আমরা দেখছি আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা অন্তর্বর্তী এবং পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে দারিদ্র্য পীড়িত একাধিক দেশে ধারাবাহিক খ্রিষ্টান – মুসলমান ও জাতি দ্বন্দ্ব লাগিয়ে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছে। দেখছি একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরোপস্থিত উষ্ণসমুদ্র সমীপে অন্যতম অঙ্গরাজ্য এবং শিল্প, কৃষি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, ক্রীড়া, সাহিত্য, মানব সম্পদ – সবকিছুতে এগিয়ে ইউক্রেন এখন যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ছারখার। ছারখার অন্তহীন যুদ্ধ চলা পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন। এর পরের নতুন যুদ্ধ ক্ষেত্র কি বাংলাদেশ এবং তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ?
নতুন করে অস্থিরতা:
ভারতীয় সেনার সহযোগিতায় মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে এবং পাক সেনা – রাজাকার – জামাত – আল বদর দের পৈশাচিক অত্যাচার এবং ৩০ লক্ষ মূলতঃ সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকের গণহত্যা ও চার লক্ষ মূলতঃ সংখ্যালঘু হিন্দু নারীর গণধর্ষণের দুঃখ বুকে বয়ে নিয়ে উর্দু জাত্যাভিমানী সাম্প্রদায়িক সামরিক – স্বৈরাচারী পাকিস্তানের থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭২ এ। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, সাইক্লোন, কলেরার মহামারী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাকশাল ইত্যাদি স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে খুঁড়িয়ে চলা সরকার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ১৯৭৫ এ মুখ থুবড়ে পড়ে পাক ও ইসলামপন্থী সামরিক অভ্যু্থানের মাধ্যমে যেখানে জাতির পিতা মুজিবর রহমান সহ দেশের প্রধান নেতাদের হত্যা করা হয়। তার পর থেকে ইকবাল নির্দেশিত, মওদুদি প্রবর্তিত এবং পাক ও সৌদি মদতপুষ্ট ‘ পাক সার জমিন সাদ বাদ ‘ অর্থাৎ মৌলবাদী ইসলামি রাষ্ট্র গঠন, হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের নিধন ধর্ষণ সম্পত্তি দখল ও বিতাড়ন এবং ভারত বিরোধিতা ও পাকিস্তানের পুরোনো অবস্থা ফিরিয়ে আনা। জিয়া, এরশাদ, খালেদা প্রমুখের জমানায় এরকম চলতে চলতে প্রায় আড়াই দশক পর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রমুখের নেতৃত্বে গণ আন্দোলন পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন আনে। পরবর্তী এক দশকে অস্থিরতা ও টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবাদীরা আবার ক্ষমতায় আসে। অবশ্য মৌলবাদীদের একাংশের সঙ্গে আপোষ করে। এই পর্বে তসলিমা নাসরিন কে বহিষ্কার, হুমায়ন আজাদ অভিজিৎ রায় প্রমুখ প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বদের হত্যা, সনজীদা খাতুনের ছায়ানট এর অনুষ্ঠানে বিস্ফোরণ, বিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হানা, বিদেশিদের হত্যা, হোলি আর্টিজান বেকারি ইত্যাদি ঘটনার পর ঘটনা। পরবর্তী দেড় দশকের বেশি বেগম হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। মৌলবাদী ইসলামীকরণ অব্যহত থাকলেও এবং এক দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও অর্থনীতি ও উন্নয়নের বিবিধ মাপকাঠিতে বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতি করে। গার্মেন্টস শিল্প ফুলে ফেঁপে ওঠে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কিছুটা বাড়ে। আর্থিক স্বয়ম্ভরতা ও কর্ম নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মার্কিন ও চীন নির্ভর বলয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে।
তারপর আমরা দেখলাম সংরক্ষণ বাতিলের দাবিতে এক জঙ্গী ছাত্র আন্দোলন এর সৃষ্টি। সরকার সেই সংরক্ষণ বাতিল করলেও ছাত্রদের আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। সরকার দমন পীড়ন চালিয়েও থামাতে পারেনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিকল্পিত ও সংগঠিত বৃহত্তর গণ আন্দোলন। তাতে সমস্ত বিরোধী দল, নিষিদ্ধ দল, মৌলবাদী দল ও সন্ত্রাসবাদী দল অংশ নেয়। আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয়, বাংলাদেশ সেনা তাকে সমর্থন করে এবং শেষে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা কোনরকমে প্রাণ নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এই চার রকম বিরোধী শক্তি বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে।
