।। স্থান কাল পাত্র ।।
“Ye Gods! Annihilate but space and time, And make two lovers happy.” – Alexander Pope.
আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত যা আলোচনা করেছি তাতে দেখলাম আমরা যা কিছু দেখি তা আমাদের চেতন মনের দ্বারা বিশ্লেষিত হলেই আমরা কখনো তাকে ‘সত্যি’ বা ‘ধ্রুব’ বলে ভাবতে পারব না কারণ আমার পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে সেই বস্তু তার অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। অন্যভাবে বলা যায় আমরা যা ‘দেখছি’ তা যেন ‘পূর্বনির্ধারিত’। কেউ যেন আগেই ঠিক করে রেখেছে আমার ‘দেখা’ কেমন হবে। আমারই চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয়েছে। গোলাপকে সুন্দর হতে বলেছি তাই সে সুন্দর হয়েছে। এভাবে বললে হয়ত চেতনার গুরুত্ব বাড়ে। ইগো বা অহমের অর্থ প্রকট হয়। কিন্তু আদপে তা সত্য নয়।
পান্নার অনেক রঙ থাকতে পারে। এই মুহুর্তে আমি যা দেখছি সেটি ‘সবুজ’। গোলাপকে আমি কিভাবে সুন্দর দেখব এটা আমার মস্তিষ্কে লেখা আছে। আমি তাই তাকে সুন্দর দেখছি। এই পৃথিবীতে ‘ফ্রি উইল’ বলে কিছু নেই। তাই ‘ইগো’, ‘অহম্’ এসব শব্দ অভিধানে থাকারই কথা নয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমাদের মস্তিষ্ককে যেন কোন এক অলীক শক্তি বা চেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো ‘মহাজাগতিক চেতনা’ বা ‘কসমিক কনশাসনেস’ তাই সেই শক্তি যেমন চাইছে আমরাও তেমন দেখছি বা বুঝছি। আমরা দেখছি তাই এই সবকিছু আছে। না দেখলে কিছুই নেই। আমাদের চেতনাই যেন এই মায়াময় বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছে।
আগেই বলেছি যে চেতনা হল কিছু ধারাবাহিক স্থিরচিত্র। তাতে সময় আঠার মত লেগে গিয়ে তাতে গতি সৃষ্টি করেছে। ঠিক যেমন পরপর অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার স্থির ছবি দ্রুতবেগে প্রোজেক্টরে সামনের দিকে চালালে আমাদের মনে হয় ঘোড়াটা ছুটছে ঠিক তেমন। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের চেতনার সাথে সময়ের এক বিরাট গুরুত্ব আছে। আমরা যে ক্ষেত্রের মধ্যে থেকে এই দৃশ্যজগতকে দেখছি তাই হল স্থান বা স্পেস। আমাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করার জন্য স্থানের ধারণা প্রয়োজন। নাহলে আমরা কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
এই স্থান বা স্পেস কী? এটি কি নির্দিষ্ট না অনির্দিষ্ট? এটি কি শূন্য না এর মধ্যে কিছু আছে? একে আমরা মাপব কিভাবে? আইনস্টাইনকে যখন এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন তিনি বলেন, “স্পেস এমন কিছু যাকে আমরা স্কেল দিয়ে মাপতে পারি”। উত্তরটা যদিও ব্যঙ্গাত্মক ছিল, তবে আমরা জানি তিনি নিজেও একে সঠিক বলে মনে করতেন না। তার স্পেসটাইমের ধারণা একটা 4D চিত্র যাকে 3D দৃশ্যের পক্ষে উপযুক্ত আমাদের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তবে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির ধারণা দিয়ে আমরা একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারি যে স্থান এবং কাল আমাদের একটা ‘মানসিক ধারণা’ মাত্র। এক্কেবারে মানসিক ধারণা। যাদের আমরা তৈরি করেছি আমাদের চারপাশকে ভালোভাবে বুঝতে কিন্তু তারা কেউই নির্দিষ্ট তো নয়ই আদৌ তাদের অস্তিত্ব আছে কিনা তাই নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। একটি উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন।
সূর্য আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। এই মহাবিশ্বে যে নক্ষত্র রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তার নাম ‘সিরিয়াস’। এটি আমাদের পৃথিবী থেকে ৮.৬ আলোকবর্ষ দূরে আছে। মানে আমরা যদি আলোর গতিবেগে সেই নক্ষত্রের দিকে যাত্রা করি তাহলে সেখানে পৌঁছতে আমাদের ৮.৬ বছর সময় লাগবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা মেনে নিলে আমরা যদি আলোর ৯৯% গতিবেগ নিয়ে সিরিয়াসের দিকে যাত্রা করি তাহলে আমাদের সেখানে পৌঁছাতে ১ বছর সময় লাগবে। অথচ পৃথিবী থেকে মনে হবে আমার ৮.৬ বছরই লেগেছে। তাই এটা ভাবা সঙ্গত যে মহাকাশযাত্রীর কাছে সেই ৮.৬ আলোকবর্ষের পথ বা স্পেস যেন সঙ্কুচিত হয়ে ১ আলোকবর্ষ হয়ে গেছে। তাহলে স্থান বা স্পেস কি করে নির্দিষ্ট হয়?
