কেন্দ্রীয় সূত্রের পরিসংখ্যান বলছে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩-এর ২৭ জুলাই পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (অধিকাংশ সরকারি) মোট আটানব্বই জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। নির্দিষ্টভাবে খতিয়ে দেখলে পরিসংখ্যানটা খানিকটা এমন— আই আই টি—৩৯ জন, এন আই টি—২৫ জন, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি—২৫ জন, আই আই এম—৪ জন, আই আই এস ই আর—৩ জন, এবং ট্রিপল আই টি থেকে দু-জন। এই সংখ্যা হয়তো হেরফেরে উনচল্লিশের জায়গায় বিয়াল্লিশ কিংবা বত্রিশ। সেটা এই প্রতিবেদনের আলোচ্য বিষয় নয়। এটা বোঝা যাচ্ছে এই পরিসংখ্যান অবশ্যই একটা অসঙ্গতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটা ভুল কোথাও হচ্ছে। জীবনের যে স্তরে মানুষ খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর মতো জীবনী শক্তিতে ভরপুর থাকার কথা, সেই বয়সে এমন পদক্ষেপ কেন? এতো গেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পরের অবস্থা। কিন্তু এই সব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা যে সব কোচিনে পড়ার জন্য ভিড় জমায় সেখানের অবস্থা আরও শোচনীয়। রাজাস্থানের কোটা শহরে গড়ে উঠেছে এক আস্ত কারখানা। ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করার সেই কারখানা আসলে কারাগারের নামান্তর। সেখানে চলতি বছরে আত্মহননের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ২২।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আঠারো বছর সম্বন্ধে লিখেছেন—
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়—
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।
কিন্তু মিলছে না যে এ কথা। কেন থেমে যাচ্ছে অকালে এই পথ চলা? তবে কি আজকের প্রজন্মের তরুণ-তরুণী ভীরু, কাপুরুষ। নাকি স্কুলের পাঠ্য বই পড়তে পড়তে জীবনের পাঠ নিয়ে উঠতে পারছেন না তাঁরা। যাঁরা সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক বর্জন করে, কৈশোরের সমস্ত ভালো লাগা বিসর্জন দিয়ে, বন্ধু সঙ্গ না করে কেবল বইয়ে মুখ গুঁজে পড়াশোনা করে এই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে, তাঁদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ছোঁয়ার পরেও কেন তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? আরও প্রশ্ন জাগে মনে। এই সব মৃত্যু ক আত্মহত্যা নাকি খুন? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষার নামে আসলে কী চরম অব্যবস্থা, মূল্যবোধের কী ভীষণ অবক্ষয় সামগ্রিকভাবে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, মন্ত্রী সান্ত্রী সক্কলকে গ্রাস করেছে। এককভাবে বা সামগ্রিকভাবে সেই সব বিভিন্ন উপাদান পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে এই প্রাণগুলোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা ভালো এরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রথমত আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এ ব্যাপারে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন জীবিকার মানুষের সামাজিক মান মর্যাদায় বিরাট ফারাক। তাই এই সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে গেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নিদেন পক্ষে একজন শিক্ষক হওয়া জরুরি। বাজারে সবজি বেচেন যিনি তাঁর মতো কে- বা হতে চায়! তার ওপর ভোটের রাজনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের নীতি লাগু করে রাখায় কিছু সমস্যা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। আমি জাতপাতে বিশ্বাস রাখি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি অর্থনৈতিকভাবে যারা দুর্বল সেই সব বাচ্চার জন্য বিনামুল্যে উন্নত মানের শিক্ষার ব্যবস্থা সরকারের করা উচিত। যাতে তারা মূল ধারার বাচ্চাদের সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে। কিন্তু সেদিকে সরকারের নজর কই? দলিত নামে যখন বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে ডাকা হয় সেই মূহূর্তে একটা অদৃশ্য লক্ষণ গণ্ডি কেটে আমরা তাঁদের বিচ্ছিন্ন করি। প্রতিযোগীতা মূলক পরীক্ষায় অনেক কম