হিমালয় থেকে সুন্দরবন, ডুয়ারস থেকে জঙ্গলমহল বৈচিত্র্যময় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিমি (দেশের মধ্যে আয়তনে ১৩ তম স্থান)। ২০১১ এর জনগণনায় জনসংখ্যা ছিল নয় কোটি ১৩ লক্ষ, বর্তমানে অভিক্ষিপ্ত (Projected) জনসংখ্যা ১০ কোটি ২৬ লক্ষ (উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও বিহারের পর চতুর্থ জনবহুল রাজ্য)। জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে ছিল ১০২৯ (বিহারের পরেই দ্বিতীয় স্থান)। জন প্রতি বার্ষিক উপার্জন এক লক্ষ ৩১ হাজার টাকা (দেশের মধ্যে ২০ তম স্থান)। শিক্ষার হার ৮০% (দেশের মধ্যে ১৯ তম স্থান)। লিঙ্গ অনুপাত, প্রতি ১০০০ পুরুষে ৯৫০ জন নারী (দেশের মধ্যে অষ্টম স্থান)। পশ্চিমবঙ্গের রয়েছে ছিদ্রযুক্ত (Porous) নদীমাতৃক দীর্ঘ ২১১৭ কিমি বাংলাদেশ সীমান্ত এবং ১০০ কিমি নেপাল সীমান্ত যার বেশিটাই পাহাড়ি অঞ্চল, যেখান থেকে অবিরত বৈধ ও অবৈধ পরিব্রজন ঘটে চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ভূপ্রকৃতিগত প্রধান ছয়টি অঞ্চল হলঃ (১) দার্জিলিং পাহাড়, (২) তরাই ও ডুয়ারস, (৩) তোরসা – তিস্তা – মহানন্দা বিধৌত উত্তরবঙ্গের সমভুমি, (৪) দক্ষিনবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভুমি, (৫) পশ্চিমের রাঢ় অঞ্চল ও জঙ্গলমহল এবং (৬) সুন্দরবন সহ উপকূল অঞ্চল। একদা কৃষি ও শিল্পে উন্নত, প্রথমে দেশভাগ তারপর জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কেন্দ্রের ধারাবাহিক বৈষম্য ও অসম মাশুল সমীকরণ নীতি, এর সাথে হুগলী নদী শুকিয়ে গিয়ে কলকাতা বন্দর অকেজো হয়ে যাওয়া, শিল্পগুলি ও বিনিয়োগ পশ্চিম ভারত ও অন্যত্র চলে যাওয়া এবং সর্বোপরি ধ্বংসাত্বক ও হিংসাশ্রয়ী আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নেতিবাচক কর্মসংস্কৃতি, পশ্চিমবঙ্গকে একটি অত্যন্ত জনবহুল দরিদ্র ও পশ্চাদপদ রাজ্যে পরিণত করেছে। এর সঙ্গে মনুষ্যকৃত ভয়ানক পরিবেশ দূষণ (Massive Environmental Pollution) এবং তজ্জনিত বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) ও জলবায়ু পরিবর্তনের (Climate Change) ফলশ্রুতিতে রাজ্যটিও প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার।
পশ্চিমবঙ্গের মনুষ্যকৃত প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলিঃ (১) দার্জিলিং পাহাড়ের ধ্বস (Landslide), (২) পাহাড়ে অতিবৃষ্টি অথবা মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি (Cloud Burst) তিস্তার হড়পা বান (Flash Flood) এবং ডুয়ারস ও সমতলে বন্যা (Flood), (৩) মালদায় গঙ্গার ভাঙ্গন (Erosion), (৪) মুর্শিদাবাদের ভাগীরথীর ভাঙ্গন, (৫) নিম্ন দামোদর উপত্যকার বন্যা এবং (৭) সুন্দরবন সহ উপকূল অঞ্চলে উপর্যুপরি সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় (Cyclonic Storm) এবং জলোছ্বাস (Tidal Wave) যা প্রায়শই নদীবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবনে (Inundation) পরিণত হয়। আমাদের রাজ্যে কেবল ভোট, নির্বাচনী ও রাজনৈতিক হিংসা, পারস্পরিক দোষারোপ ও আক্রমণ কিংবা কিছু ভোট কেন্দ্রিক, লোক দেখানো, উপরি উপরি কাজ, অনুদান বিতরণ, থিমের পুজোর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণ পরিবহন, কৃষি, শিল্প, কর্মসংস্থান, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, প্রকৃতি সংরক্ষণ, বর্জ্য সংস্থাপন, পরিকাঠামো গঠন ও পুনর্গঠনের পরিবেশবান্ধব (Eco friendly), সবার জন্য (Inclusive) ও সুস্থায়ী (Sustainable) কাজগুলির প্রতি মনোনিবেশ জরুরি। তার মধ্যে অনন্য সুন্দরবন এবং সুন্দরবনের তুলনাহীন বাস্তুতন্ত্রের (Eco System) সংরক্ষণ (Conservation) অবশ্যই প্রাধান্য পাবে।
