হাসপাতালের বাইরে, ঠিক উল্টোদিকের চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জনে। সকালের ভিড়েঠাসা আউটডোর শেষ করে, স্বস্তির চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে সবে সিগারেট ধরিয়েছে অর্পণ।
“আরে বাবু আপনারা ইখানে আছেন। আর উদিকে চিনাম্যানটা ছটফটাচ্ছে।খাতা লিয়ে আপনাদের ঢুণ্ডতে ঢুণ্ডতে আমি পরেসান হয়ে গেলাম। জলদি চলুন।”
কলবুক নিয়ে চায়ের দোকানেই উপস্থিত হয়েছে ইমার্জেন্সি ওটির ওয়ার্ড বয় বংশী। আধ খাওয়া সিগারেটের কাউন্টারটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, কলবুকে খসখস করে সই করে,বংশীর সাথে এগিয়ে যেতে যেতে অর্পণ বললে,”আমি পেশেন্টটা দেখে নিচ্ছি রে সার্থক। তুই সিগারেটটা শেষ করে আয়।”
মনে মনে একটু হাসলাম আমি। আসলে আজ সকালের আউটডোরে বিকেলে ইমার্জেন্সি অপারেশন করবার মতো সেরকম কিছু কেস ওর হাত জোটেনি, এটাই সার সত্য। হিসেব অনুযায়ী আজ অর্পণের ইমার্জেন্সি অপারেশন করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কারণ আগের সোমবারটা আমার ছিল, আর সেদিন হয়েছিলও অনেকগুলো কেস। তাই অর্পণের তাড়াহুড়োটা খুবই স্বাভাবিক।
আমি আরাম করে চা আর গোল্ড ফ্লেকটা শেষ করে ইমার্জেন্সির দিকে পা বাড়ালাম। প্রত্যাশা মতোই লিফ্টটা খারাপ ছিল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে যাওয়ার মুখেই দেখা অপরেশদার সাথে। ্যাকটিসিং সার্জেন,আমাদের সার্জিক্যাল ইউনিটের ক্লিনিক্যাল টিউটর।গোদা বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায় তা হলো,অন কল অ্যাডমিশনের দিনে জুনিয়র ডাক্তারদের সর্দার।
“অর্পণ এখন দেখছে রুগীটাকে,আমার দেখা হয়ে গেছে। অ্যাপেনডিসাইটিস। খারাপ কেস। বিকেলে ওটিতে রেখে দিস। আমি কাছেই থাকবো, কোনও দরকার হলে ডেকে নিবি। আর শোন, আজ তো অর্পণের দিন, তাই না!” বলে কলপ করা গোঁফের তলায়,একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসলো।হাসিটা দেখেই আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। অপরেশদা এমন একটা ভাব করলো, যেন বন্ধুর সার্জারি ডেটে আমি অপারেশন করার জন্য হামলে পড়বো। ঠিক আছে, যখন রাতে ঘুমোবে ছাদের ঘরে,টুক করে ঢুকে ফুট করে লাইটের বালব টা খুলে দেবো। লোকটার এমনিতেই যা ভূতের ভয়!
ঠিক সময়ে প্ল্যানটুকু মাথায় আসায়, মনে মনে নিজের তারিফ না করে পারলাম না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা করিডোর পেরিয়ে ওটিতে এসে ঢুকলাম। দেখলাম, অর্পণ ওটি কমপ্লেক্সের ভিতরে এক মাঝবয়সী চিনা ভদ্রলোককে পরীক্ষা করছে। আর লোকটা ভারি অদ্ভুত টাইপের। এমনিতে চুপচাপ শুয়ে থাকলেও পেটে হাত দিলেই ক্যাঁক করে লাফিয়ে উঠছেন। অথচ বারংবার প্রশ্ন করলেও কোন উত্তর দিচ্ছেন না। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি কোন ভাষাতেই না।
রোগীর সঙ্গীসাথীদের সাথে কথা বলে অবশ্য এই কারণের কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না। আমরা অপরেশদার কথা মতো পেশেন্টকে, তাৎক্ষণিক ব্যাথা কমানোর ওষুধপত্র দিয়ে, সিস্টারকে অপারেশানের জন্য রেডি করতে বলে ক্যানটিনে চলে গেলাম দুপুরের বরাদ্দ ঠান্ডা ট্যালট্যালে মাছের ঝোল ভাত উদরস্থ করতে। যাহোক করে খাওয়া সেরেই ঢুকে পড়তে হবে অপারেশন থিয়েটারে। দেরি করা চলবে না।