এরপর বিগত চার – পাঁচ মাস ধরে জুলাই বিপ্লবের নামে বাংলাদেশ জুড়ে বীভৎস সন্ত্রাস, হিংসা, অরাজকতা আর জাতীয়তাবাদী শক্তি, আওয়ামী লীগ, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিশ্চিয়ান, জন জাতি, বাউল – ফকির, আহমদিয়া, সুফিদের উপর ইসলামি জিহাদিদের তাণ্ডব এবং উগ্র ভারত বিরোধিতা চলতে থাকে। হিন্দুরা প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করলে চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল সর্বত্র মৌলবাদী, পুলিশ ও সেনা তাদের উপর ভয়ঙ্কর দমন পীড়ন চালায়। দমন পীড়ন চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ চাকমাদের উপর।
এক সূত্রে বাঁধা, একই মালার ফুল:
এই তথাকথিত ইসলামি বিপ্লবের প্রধান শক্তি জামাত, হেফাজতে, বিএনপি প্রভৃতিরা পাক, সৌদি ও তুর্কি অর্থ, আদর্শ (ওয়াহাবী – সালাফী ইসলামের ইসলামি বিশ্ব গঠন ও বিধর্মী কাফির নিধন), অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও মদত পুষ্ট। আর এর কুশীলবদের সকলের সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংযোগ রয়েছে। ইসলামি বিপ্লব নিয়োজিত অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস ১৯৬৫ – ‘৭১ এবং ২০১৭ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ছিলেন। এই ইসলামি রাষ্ট্র ও জেহাদের উদ্গাতা মওদুদি শেষ জীবন কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই ইসলামি বিপ্লবের প্রধান পরিকল্পনাকারী মাফুজ আলম বিপ্লব পরবর্তী অভিনন্দন গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই বিপ্লবের সহযোগী সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান বিপ্লবের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। এই সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রী ও উপদেষ্টার এনজিও গুলিতে আসে মার্কিন, সৌদি, কাতারি অর্থ সাহায্য। এমনকি এদের মধ্যেও প্রতিবাদী কন্ঠস্বর কবি ফরহাদ মজহারের জীবনের অনেকটা সময় কাটে মার্কিন মুলুকে। এমনকি যে ইস্কন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু তারও জন্ম মার্কিন দেশে।
সবই তার স্বার্থে, তার অঙ্গুলি হেলনে:
শত শত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। সংক্ষেপ এর কারণে কয়েকটি দিচ্ছি মাত্র। (১) ১৯৬৫ তে ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শে সুকর্ণ সরকার জনমুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় মার্কিন সিআইএ সুহারতোকে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ১০ লক্ষ কমিউনিস্টকে হত্যা করে। (২) ১৯৭৩ এ চিলিতে ক্ষমতাচ্যূত করে জনমুখী আলেন্দে সরকারকে। (৩) মধ্যপ্রাচ্যে সবচাইতে প্রগতিশীল দেশ ছিল মার্কিন অনুগামী ইরাক। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেন শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠায় ইরাককে ধ্বংস করে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এরপর রুশ সাহায্যে এগিয়ে চলা আফগানিস্তান ও সিরিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে নিয়ে যায় মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুর বর্বর ঘাতকদের অধীনে। ইসলামি স্টেট সন্ত্রাসী সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে কুর্দ, ইয়েজিদি, ইরাকি, সিরিয়ান দের জীবন দুর্বিষহ করে দেয় যারা পাশবিক গণধর্ষণ, অত্যাচার এবং গণকোতলের এক হাড় হিম করা রাজত্ব কায়েম করে। এরপর একে একে ইয়েমেন, প্যালেস্টাইন, লেবানন … ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, নাইজিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, হাইতি, গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, বলিভিয়া, পেরু … বিরামহীন আগ্রাসন ও অশান্তি চলতে থাকে। আর অনেকক্ষেত্রেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান হাতিয়ার থাকে উগ্র ইসলামি মৌলবাদ নির্দিষ্টভাবে আগ্রাসী ওয়াহাবী – সালাফী মতবাদ এবং জিহাদ।
সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয় রাশিয়া একটি শর্তে যে ইউক্রেন ন্যাটোতে নাম লেখাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন জেলেনেস্কি ও ন্যাটো রাষ্ট্র প্রধানদের হোয়াইট হাউসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, রুশ বিরোধী যুদ্ধ জিগির বাড়িয়ে তোলে এবং ইউক্রেনকে আর্থিক ও সমরাস্ত্র বরাদ্দ বৃদ্ধি করে। এরপর ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইউক্রেনে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে রাশিয়ার স্থলভূমিতে আক্রমণে প্ররোচিত করেন এবং ইউরোপ ভূখণ্ডে ঘটমান ভয়াল যুদ্ধ থামার পরিবর্তে পারমাণবিক যুদ্ধের ভ্রুকুটি বাড়িয়ে তোলেন। একইভাবে এশিয়ার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা ও অগ্রগতি ভেস্তে দিয়ে তারা চূড়ান্ত অস্থিরতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এক্ষেত্রে আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার মত মার্কিন পরিকল্পনা সহায়ক হিসাবে কাজ করে উগ্র মৌলবাদী ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দলগুলি।
