এই চরিত্রহীন সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না, নতুন কিছু ভাবতেও সাহস হয় না।
মায়ামাখা অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বারবার। সেই ধূসর, সেপিয়া রঙের অতীত — এখন যা প্রায় অবাস্তব মনে হয়, মনে হয় যেন জন্মান্তরের কথা।
সেই অন্য দিগন্তের অন্য ভোরের একটা তামাদি হয়ে যাওয়া কাঁচা হাতের লেখা দিলাম নতুন বন্ধুদের জন্য।
পুরোনো বন্ধুরা তো আগেই পড়েছেন।
চরিত্রহীন
********
আদ্যিকালের কাঠের সিঁড়িগুলো ভাঙতে ভাঙতে একটু বুঝি হাঁপ ধরছিল শ্রীময়ীর। ব্রিটিশ আমলের বাড়িঘর, তিনতলা মানে হাল আমলের পাঁচতলার সমান। তবু লিফটের ভরসা না করে হেঁটে ওঠার জেদ কেন হল তার?
দীর্ঘ বারো বছর পরে সুধীরেশের মুখোমুখি হওয়ার ব্যগ্রতা? নাকি উৎকন্ঠা? যদি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে সুধীরেশ? যদি বলে –”না রাধা, আমি এই ব্যাপারে কিছু করতে অপারগ—”, তা হলে?
গলার কাছটা শুকিয়ে আসছিল। মলিন তাঁতের আঁচলে ঘর্মাক্ত মুখটা একবার মুছে নিল শ্রীময়ী। আরো কতটা উঁচুতে উঠতে হবে সুধীরেশের দেখা পেতে?
শ্রীময়ীদের পাড়ার ছেলে ছিল সুধীরেশ। বরানগরের মধ্যবিত্ত পাড়া। ওর বাবা ছিলেন আবগারি দফতরের মাঝারি মাপের অফিসার। সুধীরেশ তখন স্কটিশচার্চ কলেজের ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। তুখোড় কথাবার্তার, ঋজু ব্যক্তিত্বের ছেলেটিকে প্রথম দেখাতেই ভীষণ ভাল লেগে গিয়েছিল শ্রীময়ীর। ওরা কৃষ্ণনগরে থাকত। বাবা ছিলেন অধ্যাপক। আচমকা কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে বদলি হলেন প্রেসিডেন্সিতে। সেটা ১৯৬৯ সাল। শ্রীময়ী তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রী।হঠাৎ বদলি। বাধ্য হয়েই স্থানীয় ইস্কুলে এক ক্লাস পিছিয়ে ভর্তি হতে হল নবম শ্রেণীতে। বোন শ্রীলেখা তখন বেশ ছোট।
রোজই দেখা হত বাসস্ট্যান্ডে।টুকরো হাসি, সৌজন্য বিনিময়, পড়াশোনার খবরাখবর — এসবের মাঝেই কখন যেন ভালবাসার গভীর চোরাস্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল দুজনকে, শ্রীময়ী ভাল করে অনুধাবনই করতে পারল না।একটা ছোট্ট নিশ্বাস পড়ল ওর। পৌঁছে গেছে তিনতলায়। নির্দিষ্ট ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটু থমকালো সে। পর্দাটানা দরজার বাইরে টুলে পিওন বসে আছে। অভ্যস্ত হাত বাড়িয়েছে — ”স্লিপটা দিন।”
কাঁপা হাতে নিজের নাম লেখা স্লিপটা এগিয়ে দিল শ্রীময়ী। মিনিটখানেকের বিরতি। বুকের ধকধক শব্দটা এত জোরে শোনা যাচ্ছে যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে। পিওনটা ফিরে এসেছে — ”বসতে হবে।সাহেব একটু ব্যস্ত আছেন।”
কথাগুলো যেন বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল ওর। কি আশা করেছিল সে? নামটা পড়ামাত্র সুধীরেশ দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে? ওর সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠবে –”রাধা, তুমি? তুমি এসেছ? এতদিন পরে মনে পড়ল?” — সুধীরেশ মজুমদার, যে কিনা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দফতরের ডাকসাইটে সচিব!
