“কি শুনলি” আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল বুড়ি।
আমি বুড়ির বুকের থেকে স্টেথো তুলে বললাম, “ঠিক আছে। খারাপ কিছু নেই।”
“কিচ্ছু খারাপ নাই? তুই তা’লে ভালো ডাক্তার নোস। আমার বুকির ভেতর তুই কিচ্ছু শুনতে পেলি নে। সোয়ামীই জোয়াব্যাটাকে হারানোর ব্যথা, তাও কিচ্ছু শুনতে পেলি নে?”
আমি বিরক্ত হলাম। আউটডোরে বিশাল লাইন। তার মধ্যে বুড়ির দার্শনিক কথাবার্তা। কিছুক্ষণ আগে ‘গোপাল, গোপাল’ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তারপর বলেছে, “তোকে দেখতে অবিকল আমার মরে যাওয়া বড় ছেলেটার মত।”
এই কথাটা আমি মাঝে মাঝেই শুনি। বিশেষ করে বুড়িদের অনেকেরই দাবী আমি তাদের ছেলে অথবা স্বামীর মত দেখতে। আমার দুর্ভাগ্য আজ পর্যন্ত কোনও কম বয়সী মেয়ে এই দাবী করেনি।
যাইহোক বুড়ির উপর আমার রাগ ক্রমেই বাড়ছে। কারণ স্পষ্ট দেখলুম যে হাত এতক্ষণ সে আমার মাথায় বুলাচ্ছিল, সেই হাতে বুড়ি নাক থেকে সিকনি বার করে কাপড়ে মুছল। আমি একটু সরে বসলাম। বলা যায় না, কখন আবার ঐ হাত আমার মাথায় বুলিয়ে দেয়।
তাকে কাটানোর জন্য বললাম, “ঠাকুমা, আমি তোমার বুকের ব্যথার কারণ বুঝতে পারছি না। যাও, নীচের থেকে ইসিজি আর এক্স রে করে আনো। পয়সা টয়সা কিছু লাগবে না। হাসপাতালে সব বিনা পয়সা।”
বুড়ির আরও কিছু মনে হয় বলার ইচ্ছে ছিল। সুযোগ দিলাম না। অত্যন্ত অভদ্র ভাবে তাকে বললাম, “আর বকিও না। আমার অনেক কাজ আছে। এবার কেটে পরো।” তারপর পরের জনের টিকিটটা টেনে নিলাম।
মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যাই। আমার একি পরিবর্তন। একজন থুত্থুড়ে সহায় সম্বলহীন ভিখারী বুড়ির সাথেও খারাপ ব্যবহার করছি!
আমার এই অহেতুক রাগ, এই অধৈর্য্য ভাব, এই অভদ্র ব্যবহার অনেকদিন ধরে অনেক ঘা খাওয়ার ফলাফল, যা আমার মনের নরম অনুভূতিগুলোকে প্রায় নষ্ট করে ফেলেছে। কি রকম সে আঘাত? তাহলে একটা গল্প শুনুন।
আমার তখন তেইশ চব্বিশ বছর বয়স। মেডিকেল কলেজে মেডিসিনের হাউস স্টাফ। নাইট ডিউটি চলছে। রাত তিনটের সময় অনকল রুমে সবে চোখটা একটু বুজেছি, এমন সময় অ্যাকিউট ফিমেল ওয়ার্ড থেকে কলবুক।
ফিমেল ওয়ার্ডে ঢুকে একটা বিরল দৃশ্য দেখলাম। সিস্টারদিদি হাঁটুমুড়ে বসে মেঝেতে ভর্তি একজন রোগিণীকে ‘সি পি আর’ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ওয়ার্ডে একজন বা দুজন সিস্টার। আর আশি থেকে একশ জন মরণাপন্ন রোগী। দিদিরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েই ডিউটি করেন। চেয়ার ছেড়ে তাঁদের উঠে দাঁড়াতে দেখা যায় খুবই কম। সেখানে একজন রোগীকে বাঁচানোর জন্য সিস্টার নিজেই সি পি আর শুরু করেছেন, এই দৃশ্য বিরল।
আমায় দেখে দিদি বললেন, “দেখুন স্যার, আর নেই মনে হচ্ছে।”
আমি বুকে স্টেথো বসালাম। চোখ টেনে টর্চের আলো ফেললাম। জীবনের কোনও লক্ষণ নেই। বললাম, “দিদি, আর চেষ্টা চালিয়ে লাভ নেই। পেশেন্ট অলরেডি এক্সপায়ার্ড।”
বেডটিকিটটা নিলাম। পালমোনারি টিউবারকুলোসিসের কেস। বুকের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। দুপাশের ফুসফুসই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
মৃত রোগীটির চেহারাও খুবই খারাপ। হাড়ের উপর শুধু চামড়া লাগানো। বেড টিকিটে বয়স দেখলাম। মাত্র ছাব্বিশ বছর।
সিস্টার দিদি ওদিকে বলছেন, “বড্ড ঝামেলা হয়ে গেল। বাড়ির লোককে মৃত্যুর খবর কি আপনিই বলবেন? নাকি সিনিয়ার কাউকে ডাকবেন?”
