প্রথম রোগী
‘বুঝলেন ডাক্তারবাবু, ভুল চিকিৎসার জন্যে আজ আমার এত কোমরে ব্যথা।’
নতুন রোগী। মধ্যবয়স্ক পুরুষ। বেশ দোহারা চেহারা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। বয়স ছাপ্পান্ন। বছর দুয়েকের কোমরে ব্যথা। সঙ্গে সায়াটিকা। বেশ কয়েকজন ডাক্তার ঘুরে আমাকে পরখ করতে এসেছেন।
‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু কিসের ভুল চিকিৎসা সেটা তো বুঝলাম না!’
‘পাইলসের। পাইলসের ভুল চিকিৎসা চলছিল। ওতেই কোমরে ব্যথা বেড়ে গেছে।’
‘তা পাইলসের সাথে কোমরে ব্যথার কি সম্পর্ক?’
‘আমার পাইলস হয় নি। তবু পাইলসের চিকিৎসা হয়েছে। কবে দু-তিন বার রক্ত পড়েছিল! তাতে পাইলসের চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল! ওই ওষুধ খেয়ে কোমরের ব্যথা বেড়েছে। হয়েছে গ্যাস, চিকিৎসা হচ্ছে পাইলসের!’
আমার ডাক্তারি মন আরো সজাগ হয়ে উঠল। ‘কোত্থেকে রক্ত পড়েছিল? মলদ্বার থেকে?’
কোথা থেকে রক্তপাত আসলে হচ্ছে, আর রোগী বা তার বাড়ির লোকদের বর্ণনা প্রায়শঃ মেলে না। রোগী বলে ‘রক্ত বমি হচ্ছে’ । অথচ সেটা আসলে কাশির সাথে রক্তপাত। এরকম বহুবার হয়েছে। তাই আমি বাড়তি সতর্ক।
‘হ্যাঁ। মলদ্বার থেকেই।’ রোগী তুমুল আত্মবিশ্বাসী।
‘টাটকা? পায়খানার সাথে, না পরে পড়েছিল?’
‘হ্যাঁ, টাটকা রক্ত। তবে বেশী না। দু-মাস আগে বার তিনেক। পায়খানার পরে পড়েছিল।’
‘রক্তপাতের সময় ব্যথা হয়?’
‘না। ওখানে কোনো ব্যথা নেই।’
‘কোষ্ঠকাঠিন্য আছে?’
‘আছে। ইসবগুল খাই।’
‘হুমম্। আপনাকে কে এই কথাটা এত নিশ্চিত ভাবে বলল যে আপনার পাইলস নেই?’
‘পাইলস হলে দেখা তো যাবে। নিদেনপক্ষে হাতে তো পাওয়া যাবে!’
‘কি করে দেখবেন? আয়না লাগিয়ে, না ক্যামেরা দিয়ে? নাকি বিশেষ যোগাসন করে নিজের চোখ দুটোকে ওই বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়ে?’
‘না, মানে…’ আমার বকুনি খেয়ে ভদ্রলোক আমতা আমতা করতে লাগল।
‘আপনার আগেকার ট্রীটমেন্টের কাগজপত্রগুলো দেখি।’
আগের দুজন ডাক্তারই মলদ্বার থেকে রক্তপাতের জন্য সার্জেনকে দেখাতে বলেছেন। হিমোগ্লোবিন কম থাকায় একজন ডাক্তার আয়রন ট্যাবলেট দিয়েছেন। কিন্তু রোগী কোনো উপদেশই মানে নি।
‘আপনার তো পাইলস হতে পারেই। অন্য আরো কোনো জটিল রোগও হতে পারে। সার্জেনের কাছে যান নি কেন?’
‘এখন তো রক্ত পড়ছে না!’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনি কোন স্কুলে পড়ান?’
সঙ্গে আসা ত্রিশের মহিলা-সম্ভবতঃ রোগীর মেয়ে- হাসতে লাগল।
রোগী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বকুনি লাগাল, ‘তুই চুপ কর।’
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি টীচার আপনি বুঝলেন কি করে? আমি তো বলিনি!’
