আজ আপনাদের এক আশ্চর্য মানুষের কথা শোনাই। তাঁর নাম মেরী, মেরী সুরিন। আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলমহল লাতেহারের বাসিন্দা তিনি। মাটির কাছাকাছি থাকা এই অপরিচিত গ্রাম্য মহিলা একেবারে একার হাতে এক অসাধারণ কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছেন। তাঁর কথায় আসবো। তবে তার আগে খানিক গৌরচন্দ্রিকার পর্ব সেরে নিই।
এই গরমে তৃষ্ণার্ত হলে আমি, আপনি, আমরা কী করি? ঠিক বলেছেন,ঢকঢকিয়ে গলায় জল ঢালি। নিমেষেই তৃষ্ণার নিবৃত্তি এবং মন-প্রাণের শান্তি। এমন প্রাণঘাতী গরমে গাছেদেরও তো নিশ্চয়ই তৃষ্ণা পায়? বাড়ির টবে থাকা গাছের তৃষ্ণা পেলে গাছের পাতা ঝুলে পড়ে । তা টের পেয়েই আমরা টবে জল দিয়ে নিমেষেই গাছকে চাঙ্গা করে তুলি। আচ্ছা! জঙ্গলের গাছেদের পিপাসা পেলে গাছেরা কী করে?কে তাদের পিপাসা মেটায়? পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত জঙ্গলের গাছেদের যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে তারা সমস্বরে উত্তর দেবে মেরী সুরিন। ঝাড়খণ্ডের এই অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা ভয়ঙ্কর। বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মকালীন তাপদাহের ফলে জঙ্গলের পূর্ণ বয়স্ক গাছেরও শুকিয়ে মারা যায়। আর তারপরই দাবানলের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায় বিস্তির্ণ বনাঞ্চলের লতা গুল্ম গাছ গাছালি। প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মরীয়া ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম বাঁধানিয়ার মেরী। কঠিন লড়াই জেনেও পিছিয়ে যায়নি সে। বরং মেরীর হার না মানা অবিচল লড়াইয়ের ওপর ভর করেই আজ মেরীর গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলের গাছেদের পাশাপাশি আদিবাসী গ্রামের মানুষজন গরমের সময় জলের অভাব থেকে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু মেরী সুরিন এই অসাধ্য সাধন করলেন কীভাবে? সেই কথাই শোনাবো।বনবালা মেরী বনপথে চলতে ফিরতে গিয়ে লক্ষ করেন যে মাটির সাথে সাথে বনের ভেতর দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নালা গুলোতেই কেবলমাত্র জল পাওয়া যায় গরমের শুখা মরশুমে। মেরীর মনে হলো মাটির ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে গড়িয়ে যাওয়া জলকে যদি কোনো উপায়ে ধরে রাখা সম্ভব হয় তাহলে তো জলের জোগান বেশ খানিকটা বেড়ে যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই গুলোকে জল বয়ে যাবার পথে সারি দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করে ফেললেন ছোট ছোট চেক্ ড্যাম – স্থানীয়ভাবে এদের বলা হয় পাত্থর কি বাঁধ। এই দেয়ালের পেছনে জমা জল তৈরি করলো ছোট জলাধার। এই জলেই অনেকটাই সুরাহা হলো খরা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার।
স্কুল কলেজের পুঁথিগত বিদ্যার থেকে জীবনের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা বিদ্যা যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মেরীর এই কর্মপ্রয়াস সেই কথাই যেন নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল। দারিদ্র্যের কারণে মাঝপথেই পড়াশোনা থামিয়ে দিতে হয় তাঁকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। সুতরাং প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর্থিক সামর্থ্যও তাঁর ছিলোনা। কেবল প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও পরিবেশ প্রেমের ওপর নির্ভর করেই সুখী গৃহবধূর জীবনকে হেলায় পেছনে সরিয়ে রেখে তিনি ময়দানে নেমে পড়লেন। মেরী উপলব্ধি করেছিলেন যে মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণিদের অস্তিত্ব এক সুতোয় বাঁধা – জল। মেরী ঘরের কাজকর্ম সামলানোর সাথে সাথে গ্রামের মানুষজনকে জল বাঁচানোর গুরুত্বের কথা বোঝাতে শুরু করলেন। তিনি বললেন – “জল বাঁচলে আমাদের পৃথিবীর বিপুল প্রাণসম্পদ হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে। দাবানলের প্রকোপ কমলে সম্পদহানির হাত থেকে আমরা নিজেদের ও বনজীবীদের টিকিয়ে রাখতে পারবো। আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান নেই বটে কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ কম নেই। তাই কিছু ধার করে আনার আগে আমি হাতের কাছে পড়ে থাকা পাথর আর মাটি দিয়েই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করলাম। প্রকৃতি মা আমাদের অনেক দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে তাঁর জন্য কিছু করতে চেয়েছি মাত্র।” এক বিনম্র প্রকৃতিসেবীর উত্তর।
এক সহজ কার্যকরী উপায়।
নিজের গ্রামের জমির ওপর দিয়ে দ্রুত গড়িয়ে যাওয়া বর্ষার জল দেখতে দেখতেই মেরীর মাথায় কিছু করার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। মেরী লক্ষ করলেন যে জল গড়িয়ে যাবার সময় জমির একদম ওপরে থাকা মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে । একজন কৃষিজীবী মানুষের কাছে মাটি হলো মা এর সমান। তাই গড়িয়ে যাওয়া জল ও মাটি – এই দুই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার তাগিদ উপলব্ধি করলেন তিনি। মেরীর মূল উদ্দেশ্যই হলো বর্ষার জলকে যে কোনো উপায়ে গ্রামের পরিসীমার ভেতরে ধরে রাখা যাতে এই জল ঢাল বরাবর গড়িয়ে গড়িয়ে ২২ কিলোমিটার দূরে থাকা কোয়েল নদীতে মিশতে না পারে। এমন হলে মাটি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং কৃষির অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
মেরী এক সভার আয়োজন করলেন। আহ্বান করলেন গ্রামের সমস্ত মানুষজনকে। সেই সভায় গ্রামের প্রবীণ অধিবাসীদের সামনে তিনি খুলে বললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা –জঙ্গল থেকে পাথর কুড়িয়ে এনে মাটি আর পাথরের আড় বাঁধ বা চেক্ ড্যাম তৈরি করে জল আটকানোর চেষ্টার কথা। মেরী বললেন – “আমি কোনো নতুন উপায় বাতলাচ্ছি না। এই উপায়ে দেশের সর্বত্র ভূমি ক্ষয় রোধ ও জলের জোগান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমাদের একার পক্ষে সবটা করে ফেলা সম্ভব নয়। তাই আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সাহায্য নিয়ে কাজটা করতে চাই। এই ব্যাপারে আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?” গ্রামের মানুষজন উল্লসিত কন্ঠে জানায়— মারী তুমি এগিয়ে কালো। আমে সবাই তোমার সঙ্গে আছি।“ আমাদের আর তর সইছিল না। আমরা সবাই চাইছিলাম খুব তাড়াতাড়ি কাজটা শুরু করতে যাতে বর্ষার আগেই পরিকল্পনা মতো আমরা কাজটা খানিকটা এগিয়ে রাখতে পারি। আমাদের না ছিল কোনো ম্যাপ,না ছিল কোনো নিখুঁত ছক। আমাদের একমাত্র পুঁজি ছিল আবেগ। কোনো রকম সরকারি যন্ত্রপাতির ভরসা না করেই আমরা জঙ্গল থেকে পাথর সংগ্রহ করতে শুরু করি।”– মেরী ব্যাখ্য করেন।
মেরীর তত্ত্বাবধানে মাত্র এক মাসের মধ্যে সাতটি বাঁধ তৈরি করা হয়। এগুলো তৈরিতে এক চিমটি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয় নি। “ সম্পূর্ণভাবে পাথর আর মাটি দিয়েই তাঁরা এই বাঁধগুলো নির্মাণ করেন। মাত্র ৪- ৫ ঘন্টার মধ্যেই আমরা সবাই মিলে এক একটি বাঁধ বানিয়ে ফেলছিলাম। এখন এখানে বাঁধের সংখ্যা ৩৫ টির বেশি। বাধনিয়া গ্রাম এখন জল সংরক্ষণে সক্ষম”। – কথাগুলো বলার সময় মেরীর কন্ঠে ঝরে পড়ে বিজয়িনীর হাসি। আজ তৃপ্তির পরশ তাঁর চোখে মুখে।