পিওনটা সদয়কন্ঠে সামনের কাঠের বেঞ্চটা দেখিয়ে দেয় — ”ওখানটায় বসুন দিদি। সময় লাগবে একটু”—
কবজি উল্টে সময় দেখে শ্রীময়ী। এগারোটা পঁচিশ। লোকাল কমিটির নির্মলকাকা বলেছিলেন –”আমি নগেনকে বলে রেখেছি। ওর বড় জামাই এডুকেশন মিনিস্টারের পি.এ। সে রিকোয়েস্ট করলে সুধীরেশ দশ মিনিট সময় নিশ্চয় দেবে।তুমি সব ডিটেলসে বলতে পারবে তো মা? পেনশনের কাগজপত্র গুলো নিয়ে যেও। দেখিও। ফাইলটা কেন মুভ করছে না, জানতে চেও। পাঁচ বছর হয়ে গেল অশোকদা চলে গেছেন — পাঁচ বছর তো বড় কম সময় নয় মা।”
ধুলো ঝেড়ে বেঞ্চের এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে শ্রীময়ী। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা। একসময় ত অনন্ত অপেক্ষাই ছিল তার আটপ্রহরের দোসর। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে সুধীরেশ। ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ছেলেটা এক পরাবাস্তব দিনবদলের মোহে তখন দিশাহারা। বরানগর তখন যেন বধ্যভূমি। দিনেদুপুরে পুলিশি রেড হচ্ছে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে।বাবা একরকম গৃহবন্দী। ক্লাস বন্ধ। মা কিছুতেই ঐ উত্তাল সময়ে বাবাকে কলেজে যেতে দিতে চাইতেন না। বাবা জেদ ধরলে তীব্র উৎকন্ঠার আবেগে অসুস্থ হয়ে পড়তেন ।
শ্রীময়ী ম্যাট্রিক পাশ করে একই ইস্কুলে একাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। নিয়মিত ক্লাস হয়না। বাড়ির বাইরে বেরোনোও নিয়ন্ত্রিত। সুধীরেশের সঙ্গে যোগাযোগ হতো ওর এক বন্ধু হিমাংশুর মারফত। কখনো দু’লাইনের একটা ময়লা চিরকুট — ‘রাধা, জলপাইগুড়ি যাচ্ছি।ফিরে যোগাযোগ করব।’ বা, ‘চিন্তা কোরো না, আমি ডায়মন্ড হারবারের কাছে একটা গ্রামে আছি। ফিরলে দেখা করার চেষ্টা করব। চিরকুটটা কিন্তু ছিঁড়ে ফেলো।’
কখনো বা শুধু মৌখিক কুশল সংবাদটুকু পৌঁছে দিত হিমাংশু।
এই টালমাটাল সময়ে তার জীবনে শুরু হল এক নতুন উপদ্রব। বিলু। এক পাড়াতেই বাস। লেখাপড়ার ধার ধারেনি কোনদিন। চৌধুরীদের রোয়াকে বসে অবিমিশ্র গুলতানি আর অশ্রাব্য খিস্তিখেউড়ে পথচলতি মানুষের অস্বস্তি বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া প্রকাশ্যে তাকে আর কোনদিন কিছু করতে দেখেনি শ্রীময়ী। চোয়াড়ে, পেটানো চেহারা। অমার্জিত চোখমুখ। শুধু তার চোখে চোখ পড়লেই কেমন একটা হয়ে যেত বিলুর মুখ। বাসস্ট্যান্ড অবধি ফলো করতে দেখেছে অনেকবার। একদিন মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল শ্রীময়ী — ”পিছন পিছন আসছেন কেন? কি দরকার?” বিলু
একটু থতমত খেয়ে ঢোক গিলে আস্তে আস্তে বলেছিল — ”না মানে — দিনকাল তো ভাল না, একা বেরিয়েছ! তাই একটু সঙ্গে সঙ্গে —”
কথা শেষ করতে দেয়নি শ্রীময়ী। দু’চোখের আগুন আর প্রতিটি শব্দ থেকে ঠিকরোনো মর্মান্তিক ঘৃণা চাবুকের মত সপাটে আছড়ে পড়েছিল বিলুর মুখে — ”দিনে মাতলামি আর রাতে ওয়াগন ব্রেকিং করেন — এখন আমাকে পাহারা দিতে এসেছেন? আপনার লজ্জা করে না? বেহায়া চরিত্রহীন কোথাকার!”