অনন্য সুন্দরবনঃ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখানদী (Tributaries) সৃষ্ট সমুদ্র মোহনার (Estuaries) বদ্বীপ (Delta) অঞ্চলের লবণাম্বু ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Mangrove Forest) সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং রামসার ও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ অঞ্চল (World Heritage Site)। মনুষ্যকৃত ক্রমাগত অরণ্য ধ্বংস, জনবসতি ও কৃষি ক্ষেত্রের প্রসারের ফলে সুন্দরবন সঙ্কুচিত হয়ে বর্তমানে ৯,৬০০ বর্গ কিমির মত এলাকায় পৌঁছেছে। এরমধ্যে ৬০% রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা ডিভিশনের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় এবং ৪০% রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের (প্রায় ৩,৭২০ বর্গ কিমি) ১৭০০ বর্গ কিমি নদী, খাঁড়ি (Creeks), খাল ইত্যাদি মিলিয়ে জলাভূমি। বাদবাকি অরণ্য ও জনবসতি। এখানকার ১০২ টি দ্বীপের ৪৮ টিতে মানুষ বাস করে।
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্য তারা ক্রান্তীয় (Tropical) অঞ্চলের নদীর সাথে সমুদ্রের মোহনার বদ্বীপ গুলিতে লবণাক্ত (Saline) কর্দমাক্ত এঁটেল মাটিতে (Alluvial Soil) জন্মায়, শ্বাস ও ঠেস মূল ধারণ করে এবং দৈনন্দিন জোয়ার ভাটার জলমগ্নতার মধ্যেও টিকে থাকে। পাশাপাশি এরা মাটিকে ধরে রাখে এবং ঝড়ের প্রকোপকে প্রশমিত (Mitigation) করে। বলা হয়ে থাকে এরা সাধারণ উদ্ভিদের থেকে ১০ গুন বেশি কারবন শোষণ করতে পারে। এদের গোঁড়ায় অল্পজলে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া আনাগোনা করে এবং এদের ফুলের উৎকৃষ্ট মধু নিয়ে মৌমাছিরা এদের ডালে বড়বড় মৌচাক তৈরি করে। এক সময় সুন্দরবনে গণ্ডার সহ বহু প্রাণী বাস করলেও এখন রয়াল বেঙ্গল বাঘ, মোহনার কুমীর, ইরাবতী শুশুক, কামট (ছোট হাঙ্গর), বুনো শুয়োর, চিতল হরিণ, বানর সহ কিছু প্রাণী, গোসাপ ময়াল কেউটে সহ বেশ কিছু সাপ ও সরীসৃপ, ২৬০ রকমের পাখি, পরিযায়ী ইলিশ সহ বহুরকমের মাছ প্রভৃতি বাস করে।
দূষণ ও উষ্ণায়নঃ মনুষ্যকৃত অত্যধিক পরিবেশ দূষণ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি শিল্পোন্নত দেশগুলির এবং চিন ও ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশগুলির মাত্রাতিরিক্ত শিল্প, পরিবহন, খনন, নির্মাণ প্রভৃতি এবং সাম্রাজ্যবাদী মারণাস্ত্রের যুদ্ধ ও পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষাগুলির ফলে ব্যাপকভাবে মাটি, জল ও বাতাস দূষিত হয়ে পড়ছে। বায়ুমণ্ডলে (Atmosphere) জলীয় বাস্প (Water Vapour), কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), ওজোন (O3), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO), সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2), ক্লরফ্লুরোকার্বন (CCl2F2 or CCF), হাইড্রফ্লুরোকার্বন (HCF3 or HFC) প্রভৃতি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি (Greenhouse Gases) অধিক পরিমাণে নির্গত হয়। এরা সূর্যরশ্মি জনিত ভূপৃষ্টের তাপমাত্রাকে বিকিরণে বাধা সৃষ্টি করে (Greenhouse Effect) ভূপৃষ্ট, সমুদ্র প্রভৃতির তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে বিশ্ব উষ্ণায়ন সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে।
উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনঃ বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিণতি মেরু অঞ্চলের (North and South Poles) বরফের চূড়া ও চাদর (Ice caps and layers) এবং হিমবাহগুলি (Glaciers), হিমালয় পর্বত সহ উঁচু পর্বতমালার বরফের চূড়া, চাদর ও হিমবাহগুলি দ্রুত গলতে থাকে। সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি হতে থাকে বছরে প্রায় ৩.২ মিমি হারে। নিচু বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চল জলস্তরের নিচে চলে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে সমুদ্র বক্ষে এল নিনো (El Nino – Southern Oscillation) এবং লা নিনার (La Nina) যে প্রভাব দেখা যায় তার ফলে সমুদ্রের জল উষ্ণ হয়ে ওঠে, স্বাভাবিক বায়ু চলাচলের পরিবর্তন ঘটে। উষ্ণ জল দ্রুত বাষ্পীভূত (Evaporation) হয়ে এবং এছাড়াও খামখেয়ালি আবাহাওয়া মাঝেমাঝেই নিম্নচাপ (Depression) ও গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি করে একের পর এক সাইক্লোন, টাইফুন (Typhoon), হারিকেন (Hurricane), সুপার সাইক্লোন (Super Cyclone), সুনামি (Tsunami) প্রমুখ দুর্যোগ (Calamities) ও বিপর্যয় (Disasters) গুলি ঘটতে থাকে মুলত ক্রান্তীয় অঞ্চলে যার মধ্যে উত্তর ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর অন্যতম।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবনঃ এমনিতেই সমুদ্রস্তর থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা এক মিটারের কম। বারবার সামুদ্রিক ঘূর্ণি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনের কারণে সমগ্র সুন্দরবন অস্তিত্বের সংকটের দোরগোঁড়ায় উপস্থিত হয়েছে। বারংবার সামুদ্রিক ঘূর্ণি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবনের প্রাদুর্ভাব ছাড়াও মরশুমি বর্ষার বিলম্ব ও বিঘ্ন ঘটে। যার ফলে পরিবেশ ও কৃষি কাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এমনিতে ম্যানগ্রোভ বিশেষ করে কেওড়া গাছ ঝড় – বন্যা সহিষ্ণু। কিন্তু তাকে অন্তত ১০ বছর বাড়তে দিয়ে শক্তপোক্ত হতে দিতে হবে। তাছাড়া বারবার ও দীর্ঘস্থায়ী ঝড় – বৃষ্টি – বন্যা হলে ম্যানগ্রোভেরও মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যু ঘটবে সুন্দরবনের অবশিষ্ট প্রাণী এবং অনুপম উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্রের (Biodiversity)। পাশাপাশি মানুষেরও জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। অনেক দ্বীপ ডুবে যায়। ধান, পান, আলু, সব্জি সহ কৃষি, জলাশয়ের মিষ্টি জলের মাছের চাষ, ঘরবাড়ি, গরু – ছাগল সব নষ্ট হয়ে যায়। পানীয় জল, খাদ্য, অর্থ ও যাতায়াতের সমস্যা দেখা যায়। বহু মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু (Environmental Refugee) হয়ে যান। এই মুহূর্তে জনবসতিপূর্ণ ঘোড়ামারা, মৌসুনি প্রভৃতি দ্বীপগুলি গভীর সংকটে।
প্রশমন কর্মনীতি ও কর্মসূচি (Mitigation Plans and Programmes): সুন্দরবনকে রক্ষা করা জরুরি। আবার দক্ষিনবঙ্গকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতেও সুন্দরবনকে রক্ষা করা জরুরি। প্রচলিত ভোট কেন্দ্রিক, লোক দেখানো, গতানুগতিক, অ্যাড হক, আলগা, অনুপযুক্ত, পর্যাপ্ত নয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও আত্মস্যাৎমুলক কাজের বিপরীতে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব, বিজ্ঞানন্সম্মত, সুস্থায়ী, উপযুক্ত প্রযুক্তির, সঠিক পদ্ধতির কাজ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে। এরজন্যে সবার