যখন ফিরছি তখন দুপুরের গণগণে রোদ্দুর একটু মিইয়ে পড়েছে। বেলা গড়ানোয় হাসপাতাল চত্ত্বরে কমেছে রোগীর ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে আসা অপেক্ষমাণ আত্মীস্বজনেরাও এই সুবাদে ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। একটু বাদেই ভিজিটিং আওয়ার্সে ওয়ার্ডে ঢোকার তোড়জোড় আবার শুরু হবে।
আমি আর অর্পণ,অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম, ডাক্তারদের বসার ঘরে, আলো করে বসে পুরনো খবরের কাগজ পড়ছে আমাদের সিনিয়র হাউস স্টাফ আমিনুল। ওর ট্রেনিংয়ের মেয়াদ শেষ হয়ে আসায়, স্বাভাবিকভাবেই একটু অনিয়মিত হয়ে পড়েছে আজকাল।
কিন্তু ও থাকলে সব কাজেই আমরা দুজন একটু ভরসা পাই। হাজার হোক অভিজ্ঞতার একটা দাম তো আছেই।
“অ্যানস্থেটিস্ট দিদি ঐ পেশেন্টকে নিয়ে নিয়েছেন ওটি তে। তোরা দু জনে নেমে পড়, আমি বাইরে রইলাম। দরকার হলে নামবো। কেসটা খারাপ”।খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই মন্তব্য করল আমিনুল। আর ঠিক সেই মুহুর্তে কলবুক হাতে উদ্বিগ্ন বংশীর প্রবেশ ঘটলো।
“স্যার, অর্থোপেডিকসের অন কল ডাক্তার রণজিৎ অপারেশনে বিজি আছেন। এদিকে বাইরে একঠো ফ্রাকচার রুগী বহুত দের সে ট্রলি পর শো’য়ে হ্যায়। লোকাল পেসেন্ট, পার্টি ভি ঝামেলা করছে।”
আমরা ওটিতে ঢোকার সময়ই দেখেছি রোগীটিকে। তবে সরকারি হাসপাতালে এসব নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে প্রায়ই এইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলে।আমরা তাই এই ঘটনাকে পাত্তা না দিয়ে চিনা ম্যানের অপারেশনে নেমে পড়লাম।
ততক্ষণে রোগীকে কোমরে ইঞ্জেকশন দিয়ে তার নিম্নাঙ্গ অবশ করে দিয়েছেন অ্যানাস্থেটিস্ট দিদি।
অভিজ্ঞ ডাক্তারদের কথা মতোই অপারেশন কেসটা জটিল হলেও অর্পণ বেশ সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি কথামতো সঙ্গত করে চললাম ওর সাথে। সাপের মতো পেটের ভিতর শুয়ে থাকা অ্যাপেন্ডিক্সটি, অসুস্থ হয়ে জড়িয়ে ধরেছে পাশের খাদ্যনালীটিকে, হলদেটে পুঁজের একটা আস্তরণ নজরে আসছে। খেয়াল করলাম কঠিন কেস দেখে উৎসাহিত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমিনুলও কখন যেন নেমে পড়েছে আমাদের সাহায্য করার জন্য।
কিন্তু অন্যদিকে থিয়েটারের বাইরে ক্রমাগত আওয়াজ বেড়ে চলেছে।মনোযোগ সহকারে কাজ করার জন্য আমরা অনেকক্ষণ তা বুঝতে পারিনি। আচমকাই দরজার বাইরে থেকে সবুজ পর্দা সরিয়ে বংশীর ভয়ার্ত মুখ দেখা গেল।
“ডাক্তার রণজিতের সাথে ঝামেলা করছে পেসেন্ট পার্টি। গায়ে হাত দিচ্ছে।পুলিশকে খবর করলেও, আবতক কোয়ি ভি নেহি আয়া।”
আমাদের অপারেশন এখন শেষ পর্যায়ে। অন্তিম মুহূর্তে অ্যাপেন্ডিক্স রণে ভঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অর্পণের হাতে। বন্ধ করা হচ্ছে পেট।
কিন্তু সাথে এটাও বুঝতে পারছি যে ওটির বাইরের কোলাপ্সেবেল গেটে কেউ অনবরত লাথি মারছে আর ঝনঝন শব্দে ভাঙছে কাঁচের জানালাগুলো।
হাওয়া তো ব্যাপক গরম তাহলে!!!