ঠিক কতটা অন্ধকার নেমে এসেছিল বিলুর মুখে, সেটা দেখার জন্য আর দাঁড়ায়নি শ্রীময়ী।
তা, কথাটা মিথ্যেও ছিল না। চিৎপুর রেলইয়ার্ডে বিলু তখন অঘোষিত সুলতান। রিলিফের বেবিফুড আর গুঁড়ো দুধের প্যাকেট খালাস করে করে হাত পাকিয়ে ফেলেছিল। পার্টি অফিসে আনাগোনা বেড়েছিল। খাতিরও। দড়িবোমা আর পেটো — শোনা যেত, এই দুটোকে প্রায় শিল্পকর্মের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। সেই সঙ্গে শত্রুও তৈরি করেছিল বিস্তর। এলাকার দখলদারি নিয়ে কাশীপুরের চাঁদুর সঙ্গে বোমাবাজি, মারামারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পুরো এলাকা দস্তুরমতো যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছিল ওরা।
শ্রীময়ীর অন্তরে তখন অন্য যুদ্ধের দামামা। একদিন খবর এল, সুধীরেশ ধরা পড়েছে। লালবাজারে সম্ভাব্য অসম্ভাব্য নানারকম নির্যাতনের কথা কানে আসতে লাগল। শ্রীময়ীর তখন পাগল পাগল অবস্থা। হিমাংশু ছাড়া আর কারোর কাছে খবরটুকুও পাওয়ার উপায় নেই। মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না। হিমাংশুর কাছেই একদিন খবর পেলো, ছেলে ধরা পড়ার পরই সাধনজেঠু, মানে সুধীরেশের বাবা — নানা তদ্বিরে লেগে পড়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, তাও আবগারি দফতরের, চেনা পরিচিতের গন্ডি নেহাত ছোট ছিল না তাঁর। সোজা, বাঁকা, নানা উপায় অবলম্বন করে শেষমেষ সুধীরেশকে ছাড়িয়ে আনেন তিনি। হিমাংশুর মুখে এই খবরটাই কেবল পেয়েছিল সে। দেখা আর হয়নি তাদের। কারণ, পাড়ায় আর কখনো ফেরেনি সুধীরেশ। বম্বেতে কোন এক মাসীর বাড়িতে নাকি তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাধনজেঠু। নিজেরাও বালিগঞ্জে বাড়ি করে উঠে গিয়েছিলেন কয়েক মাসের মধ্যে।
তারপর দিন গেল দিনের নিয়মে। ডামাডোল থামলো একদিন। রাজনৈতিক পালাবদল হলো। শ্রীময়ীর বাবা অশোকবাবুর ক্লান্ত হৃদযন্ত্র এত ঘটনার অভিঘাত সইতে না পেরে জবাব দিল একদিন। শ্রীময়ীর তখন এম.এ পরীক্ষা চলছে।
অশোকবাবুর মৃত্যুর পর জানা গেল ঘোরতর অবিবেচক মানুষটি পরিবারকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে পথে বসিয়ে গেছেন। সঞ্চয় নামমাত্র। মাথার ওপর ছাদটুকুর সংস্থানও নেই। নির্মলকাকার মধ্যস্থতায় বেলঘরিয়ার এক স্কুলে বাংলা টিচারের চাকরিটা পেয়েছিল শ্রীময়ী। এখনো সেটাই করে। অন্নসংস্থানটা কোনওক্রমে হয়। এম.এ আর দেওয়া হয়নি। বরানগরের আড়াইখানা ঘরের ভাড়াবাড়ির দেওয়াল আরো বিবর্ণ হয়েছে এই ক’বছরে। তার মনেও পলি জমেছে বিস্তর। শ্রীলেখা কলেজে পড়ে। ওকে ঘিরেই এখন স্বপ্ন দেখে শ্রীময়ী — বোনটাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, একটা ভাল পাত্র দেখে গোত্রান্তরিত করতে হবে — বাবার পেনশনের ফাইলটা যেন অচলায়তন হয়ে চেপে বসেছে বুকের ওপর। যদি এতটুকু নড়ানো যায়, একটু আশার আলো যদি দেখাতে পারে সুধীরেশ – শিক্ষাসচিব সুধীরেশ মজুমদার, সেই ভরসাতেই এসেছে শ্রীময়ী। প্রার্থী হয়ে। ভিখারিণীর মতো।
পুরোনো ভাবনার ভেলায় চড়ে, ভাটার টানে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে গিয়েছিল সে। পিওনের ডাকে হুঁশ ফিরল —”আসুন দিদি। সাহেব ডাকছেন।”