আগে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তারপর প্রশাসনিক তৎপরতা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে এবং অতীতের অভিজ্ঞতাগুলির সারসংকলন করতে হবে। কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার, নিতি আয়োগ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, দাতা সংস্থাগুলি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্তকরণ ও সমন্বয় প্রয়োজন। প্রয়োজন বাংলাদেশের এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সহযোগিতা। এরসাথে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ এবং সেগুলির সদব্যাবহার।
প্রশমন পদ্ধতিগুলি (Mitigation Procedures and Techniques): প্রশমনের ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সঠিক আইন ও প্রযুক্তি মেনে গৃহ নির্মাণ, মিশ্র চাষ, মিশ্র মৎস্য চাষ করতে হবে। বাঁধ সংরক্ষণ, ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ, বাস্তু সংরক্ষণ, উন্নত উপযুক্ত কৃষি, মৎস্য চাষ, মৌমাছি প্রতিপালন, পরিবেশ পর্যটন প্রভৃতির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করতে হবে। বিশেষ ও অভাবী এলাকা হিসাবে সুন্দরবনে গণবণ্টন ব্যাবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে এবং বছরে ২০০ দিনের কাজের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কোনভাবে বা বেআইনিভাবে সংরক্ষিত অরণ্যে প্রবেশ, গাছ কাটা, চোরা শিকার করা যাবেনা। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেও অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। এর জন্যে অরণ্যরক্ষী, উপকূল পুলিশ, বি এস এফ, উপকূল রক্ষী ব্যাবস্থাকে আধুনিক ও উপযুক্ত করে তুলতে হবে।
স্থানীয়ভাবে সৌর, বাতাস, বায়োগ্যাস প্রভৃতি অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদন ও ব্যাবহারের উপর জোর দিতে হবে। কাটা তেল, ডিজেল প্রভৃতির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক চার্জ দেওয়া ব্যাটারিতে যানবাহন ও নৌযান চালাতে হবে। সংরক্ষিত অরণ্যের বাইরে নির্দিষ্ট রুট দিয়ে বাংলাদেশী মালবাহী জাহাজ, ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই বার্য চলাচলের অনুমতি দিতে হবে এবং চেকিং এর ব্যাবস্থা রাখতে হবে। পর্যটন ও সামগ্রিক নৌযান চলাছলের উপরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। ফেরি ঘাট ও জেটি গুলির সংস্কার ও আধুনিকিকরনের প্রয়োজন। সমস্ত জনসমাগমের জায়গায় পরিচ্ছন্ন বায়ো টয়লেট রাখতে এবং ন্যুনতম ব্যাবহারিক মুল্য নিয়ে পরিস্কার রাখতে হবে। শহর, গ্রাম ও বাজার গুলিতে সঠিক বর্জ্য সংস্থাপন (Waste Management) ব্যাবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। নদী দূষণ বন্ধ করতে হবে। ইলিশ সহ মাছের বংশবৃদ্ধির সময় জুন ও জুলাই দুই মাস উপকূল ও নদী থেকে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। ভারতীয় জল সীমানায় বিদেশী ট্রলার ঢোকা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে পরিবেশের প্রভাব সমীক্ষা করে উপযুক্ত ব্যাবস্থা নিতে হবে।
এরসাথে প্রয়োজনীয় ম্যানগ্রোভ বেষ্টনী (Mangrove Ring), উপযুক্ত নদীবাঁধ (River Embankment), সাইক্লোন ও ফ্লাড শেলটার, আগেভাগে সতর্কতামূলক ব্যাবস্থাপনা (Early Warning System), স্থানীয় মানুষদের বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত অনুশীলনের (Simulation) ব্যাবস্থা করতে হবে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দলের অধীনে গ্রাম স্তরে<