হাসপাতালে পেসেন্ট পার্টির হুজ্জুতি এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।কিছুদিন আগেই প্রায় মাঝরাতে আমাদের দুই ক্লাসমেটকে রীতিমতো মার খেতে হয়েছে। কথায় কথায় উন্মত্ত জনতার ডাক্তার পেটানো এখন প্রায় ছোঁয়াচে রোগের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্দা সরিয়ে বাইরের পরিস্থিতি দেখে অ্যানাস্থেটিস্ট দিদি কাঁদো কাঁদো গলায় এসে জানালেন,”পেসেন্ট পার্টি ঘিরে ধরেছে রণজিৎকে। ভাঙচুর চালানো শুরু করেছে। তোরা শিগগির কিছু কর।’
আমাদের কাছে ততক্ষণে অপারেশনের চ্যালেঞ্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার তাহলে মনোযোগ দিতে হবে বাইরের অশান্তির। আমিনুলকে বাকি কাজ শেষ করার দায়িত্ব দিয়ে আমি আর অর্পণ বেরিয়ে এলাম ওটির বাইরে।
দেখলাম স্বভাবশান্ত এবং অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির মানুষ রণজিৎদাকে গলা ধাক্কা দিচ্ছে দুটি কম বয়সী ছোকরা। মুখে তাদের খিস্তিখেউড়ের বন্যা।রণজিৎদা তাদের কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
আর বেশকিছু লোক একত্রিত হয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে। কিন্তু কি বলছে একদমই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মারো কথাটা বুঝতে পারলাম। আর শুনলাম, সব কো জ্বালা দো!
আমি আর অর্পণ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
“কে কাকে মারবি রে?” বাজখাঁই গলায় ডাক ছাড়লো অর্পণ। নাটক করা গলা ওর। যা অডিটোরিয়ামের শেষ মাথায় বসে থাকা দর্শকের কানে অবলীলায় পৌঁছে দিতে পারে ও।
ঘুরে তাকালো এই দঙ্গল। লাল লাইট জ্বলে থাকা থিয়েটারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা দুই অদ্ভুত দর্শন মূর্তিকে অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করলো!
ক্যাপ,মাস্ক আর সবুজ সার্জিক্যাল গাউনে ঢাকা দুটি অবয়ব, আর তাদের হাত ঢাকা রক্তমাখা দস্তানায়। অর্পণের হাতে মা কালীর খাঁড়া র মতো করে ধরা ডিভারস রিট্রাকটার। আর আমার হাতে রক্তাক্ত স্ক্যালপেল।
“আয় ব্যাটারা এবার আয়। সাহস থাকে তো ডাক্তারের গায়ে হাত দিয়ে একবার দেখা দেখি।” চড়া গলায় চ্যালেঞ্জ জানালাম আমি। খেয়াল করলাম ভিড়টা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গেছে। বুঝতে পারছে না আর এগোবে কিনা! কিন্তু এখনও পিছু হটছে না। তবে একদম চুপ করে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।
“ভাগ এখান থেকে।……….,যতসব শয়তানের দল।”
অপারেশন শেষে কখন যে আমিনুল বেরিয়ে, আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা লক্ষ্য করিনি। তার হাতে উদ্যত স্যালাইনের স্ট্যান্ড। একদম ত্রিশূলের মতো করে ধরা।
ভিড়টা এইবার ভাঙতে শুরু করেছে। সুযোগ বুঝে আমরাও তাড়া করলাম ওদের। এলোমেলো হয়ে যাওয়া জনতা করিডোর, সিঁড়ি বেয়ে, হাসপাতালের বাইরে পৌঁছে গেল মুহূর্তে।
ততক্ষণে আউটপোস্টের পুলিশ এসে পড়েছে, যথারীতি সব উত্তেজনা অবসানের পর। ফিরে এসে দেখলাম আতঙ্কিত রণজিৎদা র চোখমুখ থেকে ভয়ের রেশ তখনও কাটেনি। “তোরা না বেরিয়ে এলে আমাকে বোধহয় এরা মেরেই ফেলতো রে। অপারেশন না শেষ হওয়ায় আমার আসতে যে দেরি হয়েছে,বুঝতেই চাইছিল না সেটা।” তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বললে,”কিন্তু পেসেন্টটা কোথায় গেল বলতো? সে তো ট্রলিতেই শুয়ে ছিল!” আমরাও লক্ষ্য করলাম,ট্র লি টা সত্যিই ফাঁকা।
বংশী হেসে বললো, “পেসেন্ট তো লাংরতে লাংরাতে পাবলিকের সাথে বেরিয়ে গেলো। “
সেটা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু কি আর করা যাবে!কোল্যাটারাল ড্যামেজ!যুদ্ধবিগ্রহে হয়েই থাকে।
ওটিতে ঢুকে দেখলাম আমাদের অপারেশনের রোগী ততক্ষণে টেবিল থেকে ট্রলিতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বংশী এবার তাকে নিয়ে যাবে ওয়ার্ডে।
এতক্ষণ কোন ভাষাতেই একটিও কথা না বলা চিনাম্যান আমাদের দেখে এক গাল হেসে বললেন,”ক্রাইসিস ওভার!!!”
চমৎকার লিখেছেন ছোটোবাবু