পা দুটো যেন লোহার মতো ভারী লাগছে, তাও কাঁপা হাতে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল শ্রীময়ী। গম্ভীর, ভরাট গলাটা শুনতে পেলো —”বসুন”।
বসল সে। সুসজ্জিত, ফাইলশোভিত টেবিলের ওপারের মানুষটি সোজাসুজি তাকিয়ে তার দিকে। সেই ঝকঝকে চোখ এখন আরো উজ্জ্বল, রগের চুলে সামান্য পাক ধরেছে, ঠোঁটের কোণে সেই তাচ্ছিল্যের মোচড়, যেটা একসময় অন্ধ আবেগে পাগল করে দিত শ্রীময়ীকে —- সব একই রকম।
তার প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করে সুধীরেশ মজুমদার প্রশ্ন করলেন —”বলুন, কি প্রয়োজন?” শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে শ্রীময়ী কোনওমতে উচ্চারণ করল —”আমি শ্রীময়ী। বরানগরের শ্রীময়ী সেন।” অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠতে চাইল — সুধীর, আমি রাধা! তোমার রাধা! চিনতে পারছ না আমাকে? কত, কত যুগ পেরিয়ে গিয়েছে সুধীর, যে তুমি এক্কেবারে ভুলে গিয়েছ আমায়? কিন্তু গলায় স্বর ফুটল না তার। শিক্ষাসচিব একটু যেন বিরক্ত — ”নাম তো স্লিপেই দেখেছি। প্রয়োজনটা বলুন। সংক্ষেপে বলবেন। আমি একটু ব্যস্ত মানুষ, বুঝতেই পারছেন—”
তাঁর অভ্রংলিহ গাম্ভীর্যের মেঘ ভেদ করে পূর্ব পরিচয়ের সামান্য বিদ্যুৎলেখাও শ্রীময়ীর চোখে ধরা দিল না।
কয়েক মুহূর্ত স্থাণু হয়ে বসে রইল সে। তারপর সসংকোচে চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রের মতো দু’টো হাত জোড় করল সামনে —
‘কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। আপনার মূল্যবান সময় অকারণে কিছুটা নষ্ট করে গেলাম। মার্জনা করবেন।”
ঠাঠা দুপুর। বাস থেকে নামল শ্রীময়ী। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। এই ভরদুপুরেও কচির পানের দোকানে টেপ চলছে। ক্যাসেটে হিন্দি ছবির চটুল গান বাজছে — পেয়ার কা তোফা মিলা, বনা হ্যায় জীবন মেরা, মুঝে তো অওর কেয়া চাহিয়ে—
মাথাটা টিপটিপ করে ওঠে শ্রীময়ীর। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি, বেশ খানিকটা হাঁটাপথ। লাইব্রেরি মোড়ের বটগাছতলায় এসে থেমে গেল পা দুটো। একটু ছায়া, একখন্ড ছায়া চাই তার। বটতলার বাঁধানো বেদিটায় বসল সে। বসেই সচকিত হল। এই সেই লাইব্রেরি বটতলা। তিনবছর আগে এখানেই ঘটে গিয়েছিল সেই সাংঘাতিক ঘটনাটা। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় সে।
স্কুল ফেরত বোনটার রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে লখনা। কাশীপুরের চাঁদুর ডানহাত। পুলিশের এনকাউন্টারে চাঁদু ছবি হয়ে যাবার পর কাশীপুরের ত্রাস তখন লখনা।
বোনকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরার পথে, বুঝিবা কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছিল শ্রীময়ী — ভেবেছিল, বোন তো আসছেই পিছনে। ”দিদিইইইই—–” শ্রীলেখার আচমকা আর্তস্বরে চমকে পিছু ফিরেই দেখতে পেয়েছিল ভয়ঙ্কর দৃশ্য। লখনার হাত পৌঁছেছে শ্রীলেখার বুকের কাছে। টেনে নিতে চাইছে ওড়নাটা, ওর শ্লীলতার মায়া চন্দ্রাতপ — লুঠতে চাইছে নিষ্পাপ কৈশোর!
