‘ওষুধের দাম বড্ড বেড়ে গেছে। এত ওষুধ কিনব কী করে?’ আমার সামনে বসা শীর্ণ চেহারার রোগী ঘোলাটে চোখ কুঁচকে জানায়।
‘তা বলে প্রেশারের ওষুধ দুটো করে খাওয়ার কথা, একটা করে খাবেন? সুগারের ওষুধ বন্ধ করে দেবেন? পাঁচশ পঞ্চাশ সুগার নিয়ে দেখাতে এসেছেন- এভাবে চললে মাসখানেকের মধ্যে নিশ্চিত মারা যাবেন।’ আমি খিঁচিয়ে উঠি।
এতক্ষণে লোকটির দু চোখে একটু খুশির আভা দেখা যায়; ‘সত্যি বলছেন, নিশ্চিত মারা যাব। তাহলে তো বেঁচে যাই। আর টানতে পারছি না- সংসার আর সাইকেল ভ্যান কোনোটাই।’
আমি বললাম, ‘পুরোপুরি গ্যারান্টি দিতে পারছি না। হয়তো মৃত্যু হলোনা- স্ট্রোক হল। পক্ষাঘাত হয়ে বিছানায় পরে রইলেন। বাথরুম পায়খানা সব বিছানায়। সারা গায়ে বেড সোর। এখন চারটে ওষুধ খেতে হচ্ছে, তখন চৌদ্দটা ওষুধ খেতে হবে। তখন কী হবে?’
লোকটি ঘাড় নাড়ালেন, ‘মোটেই ভালো হবে না। কিন্তু আমি করবো টা কী? টোটো আসার পর সাইকেল ভ্যানের বাজার খারাপ। নতুন টোটো কিনে রাস্তায় নামাতে গেলে আড়াই লাখের গপ্প।‘
‘আপনি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখান। ওখানে ওষুধ বিনাপয়সায় পাওয়া যায়।‘
‘হাসপাতালে মাত্র সাতদিনের ওষুধ দেয়। আগে এক মাসের দিত। সাতদিন অন্তর কাজ বন্ধ রেখে হাসপাতালে লাইন দেওয়া সম্ভব? তাও সব ওষুধ দেয় না, অর্ধেক কিনতে হয়।‘
বললাম, ‘তাহলে জন ঔষধির থেকে ওষুধ কেনেন। সাজিরহাটেই তো একটা সেন্ট্রালের দোকান হয়েছে।‘
লোকটি একটু থমকে বলল, ‘কিন্তু সবাই যে বলে ওই ওষুধ একেবারে ভুষি মাল। ভেতরে চকের গুড়ো ছাড়া কিছু থাকে না।‘
‘কী যাতা বলছেন। এটা একটা সরকারি প্রকল্প। ওষুধ খারাপ হবে কেন?’
‘সরকারি বলেই তো ভয়। ছেলেকে স্কুল থেকে সাইকেল দিল। এমনই সাইকেল- সারাতে হাজার টাকা বেরিয়ে গেল।‘
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বললাম, ‘আপনি যেটা ভালো বোঝেন করতে পারেন। কিন্তু আমার কথা যদি শোনেন আপনি নিশ্চিন্তে সেন্ট্রালের ওষুধ খান।’
পরের রোগিণীকে আমি চিনি। পাড়ার অনেক বাড়িতেই ঘর মোছা- বাসান মাজার কাজ করেন। এনার যাবতীয় রোগই ক্রনিক। ক্রনিক অ্যানিমিয়া, ক্রনিক হাঁটু ব্যথা, ক্রনিক ডিপ্রেশন, ক্রনিক আমাশা- কোনো রোগই সারে না। তাঁকে দেখার পর তিনি ব্যাগ হাঁটকাতে লাগলেন। বললাম, ‘যান, যান… ভিজিট দিতে হবে না।‘
রোগিণী বললেন, ‘আপনি তো কোনোবারই নেন না। আমার খারাপ লাগে।‘ তারপর তিনি একটা কার্ড বের করে দিলেন। বললেন, ‘এর থেকে আপনার ভিজিটটা কেটে নেন।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কী এটা?’