র্যাপিড রেসপন্স টিম (RRT) এর ব্যাবস্থা রাখতে হবে।
ম্যানগ্রোভ বেষ্টনী (Mangrove Ring): সমস্ত বিশেষজ্ঞই একটি বিষয়ে একমত যে উপকূল অঞ্চলে এবং সুন্দরবনের নদী পাড় ধরে পুরু ম্যানগ্রোভ বেষ্টনী, তার সাথে সামুদ্রিক ঘাস (Sea Grasses) ও ভেটিভার ঘাস (Vetiver Grass) বুনে আস্তরণ তৈরি করলে একদিকে তারা যেমন ভুমিক্ষয় প্রতিরোধ করতে পারবে, পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ অরণ্য ঝড়ের গতি ও ক্ষয়ক্ষতিকে প্রশমিত করতে পারবে। দুঃখের বিষয় সার্বিক বৃক্ষ ও অরণ্য সংহারের মধ্যে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনানীকেও বিপুলভাবে ধ্বংস করা চলছে। সুন্দরী গাছ তো আর চোখেই পড়েনা।
সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, মথুরাপুর, কুলতলি, বাসন্তী, গোসাবা, ক্যানিং, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ – সমগ্র সুন্দরবনের উপকূল ধরে, নদীগুলির পাড়ে এবং দ্বীপগুলির সীমানা ধরে সুবিস্তৃত ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বলয় তৈরি ও সংরক্ষণ করতে হবে। বাইন, গেওয়া, হেতাল, গরাণ, গর্জন, সুন্দরী, খলসি, কাঁকড়া, কৃপা, গোলপাতা, পশুর, কেওড়া, ভারা, হরগোজা, করঞ্জা, হাবালি প্রভৃতি বিভিন্ন দেশজ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বলয় এবং ভেটিভার কিংবা স্থানীয় ধানি ঘাসের আস্তরণ গড়ে তুলতে হবে। ম্যানগ্রোভের গোঁড়ায় জমা ও জোয়ারের জলে পরিবেশবান্ধব অর্থকরী মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপ ইত্যাদি চাষ করা সম্ভব। ভেটিভার অর্থকরী ঘাস। গ্রামের মধ্যে নারকেল, সুপারি, আম, জাম, পেয়ারা, লিচু, কাঁঠাল, সফেদা, আতা, জামরুল প্রভৃতি অর্থকরী ফলের গাছ এবং শাল, সেগুন, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি কাঠের অর্থকরী গাছ চাষ করা যেতে পারে। দ্বীপের মধ্যে জলাশয় কেটে পাড় উঁচু করে দিয়ে বৃষ্টির জল ধরে রেখে একদিকে পানীয় ও সেচের জলের অন্যদিকে মিশ্র মাছ চাষের ব্যাবস্থা করা যায় এবং অনেক দ্বীপেই এরকম করা হয়।
ভুমি সংরক্ষণ (Erosion Control): সমুদ্র উপকূলে কোথায় প্রশস্থ বালুকাময় সৈকত, কোথাও সংকীর্ণ বালুচর, কোথাও পাড় ভেঙ্গে খাঁড়া নেমে গেছে, আবার কোথাও বা উপকূলের কাছে অগভীর জলে বালির স্তুপ (Sand Dunes) রয়েছে। এছাড়াও সমুদ্রে বহু নদীর মোহনা ছাড়াও বেশ কিছু খাঁড়ি রয়েছে। সেরকম দ্বীপগুলিতে নদী থেকে অসংখ্য খাঁড়ি প্রবেশ করেছে আর কিছু খাল কাটাও হয়েছে। এইসব বালিয়াড়ি গুলি যেমন জলোচ্ছ্বাসের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধক (Natural Barrier) সেরকম খাঁড়ি ও খালগুলি সেফটি ভাল্ভস। এগুলিকে ভালো করে সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বীপ অঞ্চলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের যুক্ত করে এবং ১০০ বা ২০০ দিনের কাজের সাথে সংপৃক্ত করে শীত ও শুখা মরশুমে এই খাঁড়ি ও খালগুলির সংস্কার করে নাব্যতা বজায় রাখতে হবে। এছাড়াও প্রয়োজনে এই খাঁড়ি ও খাল জালিকাগুলি (Channels of River Water System) সংযুক্ত করে, নিচু জলাভুমির সাথে যুক্ত করে, প্রয়োজনে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দ্য নেদারল্যান্ডস এর মত হাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পাম্প হাউস (Wind Mills cum Pump Houses) নির্মাণ করে জলোচ্ছ্বাসের সময় অতিরিক্ত জলকে কিছু গভীর জলাশয় বা নিচু জলাভূমিতে স্থানান্তরিত করতে হবে। সেখানে লবণ উৎপাদন, মাছ চাষ প্রভৃতির কথা ভাবা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জলের পরিমাণ ও উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্লুইস গেট (Sluice Gates) নির্মাণ করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক জোয়ার ভাটার কোন বাধা সৃষ্টি করা যাবেনা।