ইন্দিরা মোদি প্রতিতুলনা:
বাংলাদেশে গত পাঁচ মাস ধরে যে নৈরাজ্য চলছে, হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার হামলা চলছে, হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ও পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, উগ্র ভারত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, ভারতের জাতীয় পতাকা পদদলিত করা হচ্ছে, ভারতের থেকে চারটি রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, নানা রকম যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা চলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভর্তি বিদেশি অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে সেগুলি প্রশমন করতে সম্পূর্ণ অক্ষম নরেন্দ্র মোদির বিজেপির কেন্দ্র সরকার। শুধু তাই নয় তারা এই বিষয়ে মনিপুর ও তিলোত্তমা কান্ডের মত একেবারেই নিঃশ্চুপ। একটিই কঠোরতা দেখিয়েছেন – নিরন্তর অত্যাচারিত হিন্দু শরণার্থীদের সীমান্তে আটকে দিতে ও গুলি করে হত্যা করতে। ভোগ – সুখ, স্টাইল, বক্তৃতা, বিদেশ ভ্রমণ এবং স্বজাতির অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দেশের সম্পদ লুঠ ও বিদেশে পাচার ঢাকা দিতে ব্যস্ত মোদি সরকারের চূড়ান্ত কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা প্রতিবেশী বলয়ে একমাত্র সহযোগী বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে পৌঁছে যেতে দেওয়া। তাঁর আমলে প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, মাল দ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার সমগ্র প্রতিবেশী বলয়ে ভারত ঘৃণিত। চীন অনেকটা সীমান্ত এলাকা দখল করে নিয়েছে। ভারত বন্ধু কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে থেকেছে। দেশের মনিপুর রাজ্যে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ থামছেই না। মোদির সেদিকে কোন নজরই নেই। দ্রব্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিক। …
অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বে ১৯৬৭ তে সিকিমের চো লা ও নাথু লায় সীমান্ত যুদ্ধে ভারত মহাশক্তিধর চীনকে পরাজিত করে এবং ১৯৭৫ এ সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭১ এ পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ও হিন্দুদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করলে এবং পশ্চিম সীমান্ত স্বাধীনতার পর তৃতীয়বার আক্রমণ করলে মার্কিন ও চীনকে প্রতিহত করে বিশ্ব জনমত গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সমর্থন নিয়ে পাকিস্তানকে শুধু শোচনীয়ভাবে পরাস্তই নয় দু টুকরো করে দিয়েছিলেন তিনি। আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রায় দেড় থেকে দু কোটি বাঙালি শরণার্থীকে। একদিকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লব, ব্যাংক ও বৃহৎ সংস্থা গুলির জাতীয়করণ, গরিবী হটাও অন্যদিকে জরুরি অবস্থার প্রবক্তা ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তীতে পাঞ্জাবের খালিস্তানি জঙ্গী আন্দোলনকে দমন করে ভারতকে বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
পশ্চিমবঙ্গের কি ভবিষ্যত?
যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তুর ঢেউ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হাজারো সমস্যার মধ্যে দিয়ে চললেও পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীনতার পর ৭৭ বছরে কিছুটা স্থিতিশীলতা পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক বিষয়ে বামপন্থীদের নেতৃত্বে প্রবল গণ আন্দোলন, চূড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, দু দুটি স্বল্পকালীন যুক্ত ফ্রন্ট সরকার গঠন ও পতন, শিল্প ও অর্থনীতির অবনমন, সশস্ত্র নকশাল আন্দোলন ও তাকে সামরিকভাবে দমন এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ অবধি ছিল তিন দশকের কংগ্রেসী শাসন। তারপর ৩৪ বছরের দীর্ঘ বামফ্রন্ট শাসন এবং ২০১১ থেকে টানা ১৩ বছর ধরে চলমান তৃণমুল শাসন।