‘স্বাস্থ্য সাথী কার্ড। এই কার্ডে অনেক টাকা ভরা আছে। চিকিৎসার জন্য, ওষুধের জন্য আমার কোনো খরচ লাগবে না। কার্ড থেকেই সবাই টাকা কেটে নেবে। আমাদের ওখানকার নেতারা বলেছেন।’
কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার বুঝতে ভুল হয়েছে। কেবল মাত্র ভর্তি হলে এই কার্ডের সুবিধা পাওয়া যায়।’
রোগিণী সম্ভবত আমাকে বিশ্বাস করলেন না। বললেন, ‘কিন্তু ওরা যে বলল…’
রোগী শেষ হয়ে গেছে। একজন কম বয়সী “এম আর” দরজা দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছে। তাকে দেখে বললাম, ‘এই যে, কী শুরু হয়েছে। তোমাদের অমুক ওষুধটার দাম একেবারে পাতায় ত্রিশ টাকা বাড়িয়ে দিলে। এভাবে ওষুধের দাম বাড়তে থাকলে লোককে তো ওষুধ খেয়েই পেট ভরাতে হবে- ভাত রুটি জুটবে না।’
এম আর ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখ করে জানালো, ‘আমরা কী করব স্যার। আপনাদের গ্রিভান্স আমি উচ্চ মহলে জানাব।’
এমন সময় বাইরে ভীষন হই চই। রোগী তো শেষ হয়ে গেছে। তাহলে এতো হই হট্টগোল কিসের? পার্থের গলার আওয়াজ পেলেম, ‘ডাক্তারবাবু, তাড়াতাড়ি আসুন। খুব খারাপ পেশেন্ট।’
মাঝবয়সী রোগী একটা ভ্যানে শোয়া। একবার দেখেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তাঁকে স্পর্শ করে নিশ্চিত হলাম- রোগী মারা গেছেন।
রোগীর সাথে গোটা ছয়েক কম বয়সী ছেলে এসেছে। তারা বারবার বলছে, ‘ডাক্তারবাবু, গ্যাস মাথায় উঠে গেছে। দুপুরে কচুর লতি খেয়েছিল। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন। একটা ইংজেকশন দিন।’
আমার হার্ট দ্রুত বেগে চলতে শুরু করল। কী করব ভাবছি। কদিন আগেই রোগীর মৃত্যু নিয়ে পাশেই নিমতায় ভয়ানক গণ্ডগোল হয়েছে। রোগীর আত্মীয়রা ডাক্তারকে তো পিটিয়েছেই, ডাক্তারের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাড়ির লোককেও পিটিয়েছে। সারা বাড়ি একেবারে তছনছ করেছে। বৃদ্ধ বাবার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সেই রোগীর আসলে হার্ট এটাক হয়েছিল। ডা. গৌরব রায় তাঁকে দেখেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর বাড়ির লোকের বক্তব্য ছিল, কেন ডাক্তার সাথে সাথে ইঞ্জেকশন দেয়নি। সাথে সাথে ইঞ্জেকশন দিলে রোগী বেঁচে যেত। তবে কোন ইঞ্জেকশন দিয়ে হার্ট এটাকের রোগীকে খুপরিতে সুস্থ করা যায় আমার জানা নেই।
এখন আমার কী করণীয়? এনাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে বড় হাসপাতালে রেফার করব? মৃত ব্যক্তিকে ইঞ্জেকশন দেওয়াটি কি মেডিকেল এথিকস সম্মত হবে? তাছাড়া রোগীর বাড়ির লোক পরে বলবে নাতো ইঞ্জেকশন দিয়ে আমি রোগীকে মেরে ফেলেছি?
মৃত ব্যক্তির ছেলেকে ডাকলাম। তারপর বাবা বাছা করে তাকে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। সে বলল, ‘কিন্তু বাবাকে নিয়ে মাসখানেক আগেই ভেলোর ঘুরে এলাম। ওনারা যে বললেন কোনো ভয়ের কিছু নেই। ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
ছেলেটির কথা শুনে সাথে সাথে তাঁদের চিনতে পারলাম। এনারা প্রথমে আমার কাছেই এসেছিলেন। ইসিজি দেখে সাথে সাথেই কার্ডিওলজিস্টের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তিনি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করেছিলেন। “ট্রিপিল ভেসেল ডিজিজ”। সিএবিজি অর্থাৎ “করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট” করতে বলেছিলেন। ওনারা আরেকজন কার্ডিওলজিস্টকে দেখান। তিনিও একই কথা বলেন। তারপর তাঁরা ভেলোর চলে যান। ভেলোর থেকে ঘুরে এসে এই ছেলে আর মৃত রোগী আমার কাছে এসেছিলেন। এখানকার ডাক্তারদের নামে তুমুল নিন্দা করে বলেছিলেন, ‘ভেলোরে বলেছে অপারেশন করার কোনো দরকার নেই। ওষুধ চালালেই ঠিক হয়ে যাবে। এখানকার ডাক্তারেরা পয়সা রোজগারের জন্য অকারণে সার্জারি করতে চায়।’
ছেলেটিকে বললাম, ‘ওনার আগের কাগজপত্র কই?’
ছেলেটি একগোছা কাগজ বের করে দিল। আগের বার যখন এসেছিলেন- ওনারা ভেলোরের প্রেসক্রিপশন আনেননি। তাই সেটাই আগে বের করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম একদম প্রথমেই লেখা আছে- “এডভাইজ সিএবিজি- বাট পেশেন্ট পার্টি রিফিউজ টু ডু সো।”
গালি দিতে ভয়ানক ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সদ্য পিতৃহারা একটি ছেলেকে গালি দেওয়া সম্ভব নয়।