সমুদ্র ও নদী বাধ (Sea and River Embankments): ভাঙ্গন প্রবণ উপকূল অঞ্চলে কংক্রিট বা পাথরের বোল্ডার (Boulder), দেয়াল (Dyke), স্রোত ভাঙ্গা্র দেয়াল (Spur Dyke) এবং বেশ কিছুটা নিচু ফাঁকা জমি (Polder) রাখতে হবে যারা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাটা সামলাবে। তারপর এক অথবা দ্বিস্তরীয় উঁচু বাঁধ (Dam or Embankment), সংলগ্ন খাল এবং মাঝেমাঝে ফ্লাড গেটের (Flood Gates) এর ব্যাবস্থা রাখতে হবে। বাঁধের আগে, মাঝে ও পরে থাকবে পুরু ম্যানগ্রোভের অরণ্য বলয়। এরও নানা রকম মাপ আছে। একটি হিসাব বলছে এক হেক্টর বা ১২ বিঘা জমিতে ১০ হাজার ম্যানগ্রোভ গাছকে বড় করতে হবে।
নদীর পাড়েও খাঁড়ি ও খালের মুখগুলি বাদ দিয়ে উঁচু শক্তপোক্ত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে এবং তার আগে, ঢালে, উপরে ও পরে ম্যানগ্রোভ বলয় রাখতে হবে। বাঁধের উপরটা রাস্তা হিসাবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে কিছু ফ্লাড গেট রাখতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে খাঁড়ি ও খালের দুপারেও বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধের আগে পরে পাটের তৈরি বালিভরা ব্যাগের (Gunny Bags) প্রাচীর করা যেতে পারে। বর্তমানে সুন্দরবনে ১৮০০ কিমির মত বাঁধ তৈরি করা আছে যার বেশ কিছুটা ভাঙ্গা। ভাঙ্গা অংশ ঠিকমত মেরামত এবং বাকি অংশ শক্তিশালী করতে হবে।
বাঁধ কিরকম হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত আছে। তবে মাটির বাঁধের (Earth Filled Dam) চাইতে ইটের বাঁধ (Earthen Brick Dam), পাথরের বাঁধ (Rocked Filled Dam), সিমেন্ট বাঁধানো ইট বা পাথরের বাঁধগুলি শক্তিশালী। ১৯৩০ এ আবিষ্কৃত প্রাযুক্তিক উইলক্স এর Watertight Embankment ব্রিটিশরা সাফল্যের সাথে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে ব্যাবহার করেছিল যার অনেকটাই এখনও অটুট। বিশেষজ্ঞদের মতামত, স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা প্রভৃতির উপর দাঁড়িয়ে যেটি যেখানে উপযুক্ত সেটি করতে হবে। কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, তথাপি দেখতে হবে যতটা ভালো করে করা যায়।
বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে বর্ষার পর থেকে এবং শেষ করতে হবে পরবর্তী বর্ষার আগে। বর্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের নামে এতদিন হয়ে আসা পুকুর চুরি বন্ধ করতে হবে। তবে ঘূর্ণি ঝড়, অতি বৃষ্টি, জলোছ্বাসে কোন বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষনিক মেরামতের ব্যাবস্থা রাখতে হবে। বাঁধ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করতে হবে। একদিকে নজরদারি থাকবে অন্যদিকে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা হবে। সুন্দরবনের বাঁধ নিয়ে সেচ দপ্তর ও পি ডব্লিউ ডির কেলেঙ্কারির শেষ নেই। নতুন বিভাগ না খুলে সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তরকে সক্রিয় করে এবং স্থানীয় মানুষদের সংপৃক্ত করে সুন্দরবনের বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও সংরক্ষণ, ম্যানগ্রোভ বলয় সৃষ্টি (সংরক্ষিত অরণ্যে বন দপ্তর), অপ্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন প্রভৃতি কাজগুলি করতে হবে।
০৪.০৭.২০২৪