ধরুন আপনি যে ঘরে থাকেন তার দৈর্ঘ্য যদি ২১ ফুট হয় এবং মনে করুন সেই ঘরটা কোনোভাবে আলোর ৯৯% গতিবেগ নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। তাহলে সেই সময় যদি আপনি স্কেল দিয়ে পরিমাপ করেন তবে আপনার ঘরের দৈর্ঘ্য হবে ৩ ফুট। আর যদি কোনোভাবে ঘরটির গতি আলোর ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯% হয় তবে তার দৈর্ঘ্য হবে এক ইঞ্চির একশ ভাগের এক ভাগ। সেই সময় যদি আপনি তাকে স্কেল দিয়ে মাপেন তার দৈর্ঘ্য তাই পাবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল ঘরের দৈর্ঘ্যের সাথে সাথে আপনার দৈর্ঘ্য, আপনার চেয়ার টেবিল খাট মায় আপনার পোষা বিড়াল আপনার প্রিয় বউ সবার দৈর্ঘ্যই কমে গেছে। আপনারা সবাই ‘লিলিপুট’ হয়ে গেছেন। কিন্তু আপনার কাছে সবকিছু স্বাভাবিক বলে মনে হবে কারণ আপনার সাপেক্ষে সবকিছুই ছোট হয়ে গেছে। আপনার রিয়ালিটিতে তখন চারপাশের সবকিছুই স্বাভাবিক। কোথাও কোনো প্রশ্ন নেই, সন্দেহ নেই। তবে চেতনাও কি ওই গতিতে গেলে সঙ্কুচিত হয়ে যায়? যেতেই পারে। আমরা জানি না তবে হতে পারে কারণ আমাদের মস্তিষ্কও তখন সেইভাবেই ক্ষুদ্র হয়ে গেছে।
কোয়ান্টাম ফিজিক্স মনে করে এই মহাবিশ্বের সব বস্তু যে আলাদা আলাদা হয়ে আছে এটা একটা ধারণা, এটা ঠিক নয়। এই পৃথিবীতে বস্তুর মধ্যে দূরত্ব থাকা সম্ভব নয়। আপনি যদি আলোর গতিবেগ নিয়ে কোনো মহাকাশযানে চেপে মহাকাশে পাড়ি দেন তবে জানালা দিয়ে তাকালে কি দেখবেন? দেখবেন আপনার দৃষ্টিগ্রাহ্য সব মহাজাগতিক বস্তুসমূহ একটি বস্তুতে এসে দাঁড়িয়েছে তার বাইরে সবকিছু অন্ধকার। নিকষ, নিরেট কালো অন্ধকার। ঠিক যেন বিগ ব্যাং-এর সময়কালের একক বস্তুপিন্ড যা ফেটে পড়ার ঠিক আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে আপনি কী বলবেন এই মহাবিশ্ব, এই স্থানের ধারণা এটি কি শুধুই ধারণা নয়? এটি কি শুধুমাত্র আমাদের মানসিক কল্পনা নয়? এমন কল্পনা যা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না। আমাদের বাস্তবতায় চেতনায় যা দেখছি তা কি একটা ধাঁধাঁ নয়?
