– কিন্তু খাওয়াতে না টা কেন? এত বড় বাচ্চাকে ডিম-মাছ না খাইয়ে রেখেছো কেন?
(চুপ)
– নিশ্চয়ই ওইসব প্যাকেটের আজেবাজে গুঁড়ো জলে গুলে ধরিয়ে দিতে…
– না ডাক্তারবাবু
– তাহলে? হাওয়া খেয়ে থাকতো নাকি?
– সত্যি কথা বলত্যা কিনার পয়সা নাই ডাক্তারবাবু। আপনার কাছে মিথ্যা বলব নি। কিনতে পারলে কি আর না খাবিয়ে রাখতি? অর বাবার ঝাঁটফাঁট দিবার খাটাখাটনির কাজ। চারখানা মানুষ ঘরে।
ডাক্তারের গলার স্বর আর আত্মবিশ্বাস দুটোই ঝুপ করে নিভে যায়…
– তাহলে সকাল থেকে কী কী খেতো?
– সকালে খেচড়ি ইস্কুল থেকে খেচড়ি দিত। সেউটা গরম কর্যা দু’বেলা। মাঝে মাঝে কুনো কুনোদিন ডিম হ’ত। আড়াআড়ি চির্যা আদখানা। মাছ দিতে পারিনি।
*****
সকালে আইসিইউতে ঢুকেই প্রথম নজরে এসেছিল বাচ্চাটা। নতুন এসেছে। কাল রাতে। ভেন্টিলেটরে আছে। হাত-পা ফোলা, ফ্যাকাশে, ঠান্ডা। হার্টের অবস্থা ভালো নয়। সাথে নিউমোনিয়া। মাথার চুলগুলো লাল, পাতলা। গায়ে ছাল উঠেছে, ঠোঁটের কোণে আর জিভে ঘা। সুস্পষ্টভাবে দীর্ঘদিনের অপুষ্টির ছাপ। রক্তের হিমোগ্লোবিন আর অণুচক্রিকা দুটোই খুব কম। হার্টের ওষুধ, রক্তচাপ বাড়ানোর ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন, পালস অক্সিমিটারের তার, গলার নল, ক্যাথেটার … সব মিলিয়ে গোটা বেডের এমাথা থেকে ওমাথা শুধু নানা ধরনের নলের হিজিবিজি।
রোগের ইতিহাস নেওয়ার একটা সুনির্দিষ্ট রাস্তা আছে। তাতে বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য সব এক জায়গায় এসে মেশে। রোগীর পরিচয়, বর্তমান রোগের বিবরণ, পূর্বতন রোগের ইতিহাস ইত্যাদি আরও কিছু বাঁক ঘুরে পুষ্টির ইতিহাস নিতে শুরু করি। অপুষ্টির ব্যাপারটা প্রথম দেখাতেই সন্দেহ হচ্ছিল। বিশেষ করে সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ শিশুদের পুষ্টির ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ।
– প্রথম ছ’মাস শুধু বুকের দুধ খেত?
– হ্যাঁ। তকন ত বেশ মটাসটা ছিল।
– তারপর? বাড়ির খাবার কবে শুরু হ’ল?
– ওউ ন-দশ মাসের পর থ্যিকানু।
– কী কী খাওয়াতে?
– ডিম-মাছ সেরকম খাবাইতিনি। ওউ যেমন হয়… একটু কর্যা খেচড়ি, বিস্কুট…
– কিন্তু খাওয়াতে না টা কেন? এত বড় বাচ্চাকে ডিম-মাছ না খাইয়ে রেখেছো কেন?
