সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২
ব্লগ লেখার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ মনে হয় বেশ কিছু কথা না লিখে রাখলেই নয়। আর একজন সার্জনের প্রতিটি দিনেই তো একটা করে গল্প তৈরি হয়। গল্পগুলোর জন্ম হয় প্রতিদিন, সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়েও যায় সেগুলো। প্রতিদিনই। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে কফির মাগ হাতে ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিদ্যুৎ চমকের মতো ফেলে আসা কোনো ঘটনা মনে পড়ে যায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায়, অথবা চোখের কোল বেদনায় চিকচিক করে ওঠে। মনে হয় ঘটনাগুলো যদি লেখা থাকতো…….
আমি যে সময়ে বড় হয়ে উঠেছি সেই সময়ে নিজের ইচ্ছে মতো নিজের ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়া যেত না। মাধ্যমিকে বেশ ঝকঝকে একটা রেজাল্ট হতেই বাবা-মা সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি করে দিলো। অথচ আমার সেই কিশোর সংস্করণের ভয়ানক ইচ্ছে ছিল ইতিহাস নিয়ে পড়ার। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর না পড়তে পারা লিপি ভয়ংকর টানতো ছেলেটাকে, মিশরের ফারাওদের জীবনকাহিনী গোগ্রাসে গিলতো, সুভাষের ঘর ছাড়ার গল্প নিশির ডাকের মতো তাঁর সঙ্গে ঘর ছাড়তে বলতো। কিন্তু রিষড়ার রামকৃষ্ণ আশ্রমের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হতে হলো নন্দলাল ইনস্টিটিউশনে। আমরা বলতাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন রামকৃষ্ণ আশ্রমে ইলেভন- টুয়েলভ ছিল না। শ্রীরামপুর কলেজেও অবশ্য ভর্তি হতে পারতাম। কিন্তু আমার গুরুজনেরা আমার চারিত্রিক দৃঢ়তার ওপর ঠিক ভরসা রাখতে পারেনি। কোএডুকেশন স্কুল কলেজে পড়লে ছেলেটা ঠিক মেয়েদের খপ্পরে পড়বে। সেই বয়সের ছেলেরাই যে মেয়েদের পড়ার জন্য নিজেদের ‘খপ্পর’ খুলে রাখে সেটা জানতো না তারা। ফলে স্কুল ছুটির পরে সাইকেলে করে পালিয়ে যেতাম শ্রীরামপুর কলেজে। আমার রামকৃষ্ণ আশ্রমের কিছু ভাগ্যবান বন্ধু পড়তো সেখানে। আড্ডা এবং চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। কারোর পিতৃদেবের সাধ্য ছিল না আমায় ধরে। আমার পিতৃদেব তো বাচ্চা ছেলে।
তাও এইচএসের রেজাল্ট ভালোই হলো। ততদিনে ফিজিক্সটা বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। মনের মধ্যে ঠিক করা হয়ে গেছে যে ফিজিক্স নিয়েই পড়বো। কিন্তু সায়েন্স নিয়ে পড়বো অথচ জয়েন্ট দেবো না তাই কখনো হয়? আমার বাবা-মা কি অতো সহজে ছেড়ে দেবার বান্দা? সুতরাং জয়েন্টে বসলাম এবং আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে বিপদে ফেলে ডাক্তারিতে র্যাঙ্ক করে বসলাম।
অনেক চোখের জলে আমার আর জি কর কলেজ যাত্রাটা পিচ্ছিল হয়ে থাকলো। অ্যানাটমির ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ দেবার শিরদাঁড়ায় শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা আরও পড়াশোনাটার ওপর বিবমিষা জাগিয়ে দিল। তাও চালিয়ে নিচ্ছিলাম কোনোরকমে। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রথম গাঁট ফার্স্ট প্রফেশনাল এমবিবিএস উতরানোর পর ক্লিনিকাল ক্লাস শুরু হলো – মানে সরাসরি পেশেন্ট দেখে পড়াশোনা। আমার ফাটা কপালে প্রথমেই জুটলো গায়নাকোলজি। একজন টিচার নর্মাল ডেলিভারি পড়াচ্ছেন। নৃশংসভাবে এপিসিওটমি দেওয়া হলো (ওইভাবেই দেয়, ওইভাবেই দেওয়া উচিত)। মাথা টাল খেলো, আশেপাশের সহপাঠী (এবং অবশ্যই সহপাঠিনীরা) আবছা হয়ে এলো। টিচারের অস্পষ্ট চিৎকার হালকা করে কানে এসে ঢুকলো- গেল গেল, ছেলেটার ভেসোভেগাল হয়েছে। তারপরে দুম করে একটা আওয়াজ। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। মেয়েদের মুখে মুচকি হাসি, হাড়হাবাতে বজ্জাত ছেলেবন্ধুগুলোর চোখেমুখে মুরগী পাওয়ার আনন্দ। তারপর থেকে বন্ধুদের সাথে মতের মিল না হলেই শুনতে হতো -“চল, গাইনির ক্লাস করে আসি।’
আমার রুমমেট ছিল ভাগ্নেদা। আমার থেকে বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র। সার্জারির হাউসসার্জন। আমাকে একদিন জোর করে নিয়ে গেলো সার্জারি ওয়ার্ডে। একটা বাচ্চা মেয়ে পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছে। নাভীর কাছে ব্যথা। ভাগ্নেদা দেখেটেখে বললো যে অ্যাপেনডিসাইটিস হয়েছে। ধ্যাৎ, তাই কখনো হয় নাকি? অ্যানাটমিতে পরিষ্কার পড়েছি যে ডানদিকের তলপেটে অ্যাপেন্ডিক্স থাকে। ঢপ মারার আর জায়গা পাওনি?
ভাগ্নেদা পুরো নার্ভের ডিস্ট্রিবিউশন দিয়ে ব্যাপারটা বোঝালো।তাও আমার বিশ্বাস হয় না। প্রায় জোর করেই রাত সাড়ে বারোটার সময় আমাকে সিবিওটিতে নিয়ে গেলো ও। ডানদিকের পেট কেটে প্রায় পচে যাওয়া অ্যাপেন্ডিক্সটা যখন বার করলো ও তখন আমার চোখ ছানাবড়া। একেবারে অঙ্কের মতো মিলে গেল সব। আর আশ্চর্যের ব্যাপার – আমার একটুও ভয় লাগেনি।
সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম পড়তে হলে সার্জারি নিয়েই পড়বো। আমার সত্যিকারের প্রথম প্রেম…..
অনির্বাণ দারুণ লাগলো, তোর লেখা আমার ভাল্লাগে তার কারন লেখার সাথে হাস্য রসের অপূর্ব মিশ্রণ, যেটা আমাকে খুব টানে, হাসি তো আমাদের জীবন থেকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই এইসব লেখাই আমার কাছে খুবই লোভনীয়।
আরো লিখতে থাক, তোর পরের পর্বের অপেক্ষায় ।
অসাধারণ
দারুন স্যার।
অসাধারন। পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।