একটা আর্তনাদ করে দৌড়েছিল শ্রীময়ী, বাধা দেবে বলে। কিন্তু তার আগেই দেখল, কোথা থেকে একটা অমানুষিক চিৎকার করে ওর বোন আর লখনার মাঝে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিলু।
গলায় বাঘের হুঙ্কার –”এই শালা হারামির বাচ্চা, সরে যা, ফোট শালা এখান থেকে—”
”ফালতু কিচাইন করিস না বিলে, মাল তুলব বলে এসেছি, তুলতে দে! তুইও বখরা চাস নাকি বে?”
লখনার কুৎসিত হাসিটা উইপোকার মত কিলবিল করছিল শ্রীময়ীর সারা স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে।
”শা-আ-লা বেজম্মার বাচ্চা, লাথখোর কুত্তা কোথাকার —”
বিলুর হাতের একটা ঘুষিতে ছিটকে পড়েছিল লখনা। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল শ্রীময়ী।
তারপর — তারপর একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ — চোখ খুলে শ্রীময়ী দেখেছিল, ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে হৈহৈ করে বেরিয়ে আসছে মানুষজন। অজস্র মানুষের অর্থহীন চিৎকারের মাঝখানে একটা কান্নাজড়ানো ডাক –”দিদি, এই দিদি, তুই কোথায়?”
খুঁজে পেয়ে দুহাতের বেড়ে বোনকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। ততক্ষণে ধোঁয়া সরে গেছে। তারই মধ্যে বিস্ফারিত চোখে দেখেছিল, রক্তের একটা পুকুর তৈরি হচ্ছে বটতলার ধারে। আর তার মধ্যে পড়ে আছে একটা মানুষ — একটা অমানুষ — তার খোলা চোখের দৃষ্টি মিলিয়েছে আকাশের কোন সুদূর অসীমে — যন্ত্রণার কোন চিহ্ন নেই মুখে — গভীর প্রশান্তি নিয়ে কি দেখছে, তা শুধু বোধহয় ও-ই জানে।
চোখের ওপর হাতটা একবার চালিয়ে বেদি থেকে উঠে পড়ল শ্রীময়ী। মঙ্গল আর শুক্রবারে রেশন দোকান খোলে। আজ শুক্রবার। তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে মাথায় দু’ মগ জল ঢেলে কিছু মুখে দিয়ে রেশন দোকানে লাইন দিতে হবে – দেরি হলে চলবে কেন?
লাইব্রেরি মোড়টা ছাড়াবার আগে একবার, শুধু একটিবার পিছন ফিরে দেখল শ্রীময়ী। শতদল সংঘের ক্লাবঘরের পাশে হেলে পড়া অবহেলার মার্বেল ফলকটাকে। মলিন শ্বেতপাথরের গায়ে কালো অক্ষরগুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে —
বরানগর ঘোষবাগানের গর্ব,
বিল্বদল ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে
ঘোষবাগান অধিবাসীবৃন্দ
২০শে এপ্রিল ১৯৮৪
না, বিলুর ভাল নামটা ভোলেনি শ্রীময়ী, কোনদিনও ভুলবে না।