*****
দুধরাজ নস্কর মারা গেছে। ধুঁকতে ধুঁকতে আরও চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচেছিল। বেড খালি হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আবার নতুন বাচ্চা এসে গেছে। জানলার বাইরে চোখ রেখেছি। আউটডোরের সামনে সেই পরিচিত ভিড়। সেই ব্যস্ত কোলাহল। বড় গাছটার তলার হোটেলে সেই একই ওমলেট, মাছ-ভাতের অর্ডার। মোবাইল খুললেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের খবর। পক্ষে-বিপক্ষে-নিরপেক্ষে-খিল্লিতে কত হাজার হাজার মতামত! ভোটবাজারের হাঁকডাকও বেশ জমেছে। রোজ যেমন যা হয়…
“বাচ্চাটাকে একটু দ্যাকবেন ডাক্তারবাবু”
প্রথমবার কথা বলার পর এইটুকু বলে কাঁদতে কাঁদতে দুধরাজের মা বেরিয়ে গেছিল। এসব অনুরোধ আপাতভাবে নিষ্প্রয়োজন। এরকম অনুরোধের ভিত্তিতে চিকিৎসা হয় না। রোগীর বাঁচা-মরার সাথে এর কোনও সম্পর্ক থাকে না।
দুধরাজের বাঁচা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাঁচেওনি। আধুনিক চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যবীমার হাজারো ঢক্কানিনাদের সামনে বেখাপ্পাভাবে ঝুলে থাকে অপুষ্টির উলঙ্গ চেহারা! ঘরে পয়সা নেই বলে একটা বাচ্চা ঠিকমতো ডিম-মাছ খেতে পায় না! অত্যাধুনিক চিকিৎসা লাগে এমন রোগের চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারা যায় সাধারণ নিউমোনিয়া, পাতলা পায়খানা, সাপের কামড়, টিবি, দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টিতে।
মাথার ওপরে ছাদ আর রাতের খাবারের নিরাপত্তা থাকলে যুদ্ধগুলোকে ভিডিও গেম মনে হয়। কার হাতে কত অস্ত্র, কে কাকে কোন অস্ত্র সরবরাহ করলো; এসব নিয়ে আড্ডা গরম করা যায়। দুধরাজদের অকিঞ্চিৎকর মৃত্যু বারবার শিখিয়ে যায়- যুদ্ধে কার দোষ বেশি, কার কম; সেসব পরের কথা। আসলে যুদ্ধ ব্যাপারটাই অশ্লীল। যুদ্ধ বাধলে দু’দেশ এবং তার সূত্র ধরে সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ভালো থাকে না।
পরের বাচ্চাটা হাঁপানির রোগী। রোবটের মতো ধুলো-ধোঁওয়া থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিচ্ছি। বাচ্চার মা জানাচ্ছে, বাড়িতে একটাই ঘর। চারজন গাদাগাদি করে থাকে। সামনে এক চিলতে জায়গা। সেখানেই রান্নাবান্না। ধুলো-ধোঁওয়া কী করে এড়াবে?
*****
শিমুল-পলাশে আগুন লেগেছে। কিছু বিক্ষিপ্ত ছোবল বাদে কোভিড আপাতত নির্বিষ। হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড বেশ ক’দিন হ’ল বন্ধ। জীবনের ফিকে রঙগুলো আবার ফিরে আসছে। আশা রাখতে ভালো লাগে, আর সেই পিপিই-র অসহ্য কষ্টের দিনগুলো ফিরবে না। সেদিন পৃথিবীর নিরাপত্তার দায়িত্ব কিছু মানুষের হাতেই ছিল। বিজ্ঞানের হাতে ছিল। কোনও মন্দির-মসজিদ-গীর্জা কাজে আসে নি। নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল তারা তিলেতিলে গড়তে জানে। কে বলে নিরাপত্তা শুধু গুলি-বোমায় হয়?
কোভিড কত মানুষের জীবন নিয়েছে তার সঠিক হিসেব কেউ জানে না। বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আবার ধ্বংসের খেলা। আকাশ ঢাকছে বারুদের ধোঁওয়ায়। খবরের বাকি খুঁটিনাটি জানিনা। জানতে ইচ্ছে হয়নি।
আরও অনেক দুধরাজ সঠিক পুষ্টির অভাবে ধুঁকছে। কতশত বাচ্চা ধোঁওয়া-ধুলোর মধ্যে থাকতে থাকতে শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ইনহেলার সরকারি হাসপাতালে বিনে পয়সায় পাওয়া যায় না। কিনতে হয়। সেই টাকাটা তাদের কাছে অনেকটাই। তারপর ইনহেলার নিয়ে অকারণ ভীতি, অপবিজ্ঞান-অপপ্রচারের ছড়াছড়ি; সেসব তো আছেই।
দুধরাজদের পৃথিবীতে বসন্ত আসে না। কিংবা হয়তো আসে, চোখে পড়ে না।
ছবিঃ গুগল