্ভারে চিনারা পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটলো। বাধ্য হল অত্যন্ত অপমানজনক সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করতে। চিন নিজেদের হাত থেকে হারালো হংকং, যা ফেরত পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হল 1997 অবধি। এই যুদ্ধকে কেন Opium War আখ্যা দেওয়া হল জানা নেই। একে তো Tea war ও বলা যেতে পারতো!
আবার চিনেরা যে ধোয়া তুলসীপাতা তা ভাবারও কোন কারণ নেই। ইংল্যান্ডে পাঠানো চা পাতায় ওরা ক্ষতিকারক রং ও ভেজাল মেশাচ্ছিল। সাহেবরা সে কু-কীর্তি সর্বসমক্ষে আনল। সবে মিলে পরিস্থিতি বেশ ঘোরাল হয়ে উঠল।
ঘটনাচক্রে বেপরোয়া ব্রিটিশরা তখন খোঁজ পেল আর এক স্কটসম্যানের। নাম রবার্ট ফরচুন। বয়স ত্রিশ অতিক্রান্ত। চাষির ছেলে। প্রথাগত ডিগ্রী না থাকলেও কাজেকর্মে তাঁকে উদ্ভিদবিদই (Botanist) বলা যায়। Royal Horticulture Society র মনোনয়নে ফরচুন ইতিমধ্যে বছর তিনেক চিন দেশে কাটিয়ে এসেছেন। মাসিক বেতন £500 এবং অন্যান্য ভাতার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে চর হিসাবে পাঠাল। সময়ের প্রেক্ষিতে বেশ মোটা টাকার পে প্যাকেজ! উদ্দেশ্য চা গাছ চুরি তো বটেই, সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য হাতানো। ফরচুনের ছদ্মবেশ হল প্রত্যন্ত চিনের একজন মানুষের মত। নাম নিলেন Sing Wa. কপাল থেকে মাথার সামনের দিকের বেশ খানিকটা চুল কামিয়ে দিলেন। নকল পনিটেল লাগালেন। ম্যান্ডারিনদের মত ভাষাও কিছুটা রপ্ত করলেন। সাথে রাখলেন এক স্থানীয় সহচর। এডমণ্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। ঝড়ঝঞ্ঝা, জলদস্যু, জনরোষ সব সামলে ফরচুন নিজের কাজ করতে থাকলেন। বছর খানেক পর হাজার দশেক চা গাছের চারা এবং অসংখ্য বীজ পাঠালেন ছোট ছোট এয়ারটাইট কলটেনারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে। পাঠানোর সময় কাজে লাগালেন নিজের বোটানি বিষয়ে জ্ঞান। দুঃখজনক ভাবে ভারতে পৌঁছনর পর আর সেগুলোকে কাজে লাগানো গেল না।
ফরচুন দমলেন না। নতুন উদ্যমে আবার নিজের কাজে নেমে পড়লেন। আরও বছর খানেক পরে তিনি আরও বেশি সংখ্যক চারা ও বীজ পাঠালেন। নিজে ফিরে এলেন বেশ কয়েকজন চিনে চা বিশেষজ্ঞকে (Tea masters) সাথে নিয়ে। তাদের সংখ্যা কেউ বলেন আট, কেউ বলেন আশি। মাষ্টারমশায়রা আমাদের শেখাতে থাকলেন চা চাষের কলাকৌশল এবং তার জটিল প্রক্রিয়াকরণ। এসে গেল ব্রিটিশদের ‘বল্লে বল্লে’ সময়! আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না। ঠিক এরকম সময়ে অস্ট্রিয়া থেকে হাতে এল গ্রেগর ইওহান মেনডেলের প্ল্যান্ট জেনেটিক্সের নানা তত্ত্ব। হাইব্রিড করে করে পাওয়া গেল অতি উন্নত মানের চা গাছ। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চিনকে টপকে ভারত হয়ে গেল বিশ্বে সর্বাধিক চা রপ্তানিকারক দেশ। শুধু পরিমাণে নয় গুনমানেও। দার্জিলিং হয়ে উঠল চায়ের ‘শ্যাম্পেন’ প্রভিন্স।
ফরচুনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুমতি দিল নিজের দিনলিপি লিখে ফেলার। উনি লিখলেনও খান তিনেক বই। তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প ইউ টিউবেও রয়েছে। তবে এরকম রোমহর্ষক প্লট নিয়ে কোন সিনেমা হয়েছে কিনা জানা নেই। আজ যে বিশ্বে প্রায় পঞ্চাশটি দেশে চায়ের চাষ হয় তার প্রভূত কৃতিত্ব রবার্ট ফরচুনের। চায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ব্লিডিং হার্ট, পিওনি ইত্যাদি নানা রকমের সুন্দর ফুলও তিনি উপহার দিলেন নিজের দেশকে। সমগ্র ইউরোপবাসীকে বোঝালেন গ্রীন টী আর ব্ল্যাক টী আদতে একই গাছের পাতা ভিন্ন ভাবে তৈরী। আজ যখন ভালো চায়ের কাপে আমরা চুমুকটা দি আমাদের মনে রাখতে হবে এর পিছনে ফরচুনের কতখানি কৃতিত্ব। এরকম বর্ণময় চরিত্রকে আপনি স্মাগলার বলবেন না মহাপুরুষ বলবেন সে বিচারের ভার আপনার হাতে। তবে ফরচুন যে ব্রিটিশদের ফরচুন ফিরিয়ে দিলেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। যদিও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাগ্য ফিরল এমনটা বলতে পারি না। কারণ 1857 সালের সিপাই বিদ্রোহে জেরবার ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার পরের বছর থেকে সরাসরি নিজেদের হাতে নিয়ে নিলেন। কোম্পানি রাজ থেকে ভারত পরিণত হল ব্রিটিশ রাজে।
ব্যস, ভারতে চা এসে গেল। আপনারাও এত দিনে আমার চা কাহিনী পড়তে পড়তে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পরের দিন শেষ করব শুধু Indian ‘Chai’ এর গল্প বলে।
চিত্র: রবার্ট ফরচুন (গুগল থেকে নেওয়া)
সূত্র:
1. For All the Tea in China: How England Stole the World’s Favorite Drink and Changed History – Sarah Rose
2. The Tea History Podcast: Laszlo Montgomery