নম্বর পেয়ে তাঁরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সেই ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিযোগ বা ক্ষোভ কাজ করে না বিশ্বাস করুন। কিন্তু সুযোগ পেয়ে ভর্তি হওয়ার পর এদের বিভিন্ন রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। উচ্চবর্ণের ছেলেরা মনে করে এঁরা যোগ্যতার বলে এই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়নি, তাই সময় সুযোগ পেলেই এদের ওপর চলে মানসিক নির্যাতন। সেক্ষেত্রে এঁদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। তাকে আত্মহত্যা বলা চলে নাকি সেই সব মৃত্যু খুন। চূনী কোটালের মৃত্যুর একত্রিশ বছর কেটে গেছে, ভারতবর্ষ কি বদলেছে? উপরন্তু আদতে শিক্ষার ভিত দুর্বল থাকায় অনেক সময় আই আই টি-র পড়ার চাপ তাঁদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় না। অসম যুদ্ধে হেরে গিয়ে অবশেষে মৃত্যুর পথ বেছে নেন তাঁরা।
এ সমাজে বাঁচতে গেলে সম্মান চাই, চাই অনেক অনেক টাকা। আর এই দুটো পেতে গেলে হতে হবে আই আই টি ইঞ্জিনিয়ার আর না হলে ডাক্তার। নীট পরীক্ষায় একটা বড়োসড়ো র্যাঙ্ক। বাবা স্বপ্ন দেখায়, মা স্বপ্ন দেখায়, বিজ্ঞাপন স্বপ্ন দেখায়. . .। হায় রে অবোধ প্রাণ। সঞ্চয় সব দিয়ে ভর্তি হয় কোটার কোচিং সেন্টারে। সকাল থেকে সেখানে চলে প্রতিযোগীতা। ব্যাবসার প্রতিযোগীতা, টিকে থাকার এই যুদ্ধের আঁচ গিয়ে পড়ে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। ছাড়িয়েছে। পরিবারের থেকে দূরে থাকা, পড়ার অতিরিক্ত চাপ, জীবনমুখী শিক্ষার অভাব, কোনোরকম খেলাধুলোর ব্যবস্থা না থাকা এসব মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।
সকাল থেকে সন্ধ্যে চলে দৌড়। পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলে চরম লজ্জা, অপমান ঘিরে ধরে তাঁদের। বাবা- মা অনেক স্বপ্ন দেখে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে কোটায় পাঠিয়েছেন। সেই পয়সার রিটার্ন না দিতে পারার গ্লানি গ্রাস করে তাঁদের। এখন শিক্ষায় এক নতুন শব্দ শুনি। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট। জীবন কখন মানে হারিয়ে ফেলছে আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই। তাই অভিভাবকদের কাছে প্রশ্ন, একে কি আত্মহত্যা বলে নাকি এই মৃত্যু খুনের শামিল। আমাদের সন্তানদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারছি না কেন আমরা। যেই বুকে মাথা রেখে সে ভাগ করে নিতে পারে তার ব্যর্থতার গ্লানি। কী কারণে সমস্ত জমা পুঁজি খরচ করে, হাজার হাজার টাকা খরচ করে সন্তানকে প্রাইভেট কোচিং-এ পড়তে পাঠাতে হবে? অভিভাবক হিসাবে তাঁদের কি আমরা শেখাতে পেরেছি জীবনে হারতেও শিখতে হয়। সফল হওয়া যেমন আছে অসফল হওয়াও আছে। অভিভাবক হিসাবে আমরা কি এই দায় এড়িয়ে যেতে পারি?
কোটা শহরে এই কোচিংগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা চলে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য বেসরকারি কোচিং-এর এই রমরমা রাষ্ট্রের ভূমিকাকেই এক বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। রাষ্ট্র কি এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে?
এই আত্মহত্যাগুলো নিয়ে গভীরে তলিয়ে ভাবার সময় এসেছে এবার। সারা পৃথিবী জুড়ে যখন উন্নত দেশগুলোতে যুব শক্তির অপ্রতুলতা তাদের কপালে ভাঁজ ফেলছে সে সময়ে দাঁড়িয়ে ভারত জনসংখ্যার নিরিখে এক নম্বরে দাঁড়িয়ে। ভারত সরকার নাগরিকের জীবনের গুণগত মানের তোয়াক্কা না করে দেশের কোটি কোটি কিশোর- কিশোরীর জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে কি? চাকরির অপ্রতুলতা, শিক্ষার বেসরকারিকরণ, ভোটের রাজনীতি এসব ভুলে এবার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
পনেরো দিন আগে এই লেখা যখন শুরু করেছিলাম তখন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩-এ কোটার কোচিং-এ আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ২২। আজ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩। এই মৃত্যু মিছিল বন্ধ হোক, এই অসংলগ্ন প্রতিযোগীতা বন্ধ হোক, আত্মহত্যার নামে চালানো এই খুন বন্ধ হোক।
‘স্বাস্থ্যের বৃত্তে” পত্রিকার ৫৪নং সংখ্যায় প্রকাশিত।