আমি বললাম, “কেন? গন্ডোগোলের পার্টি নাকি? পেশেন্টের চেহারা দেখেছেন। কে জানে বিনা চিকিৎসায় কতদিন ফেলে রেখেছিল? এই সব রোগীদের বাড়ির লোকই বেশী ঝামেলা করে। জীবিত অবস্থায় বিন্দুমাত্র সেবা যত্ন করে না। মৃত্যুর পর যত দরদ উথলে ওঠে। ডাক্তার পিটিয়ে সেই দরদের বহিঃপ্রকাশ হয়।”
সিস্টার দিদি বললেন, “আপনি যা ভাবছেন, ব্যাপারটা সে রকম নয়।”
আমি বললাম, “মার খাওয়ার ভয় না থাকলে বাড়ির লোককে মৃত্যুর খবর ঘোষণা করতে আপত্তি কোথায়। আপনি আয়া মাসিকে বলুন বাড়ির লোককে ডাকতে।”
সিস্টারদিদি বললেন, “ডেকে পাঠাতে হবে না। ওর বাড়ির লোক বারান্দাতেই আছে। আমার সাথে আসুন।”
আমি আরও একবার অবাক হলাম। সিস্টারের ব্যবহার পুরোটাই অচেনা লাগছে। ওনার পেছন পেছন বারান্দাতে এলাম। শীতের রাত। রোগীর বাড়ির লোকেরা ঠাণ্ডা মেঝের উপর পলিথিন পেতে ঘুমাচ্ছে। সিস্টার দিদি একদম কোনায় এসে থামলেন। তারপর একটা কুঁকড়ে শুয়ে থাকা সাত-আট বছরের শিশুকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে আপনার বাড়ির লোক।”
“মানে? বাড়ির অন্যরা কোথায়?”
“আরতো কেউ নেই। ছেলেটির কাছে শুনেছি ওরা বছর খানেক আগে বাংলাদেশ থেকে এপারে এসেছে। আসার পর থেকেই মেয়েটি শুধু ভুগছিল। মেয়েটির স্বামী অসুস্থ্য স্ত্রী আর ছেলের খরচ টানতে না পেরে পালিয়েছে। মা, আর ছেলে ভিক্ষা টিক্ষা করে কোনও রকমে টিকে ছিল। গতকাল রক্ত বমি করার পর কিছু লোকজনের সাহায্যে বাচ্চাটি ওর মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। কি, বাচ্চাটিকে ডাকব? বলতে পারবেন ওর মায়ের মৃত্যুর খবর? গ্যারান্টি দিচ্ছি, মার খাওয়ার কোনও ভয় নেই।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “দিদি, এখন কি হবে?”