এই পর্বে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব অনেক বেড়েছে বিহার, নেপাল সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য ও রাষ্ট্র গুলি থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমনে। তার চাইতেও বেশি পূর্ব পাকিস্থান ও বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের ফলে। হিন্দুরা তো প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হয়ে এসে চলেছেন যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৬৪ তে কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদের চুল খোয়া যাওয়া, ১৯৭১ – ৭২ বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধ, ১৯৯২ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিএনপি জামাত বাংলাভাই জেএমবি ছাত্র লীগ প্রভৃতির বাড়বাড়ন্তর সময়। বর্তমান ইসলামি বিপ্লবের পর এগুলি আরও বেড়ে গেছে। আর মুসলমান রাও সেখান থেকে এসে চলেছেন উন্নত অর্থনীতি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ, চিকিৎসা ও অন্যান্য সংস্থানের কারণে। এছাড়াও বাম ও তৃণমূল আমলে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বর কারণে বিস্তীর্ণ সীমান্ত ধরে বিভিন্ন সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতাদের মাসোহারা দিয়ে রাষ্ট্র ও শাসক দল পরিচালিত সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, গরু, সোনা, চিনা সিল্ক, ড্রাগস, অস্ত্র, যুবতী ও কিশোরী নারী পাচার নিয়ে তৈরি হয়েছে সমান্তরাল কালো অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান অপরাধ ও কলুষিত পরিবেশ।
২০১১ এর শেষ জনশুনানিতে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭% এর বেশি ছিল মুসলমান সম্প্রদায়। এখন যা প্রায় ৩৫ %। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের তিনজন অধিবাসীর মধ্যে একজন মুসলমান। কংগ্রেস শাসকরা মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসাবেই দেখে এসেছেন। বাম ও তৃণমূল শাসকরাও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। ইসলামি মৌলবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম থেকে সক্রিয় ছিলই যা বৃদ্ধি পায় বাম আমলে মূলতঃ আফগানিস্তান এর জিহাদি লড়াই ও বাবরি ধ্বংসের পর। সিপিআইএম পার্টি ও তাদের রাজ্য প্রশাসন এগুলি প্রশ্রয় দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছেন ভোটের কারণে। আর বর্তমান তৃণমুল দল ও তাদের রাজ্য প্রশাসন সরাসরি এগুলিকে মদত দিচ্ছেন ৩৫ % ছাকা ভোট পেয়ে একের পর এক নির্বাচনী বৈতরণী নির্বিঘ্নে পাড় হওয়ার কারণে। ফলে এদের অত্যাচার মুসলিম সমাজজীবনে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে (মহিলাদের পর্দার অন্তরীণ করা বা বোরখা হিজাব বাধ্যতামূলক করা, পুরুষদের আরবি পোশাক, রোজা নামাজ সহ ধর্মীয় আচার বাধ্যতামূলক করা, মহল্লায় মহল্লায় মসজিদ কমিটি ও পীর মাওলানা মোল্লা দরবেশ এবং মৌলবীদের মাতব্বরি বৃদ্ধি ইত্যাদি), তেমনি সামগ্রিক সমাজ জীবনে এদের আগ্রাসনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বসিরহাট সহ বিভিন্ন মুসলিম প্রধান এবং সীমান্ত অঞ্চলগুলিতে ইসলামি মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী জিহাদিদের দাপাদাপি ক্রমে বেড়েই চলেছে। এবছর বেলডাঙ্গায় কয়েকবার দাঙ্গা হয়েছে। এইগুলি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নিজ স্বার্থে এতদিন দেখেও দেখেননি। ফলে বিষ বৃক্ষ ক্রমশ মহীরূহ হয়ে উঠেছে।
বিপরীতে তুলনামূলক প্রগতিশীল, ধর্ম নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজে এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুত্ববাদী প্রচার বাড়ছে। তার হাত ধরেই জাতীয় কংগ্রেস বা বামরা নন পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেছে বিজেপি। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি ইসলামি পীর দের তৈরি একটি দল। জাতীয় কংগ্রেস এবং বামেরা হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক।
সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত ও বৃহৎ পরিবার শেয়ার করা বাংলাদেশে যদি ইসলামি মৌলবাদী জিহাদিদের তাণ্ডব চলতে থাকে, তালিবানি শাসন বজায় থাকে, হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার হামলা চলতে থাকে, মার্কিন চীন পাক সৌদি তুর্কী প্ররোচনায় উগ্র ভারত বিরোধিতা চলতে থাকে, যুদ্ধ প্রস্তুতি চলতে থাকে তাহলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য। ফলে বাড়বে আরও অর্থনৈতিক বোঝা ও অনিশ্চয়তা। ভেঙ্গে পড়তে পারে বর্তমান হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক যেখানে ঐক্য একেবারেই না থাকলেও মিলেমিশে কাজ চালিয়ে থাকার আবহটুকু অন্তত বজায় ছিল।
মোদি ও মমতা সরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে এটি প্রশমিত ও সামাল দিতে না পারলে ঘটে যেতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মার্কিন চীন পাক সৌদি তুরস্কের আরেকটি রপ্তানি যুদ্ধ এবং দুই বাংলা আবার হয়ে উঠতে পারে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মত ভয়ঙ্কর রকম অস্থির, ভঙ্গুর এবং হিংসাদীর্ন।
৭.১২.২০২৪