‘আপনার গায়ে লেখা আছে। আই মিন, আপনার কাজকর্ম, কথাবার্তায় মনে হল।’
তারপর একটু থেমে বললাম, ‘দেখুন, টীচারদের আমি শ্রদ্ধা করি। আমার টীচাররা না থাকলে আমি এখানে আসতেই পারতাম না। কিন্তু টীচারদের অনেক দোষও আছে। প্রথম দোষ হল- তারা স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী- সবাইকে ষ্টুডেন্ট মনে করে।
রোগীর মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’
‘দ্বিতীয় দোষ হল, তারা মনে করে পৃথিবীর সমস্ত বিষয় সম্পর্কে সবকিছুই তারা জানে।’
রোগী কিছু বলার আগেই তার মেয়ে বলল, ‘এবারও একদম ঠিক!’
রোগী এবার মিনমিন করে বলল, ‘আমার বাড়ির লোকেরাও তাই বলে। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে।’
রোগীর মেয়ে বলল, ‘সত্যি কথা, আপনি কী মানুষের মন পড়তে পারেন?’
‘একদম না। পারলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যেত। আগুন জ্বলে যেত। তবে একটু আধটু আন্দাজ করতে তো পারি।’
রোগীর দিকে ফিরে বললাম, ‘আপনি কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সার্জেনকে দেখাবেন। এই বয়সে রক্ত পড়া ভালো না। পাইলস তো সাধারণ রোগ! আরও গুরুতর কিছু বেরোতে পারে।’
দ্বিতীয় রোগী
ঠিক রোগী নয়। ইনি রোগীর বাড়ির লোক। স্ত্রীর এমআরআই রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন।
‘ডাক্তারবাবু, ল্যাবরেটরিগুলো তো ডাকাত !’
‘ডাকাত মানে? আপনার টাকাপয়সা জোর করে কেড়ে নিয়েছে?’
‘না, তা নয়। তবে অন্য জায়গায় যা নেয় তার বেশী টাকা নিয়েছে! আবার অকারণে রক্ত পরীক্ষাও করালো। সব ডাকাত !’
হয়েছে কি, গতদিন ওনার স্ত্রী কোমরে, পায়ে ও ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে এসেছিলেন। তাছাড়া পাঁচ বছর আগে টিউমার হওয়ার কারণে তাঁর জরায়ু বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই সংক্রান্ত এক চিলতে কাগজপত্রও নিয়ে আসে নি। সেসব নাকি কোভিডের পর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বভাবতঃই সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট। আর তাই সন্দেহের তালিকা থেকে টিউমার মেটাস্টাসিস বাদ দেওয়ার জন্যে সাধারণ এমআরআই-এর পরিবর্তে কনট্রাষ্ট এমআরআই (ওষুধ দিয়ে) লিখেছিলাম। তাতেই বিপত্তি। কিডনির পরিস্থিতি না দেখে কনট্রাষ্ট ইঞ্জেকশন করা যায় না। তাই ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষাও দরকার। বলেও দিয়েছিলাম বেশী খরচ হবে। ছাড় দেওয়ার জন্য লিখেও দিয়েছিলাম- যেমন সবাইকে দিই। তারপরেও ডাকাত !
ব্যপারটা বললাম। এটাও বললাম যে, আগেরদিন রোগীর সামনে- টিউমার মেটাস্টাসিস, ক্যান্সার – ইত্যাদি সন্দেহের কথা বলিনি। কারণ সেটা সন্দেহমাত্র।রোগীকে অনাবশ্যক ভয় পাওয়াতে চাই নি।
সব শুনে রোগীর স্বামী এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ি থেকে পুরোনো সব রিপোর্ট নিয়ে এল। দিস্তাখানেক কাগজ। পড়লাম সব।
জরায়ুতে বিরাট বড় টিউমার ছিল। তবে বায়োপসি রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যান্সার নয়।
বললাম, ‘এইটুকুর জন্যে একজনকে ডাকাত বলে দিলেন!‘
চুপ করে রইলেন ভদ্রলোক।