উনি বললেন, “আমার মনে হয় বাচ্চাটিকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি একা ডিউটিতে। আপনি আমাদের টেবিলে গিয়ে একটু বসতে পারবেন? তাহলে আমি ছেলেটাকে শিশু বিভাগে ভর্তি করে আসি। আপাতত একটা সুরক্ষিত জায়গায় থাকুক। পরে ওরাই কোনও হোম-টোমে যোগাযোগ করে পাঠিয়ে দেবে। মৃতদেহটা আনক্লেমড বডি হিসাবে মর্গে পাঠিয়ে দেব।”
উনি আধা ঘুমন্ত শিশুটিকে নিয়ে এমারজেন্সির দিকে গেলেন।
এ ধরণের অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়, প্রত্যেক চিকিৎসকেরই আছে। বারবার ঘা খেতে খেতে আমাদের সুক্ষ অনুভূতি, মায়া মমতা, সংবেদনশীলতা এগুলি বর্মের আড়ালে চলে যায়। এরকম প্রচুর ঘটনা লিখতে বসে মনে পড়ছে। কিন্তু সে সব পরে শোনানো যাবে। আপাতত বুড়ির গল্পে ফেরত আসি।
ঘণ্টাখানেক বাদে বুড়ি আবার এসে উপস্থিত। হাতে এক্সরে প্লেট আর ইসিজি। এক্সরে থেকে তখনও টপ টপ করে জল পড়ছে। আমাদের আউট ডোর দোতলায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার জন্য বুড়ি হাঁপাচ্ছে। ভাল করে কথা বলতে পারছে না।
বুড়ি লোকজনকে ঠেলে আমার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। আমি আবার ধমক লাগালাম, “এই যে ঠাকুমা, ঠেলা ঠেলি না করে ঐ পাখার তলায় বস। এক্সরে প্লেটটা শুকিয়ে যাক। তারপর দেখছি। আমিই ডেকে নেব।”
বুড়ির কথা ভুলেই গেছিলাম। আড়াইটে নাগাদ রোগী ফাঁকা হতেই বুড়ি হাজির। বলল, “এইবার দেখবা গোপাল?”
আমি একটু লজ্জিত হলাম। বুড়িকে ডেকে নেব বলে ভুলেই গেছি। বেচারা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে এক্স রে নিলাম।
এক্স রে’র ছবিটা খুব চেনা। মারণ রোগ বুড়ির ডান দিকের ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে। টেনিস বলের মত একটা সাদা ছায়া। এখান থেকে আস্তে আস্তে বিষাক্ত অমর কোষগুলি ছড়িয়ে যাবে দেহের আনাচে কানাচে।
বললাম, “ঠাকুমা, এক্সরেতে একটু অসুবিধা আছে। আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। এই ছোটো হাসপাতালে হবে না। তুমি আর জি কর হাসপাতালের বক্ষ বিভাগে গিয়ে দেখাও।”
বুড়ি বলল, “কি করে যাব গোপাল। চোখে দেখিনে, হাঁটতে গেলে হাঁফ ধরে। সাত কুলে কেউ নাই। ভিক্ষা করে খাই। কারে নিয়ে যাব। তুই যা পারিস ওষুধ দে। আমার গোপালের ওষুধে সবার রোগ সারছে, আর আমার বুকে ব্যথা সারবে নে?”
বুঝলাম বুড়ির পক্ষে আর জি করে যাওয়া আর সেখানে বক্ষ বিভাগে দেখিয়ে সিটি স্ক্যান, এফএনএসি ইত্যাদি করা প্রায় এভারেস্টে ওঠার সমতুল্য। তাছাড়া করেও বিশেষ লাভ নেই। যদি সত্যি ক্যন্সার হয় (এবং সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী) তাহলে এই অবস্থায় চিকিৎসা করা আর না করা প্রায় সমান।
আমি বললাম, “হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাবে নাকি? হাঁটতে গেলেই তো হাঁপাচ্ছো। ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করবে কি করে?”
“যে কদিন পারি করব। পরের উপর বসে খেতে ভালো লাগেনে। একেবারে না পারলে আমার গোপালের কাছে চলে আসব।”
আমি ওষুধ লিখে দিলাম। বুড়ি বলল, “গোপাল, একটু কৃষ্ণ নাম শোন। শুধু শুধু ভিক্ষা নিতে খারাপ লাগে।”
“ভিক্ষা কোথায় দিলাম?”
“এই যে, এতগুলান ওষুধ দিলি।”
“ওতো সরকার দিচ্ছে। আমি কোথায় দিলাম।”
বুড়ি বলল, “সরকারকে আমি কনে পাব। আমার কাছে তুই হলি গে সরকার।”
আমি হাসলাম। বললাম, “ঠাকুমা, এখন সময় হবে নাগো। পরে একদিন…”
জানি সেই একদিন কখোনোই আসবে না। কেউ কথা রাখে না। সরকারতো নয়ই।
তবে আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটো ছোটো কথাগুলো রাখার চেষ্টা করলে কেমন হয়। কত অহেতুক আনন্দ, কত আযাচিত সম্পর্ক, কত বাড়িয়ে দেওয়া হাত আমি অগ্রাহ্য করে গেলাম সময় নেই বলে। সত্যি কি আমার সময় নেই, নাকি নিজেকে একটু ব্যস্ত করে দেখানোর মোহ আমাকেও পেয়ে বসেছে।