এ তো গেল স্থানের কথা। আর সময়? টাইম? সে তো আরেক এনিগমা। আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সময় কি? আপনি কী বলবেন? অনেক আগে যখন সূর্যঘড়ি ও বালিঘড়ি ছিল লোকে সেই হিসেবে সময় বলত। এক প্রহর, দুই প্রহর। দার্শনিকভাবে পল, অনুপল। যখন দম দেওয়া ঘড়ি এল তখন চব্বিশঘন্টা পরপর তাকে দম দিলে সে সময়ের ধারণা দিত। এখন আমার আপনার হাতে যে ‘কোয়ার্টজ’ ঘড়ি তা একটি ইলেকট্রনিক অসিলেটর ব্যবহার করে যেটিকে ‘কোয়ার্টজ কেলাস’ নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সময় দেয়। সেই সময় দিয়ে আমাদের চলে যায়।
কিন্তু আমাদের যদি আরো সংক্ষিপ্ত সময়ের জ্ঞান দরকার হয়, যেমন ধরুন কোনো যৌগের মধ্যে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি হতে কিংবা নিউক্লিয়াসের ভেতরে কোনো ফিউসন রিয়াকশন হতে কত সময় লাগে, তা জানতে হলে আমাদের সময়কে আরো ভেঙ্গে দিতে হবে। তাই আমরা তখন পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করি। একটি সিজিয়াম পরমাণুর তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ হিসেব করে এই ঘড়ি কাজ করে। এই ঘড়ি এত নির্ভুল যে ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ বছরেও এতে এক সেকেন্ডের গরমিল হবে না।
তাহলে এটাই কি সময়? আপেক্ষিকতা বলছে সময় স্থিতিস্থাপক। তা দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত হতে পারে। আগে যে উদাহরণ দিলাম আপনি যদি আলোর ৯৯% গতিবেগে সাইরাসের দিকে যাত্রা করেন তাহলে দু’বছর পরে যখন আপনি সাইরাস থেকে ফিরে আসবেন তখন আপনার বয়স সবে দু’বছর বাড়বে। কিন্তু পৃথিবীতে আপনার সন্তানের বয়স ততদিনে ১৭ বছরের কিছু বেশি বেড়ে গেছে। আর আপনি যদি আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯% বেগে যাত্রা করেন তাহলে আপনার আত্মীয়-স্বজন কাউকে এসেই দেখতে পাবেন না। পৃথিবীকেই চিনতে পারবেন না। হতে পারে সেসময় আমাদের পৃথিবী হয়ত ধ্বংস হয়ে গেছে। ‘নতুন পৃথিবীর’ মানুষদের কাছে আপনাকে মনে হবে ‘এলিয়েন’। সময়ের এই বিপুল পরিমাণে প্রসারণ বা ‘টাইম ডায়লেশন’ তো পরীক্ষিত সত্য। তাই যদি হয় তবে সময় কী?
সময় একটা ধারণা। খুব সম্ভবত তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ত্ব নেই।
এই যে সময়ের প্রসারণ ও সঙ্কোচন তা কী আমরা আমাদের আলোর চেয়ে বহু বহু বহু কম গতিবেগে ঘুরতে থাকা এই পৃথিবীতে বসে বুঝতে পারি? আমাদের সময়চেতনাই বা কী? আমাদের আপেক্ষিক এই চেতনার জগতে সময় কিভাবে অনুভূত হয়?
সময় অনুভূত হয়। আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় বুঝতে পারবেন না। ঠিক যেমন এক গাড়ির ভেতরে বসে থাকলে বোঝা যায় না গাড়িটি চলছে। আমরা এবার সেই বিশেষ বিশেষ অবস্থাগুলো আলোচনা করব যেখানে সময় দাঁড়িয়ে গেছে বা দৌড়চ্ছে। তা পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের ধারণা নয়। আমরা আমাদের চেতনা দিয়েই তাকে বুঝব এবং তার সাথে এটাও বুঝব সময় বলে কিছু হয় না। রাত-দিন বলে কিছু নেই। জীবন-মরণ একটা ধারণা। জন্ম-মৃত্যুর ধারণা আসলে শ্রোডিংগারের বিড়ালের ধারণা। আমরা সবাই এই স্থান-কালের গোলকধাঁধায় করুণ ও অসহায়ভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছি।
(চলবে)