মেরী সুরিনের প্রচেষ্টায় এখন বাধানিয়া গ্রামে সুদিন ফিরে এসেছে। তরতরিয়ে গড়িয়ে যাওয়া জল এখন বাঁধা পড়েছে বাঁধের পেছনের ছোট ছোট জলাধারে। জল আছে তাই জীবনের বহুমুখী বিকাশের আয়োজন আজ অনেকটাই সম্পূর্ণ। মাটির ধুয়ে যাওয়া কমেছে, বেড়েছে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা। বনের আবাসিক হরিণ,হাতি লম্বা লেজওয়ালা শাখামৃগরাও বেজায় খুশি। জলের জন্য গরমের সময় তাদের আর দূর দূরান্তরে পাড়ি দিতে হয়না। নদীতেই এখন পর্যাপ্ত জলের জোগান। কৃষকদের এখন আর সেচের জন্য বাড়তি খরচ করতে হয় না। মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকছে প্রাকৃতিক উপায়ে। সবাই এখন নিজেদের কর্মকাণ্ডের সুফল পাচ্ছে আর ধন্যবাদ জানাচ্ছে তাঁদের গাঁয়ের মেয়ে মেরীকে।
দাবদাহের সঙ্গে কমেছে দাবানলের দাপটপালামৌ এর জঙ্গলের দাবানল মোকাবেলায় মেরীর জলাধারের জল এখন কার্যকর সাধন হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মের খরতাপের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের দাপাদাপি বেড়ে গিয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। বাঁধ নির্মাণের পেছনে মেরীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গ্রীষ্মকালীন দাবানলের হাত থেকে নিজেদের গ্রামের মানুষজন ও জঙ্গলকে রক্ষা করা। তাঁর এই অভিলাষ আজ অনেকাংশে পূর্ণ হয়েছে।
“ জলের সংস্পর্শে এসে এখন মাটি ভিজে থাকছে অনেক বেশি সময় ধরে। তাছাড়া জলাধার সংলগ্ন এলাকাগুলোতে আর্দ্রতা বজায় থাকার দরুন আগুন সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারছে না। জলের জোগানে নিশ্চয়তার সাথে সাথে আমরা এখন দাবানলের ভয়াবহতা থেকেও অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছি।” – মেরীর প্রত্যয়ী উত্তর ।
শুধু বাধানিয়া গ্রামের মানুষজন নয়। আশেপাশের এলাকার মানুষজনের মধ্যেও মেরীর জলাধার প্রকল্পের বহুমুখী সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। মেরী শুরুতে একাই পথচলা শুরু করেছিলেন। আর আজ গোটা লাতেহার – পালামৌ জেলার সীমানা পেরিয়ে তাঁর কাজের খবর পৌঁছে গেছে সারা রাজ্যে।
একেবারে সাধারণ আদিবাসী পরিবারের মেয়ে, আদিবাসী পরিবারের গৃহবধূ মেরী সুরিন আজ এক অসম্ভব কর্মযজ্ঞের সার্থক অগ্নিহোত্রী। আমাদের মেয়েরাও পারেন নতুন পথের দিশা দেখাতে। মেরীর এই কাজে সবসময় তাঁর পাশে থেকে তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর স্বামী ইলিয়াস টোপ্পো। আজ স্ত্রীর কৃতিত্ব সমানভাবে উপভোগ করেন তিনি। তিনি চান আরও নতুন নতুন কাজে যুক্ত হতে, আরও অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
ঋণ স্বীকার:
E Tv Bharat এর প্রতিবেদন
ঝাড়খণ্ড নিউজ
রাঁচি ক্রনিকল।
২৪.০৬.২০২৫.
অসামান্য। হতাশা, অন্ধকারের মধ্যে এই আলোর ফুলকি গুলি প্রেরণা যোগায়।
ফুলকিগুলো ছড়িয়ে পড়ুক ফুল হয়ে। উঠুক জেগে সহস্র প্রাণ মন ছুঁয়ে।
মেরী সুরিন এক অনমনীয় ব্যাক্তিত্বের নাম। কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এমন আড়ালে থাকা মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
এমন অসাধারণ মানুষদের কথা আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের মধ্যে। মেরী সুরিনের কাজের গভীরতা কতটা তা বুঝতে হলে মাঠে নামতে হবে। মতামতের জন্য ধন্যবাদ
An encouraging news! The much required consciousness is on the rise and it’s really heartening to know. May The Mother Nature Bless her and her folks.
Thanks for your comments. The adivasi people are much more concerned about the environment than the their urban counterparts. We should stand by her to protect the mother Nature.