এরিখ হেলিকপ্টারের আওয়াজে মাইকেলের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। এরা এয়ারলিফট করতে এসেছে একটা বাচ্চাকে।
বাচ্চাটা বরফের নীচে চাপা পড়েছিল। বাবা আর ছেলে, নিজেদের বানানো একটা ইগলুতে থাকতে গিয়ে বরফ চাপা পড়েছে। বাবাটা নিজে বরফ ঠেলে বেরিয়ে অনেক পরে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করেছে। জায়গাটা হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব সুইজারল্যান্ডের টারাসপ্ বলে একটা শহর। গ্রাউনবেন্দেন ক্যান্টনে।
বাচ্চাটার বাবা, জোয়েল থেকে থেকে ডুকরে উঠছে। ক’দিন ধরে খুব বরফ পড়ছে। তাইই তো সে সখ করে…
প্যারামেডিক গম্ভীরমুখো গোঁফওয়ালা জোহান, বাচ্চাটার পালস ধরে বসে রয়েছে আর ক্রমশই গম্ভীরতর হয়ে উঠছে।
এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটা চুর-এ নামতেই, একটা চাকা লাগানো স্ট্রেচারে বাচ্চাটাকে তুলে এমারজেন্সির দিকে দৌড়ুলো জোহান। তার পেছনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়োলো বাবা জোয়েল।
হেলিকপ্টার পাইলট এরিখ মাইকেলকে শুধোল, – কী অত বকবক করছিলে হে?
মাইকেল বুড়ো হেলিকপ্টারের হেল্পার। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, – আজ্ঞে, ও কিছু না।
এরিখ চোখ পাকিয়ে হাসল।
মাইকেল বলল, – বলছিলাম, এই সমস্তই আখলুট-এর কাজ।
– সে আবার কে?
– শোনো বাছা, আমার ছেলেবেলার নাম নুনাইটক। তোমরা এস্কিমো বললেও আসলে আমরা ইনুইট। আখলুট হল ইনুইটদের ধ্বংসের দেবতা।
ছোটো বেলায় আলাস্কায় থাকতাম। শিকার করতাম সিল আর মেরুভালুক। আমাদের ধর্ম ছিল শামানিজম।
এক জায়গায় শিকার ফুরোলে পাট গুটিয়ে অন্য খানে গিয়ে ফের নতুন ইগলু বানাতাম। আমাদের লিডার ছিল কুপুন আর পুরোহিত ছিল কাল্লুক। কাল্লুক ইগলু বানানোর জায়গাটা বেছে দিত।
একবার নতুন এক জায়গায় গিয়ে দেখি আধভাঙা একটা ইগলু গ্রাম। লোকজন কেউ নেই।
সে যেন এক হানাবাড়ি। অবশ্য তোমাদের ইউরোপের পড়ে থাকা দুর্গ-প্রাসাদের যে হানাবাড়ি তোমরা দেখ, ভাঙা ইটপাথর, মাকড়সার ঝুল, বাদুর, তার মত নয়।
জায়গাটা গ্লোবের ঠিক উত্তর মাথায়। সেখান থেকে যে দিকেই যাও সে’টা হবে দক্ষিণ দিক। হা হা শিসে ছুটে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ তরোয়ালের চেয়েও ধারালো উত্তর সাগরের মেরু বাতাস। সাদা রঙের অপার শূন্যতা দিগবিদিকে। এ’রকম ব্যাকগ্রাউন্ডে হাহাকারের মত দাঁড়িয়ে আছে বরফের ইগলুগুলো। যেন উধাও অধিবাসীদের আত্মা সেই বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
কাল্লুক একটা ভাঙা ইগলুর ভেতরে ঢুকে ছিটকে বেরিয়ে এল। – উঁহু, এই জায়গার ধারে কাছে থাকা যাবে না। আখলুট ওঁৎ পেতে বসে আছে প্রত্যেকটা ঘরের ভেতরে।
কুপুন তার তোয়াক্কা না করে হুকুম জারি করল, এইখানেই সারিয়ে নিয়ে ডেরাডান্ডা পাততে হবে। এক একটা ফ্যামিলি ঢুকে গেল এক একটা খালি ভাঙা ইগলুতে।
শুধু কাল্লুক ঢুকল না। ও খানিকটা দূরে একটা তাঁবু খাটাল। মেরু ভালুকের চামড়া দিয়ে ঢাকল সেটা। তখন নুনাইটক-এর বয়স? তা ধরো বারো তেরো সূর্য। এ আবার কেমন বয়স গোনা? সেই জায়গায় সূর্য আকাশে দিগন্তের ওপরে থাকে ছ’মাস। সেই সূর্য ওঠারই হিসেব।
ক্লান্ত সবাই তখন চোখ বুজেছে, ছোট্টো নুনাইটক ইগলু ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছে ঘুম আসছে না বলে। দেখল, সাদা একটা পাখির মত কী যেন উড়ে এল। তার মুখটা মেরু নেকড়ের। আর লেজটা যেন তুষারে তৈরি তিমি মাছের। ইগলুগুলির মধ্যে ঢুকে গেল তার ডানার ঝাপট। কুয়াশার স্রোতের মত ভেতরের মানুষগুলির শরীর যেন গলে বেরিয়ে এল সেই বাতাসের স্রোতে। একটা ঘুর্ণিমতন উঠল সেই তুষারের মরুভূমিতে। আর সেই কুয়াশা রাশি সেই তুষারঘুর্ণির অতলে উধাও হল। আকাশ ফাটানো শব্দ করে ভেঙে পড়ল ইগলুগুলোর অবশিষ্ট বরফ কাঠামো।
শুধু বেঁচে গেছে কাল্লুক-এর তাঁবু। সেই কাল্লুকই নুনাইটককে নিয়ে অনেক দক্ষিণে এসে কানাডায় তুলে দেয় মিশনারিদের হাতে। খ্রিস্টান হয়ে তার নাম হল মাইকেল।
মাইকেল বলল, কাল্লুকের মত কেউ ছিল না বলেই ধসে পড়েছে আলগা বরফে বানানো বাপছেলের সখের ইগলু।
স্নো আর আইসের তফাত বুঝতে পারত কাল্লুক।